– অন্তিক চক্রবর্তী

সমুদ্রের উত্তাল জোয়ার কিংবা বিষন্ন ভাটার উত্তাপ জমানো এক টুকরো মফস্বল শহর কক্সবাজার।

শহরের ইটপাথর,ঝড়ে পরা ঝাউপাতার কান্না, মালকা বানুর প্রেম, শামুকের কথা, জলদস্যুর খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হাসমত অালী, সমুদ্রের বালুচরে উদাস দাঁড়িয়ে থাকা যুবক, ঝিনুকের প্রেম,অপ্রেমের গল্পকে কখনো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় অাবার কখনো শেক্সপিয়ারের গল্পে মঞ্চে উপস্থাপন করা মানুষটির নাম স্বপন ভট্টাচার্য।

নাটক নির্মিত হয় জীবনের বাস্তবতায় কিংবা অলীক কল্পনায়৷ তবে নাট্যকার কিংবা শিল্পীর জীবন অনুকরণ করা হয় তখনই যখন জীবন কর্মময়, গতিশীল, প্রগতির চিন্তায় ও যুক্তিতে উদ্ভাসিত।

অামাদের স্বপন দা। যে জীবন নাটকের। যে জীবন মঞ্চের পেছনে জমে থাকা অন্ধকারের।

নাটক সমাজের দর্পণ। তবে তাতে জীবনের চিত্র-বিচিত্র রূপ যেমন দুশ্যমান হয়ে উঠে, তেমনি বিমূর্ত হয় নাট্যকারের জীবন দর্শন।

জীবন দর্শনের এই রঙ্গ-মঞ্চায়নই হলো নাটক। জীবন ঘনিষ্ঠ সংলাপগুচ্ছ যার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয় চিরায়ত জীবনের আনন্দ-বেদনাঘন কিছু কাহিনী, কিছু স্মৃতি, কিছু আশা। বিদগ্ধ জীবনের এমনই সংলাপগুচ্ছ আর সময়চক্রে ঘটে যাওয়া কাহিনী কিংবা ইতিহাসের নিখাদ সত্য যিনি অামাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান করে তুলেন।
সেই মানুষটি অামাদের চোখের অাড়ালেই লড়াই করেন নিজের যাপিত জীবন কিংবা নতুন নাটক নির্মানের স্বপ্নে।

দেশের চারজন প্রতিশ্রুতিশীল নাট্য নির্দেশককে দেওয়া হচ্ছে নান্দীমুখ সম্মাননা। নাট্য সংগঠন নান্দীমুখ-এর ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার প্রথম আয়োজন ‘নান্দীমুখ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১৯’ এর শেষদিন ২২ নভেম্বর এ সম্মাননা প্রদান করা হবে। এই সম্মাননায় নির্দেশক হিসেবে সম্মাননা গ্রহনের প্রস্তাবনায় একটি নাম রয়েছে। নামটি স্বপন ভট্টাচার্য। অামাদের সবার প্রিয় স্বপন দা।

স্বপন দা অামার শিক্ষক। অামরা যারা এখনো কক্সবাজারে রাজপথে, মঞ্চে নিজেদের সংযুক্ত রেখেছি। তাদেরকে শিল্পজ্ঞানে যে কজন মানুষ সংহত রাখেন, কিংবা সমৃদ্ধশালী করবার চেষ্টা করেন। স্বপন ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

মঞ্চ থেকে বক্তব্য দিয়ে নামার পর কাঁধে হাত রেখে ভুল উচ্চারণ শুদ্ধ করে দেওয়া মানুষটার নাম স্বপন ভট্টাচার্য। অামার মতো অধম কে নাটকের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে মূল চরিত্রে অভিনয় করিয়ে নেওয়া নির্দেশকের নাম স্বপন দা।

অামরা যারা এই সময়ের মঞ্চ নাটক দেখি। কক্সবাজার শহরে এখনো যে মঞ্চ নাটক তৈরি হয়। কক্সবাজার থিয়েটারের মতো একটি দল এখনো নাটকের স্বপ্নে বাঁচে। কক্সবাজারের নাট্য অান্দোলন বাঁচিয়ে রাখবার লড়াইটুকু যে কজন মানুষ জারি রেখেছেন স্বপন দা অন্যতম।

মঞ্চে আলো এসে পড়তেই নড়েচড়ে বসেন সবাই। মুগ্ধ হওয়ার বাসনা নিয়ে স্থিরচোখ মঞ্চের দিকে। শুরু হয়ে যায় সংলাপ আর আবহসংগীতের লহরী। অন্য কোনদিকে মনোযোগ সরানো যায় না। সব মনোযোগ মঞ্চের দিকে টেনে রাখে। মঞ্চের মধ্যেই একটু একটু করে রচিত হতে থাকে নতুন একটা উপন্যাস। নাটকের আলো, কলা-কুশলী, আবহসংগীত ও পোশাক রচনা করতে থাকে সেই উপন্যাস। দর্শকরা একটু একটু করে পাঠ করতে থাকেন তা। উন্মোচিত হতে থাকে অধ্যায়ের পর নতুন অধ্যায়। আমরা চলে যাই ১৯৮৫ সালের ভেতরে। সেখান থেকে কখনো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। জীবনের টানাপোড়নের সুখ, দুঃখ কিংবা হতাশা বা বিষন্নতার গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ি অনায়াসে। এমন মুগ্ধ যাত্রা চলতেই থাকে।কখনো হল ভর্তি দর্শক কিংবা কখনো দর্শকের টানাপোড়েন। তাও নাটক চলছে মঞ্চে।

তবে পরিবেশনার মুগ্ধতার কারণে অনেককিছু চাপা পড়ে যায়।
যে মানুষ মুগ্ধতার প্রতিমা গড়েন। যে মানুষ মঞ্চ ভর্তি অন্ধকারের বুকে হঠাৎ এক চিলতে অালোতে অামাদের চোখের সামনে বায়ান্ন কিংবা একাত্তরের ইতিহাস কে চিত্রায়িত করেন।

সেই মানুষটিকে আমরা মনে রাখি কতক্ষণ কিংবা কজন???

নাটক দেখলেন হলভরা দর্শক। হাসলেন, কাঁদলেন, হাততালি দিলেন। তাতেই সব কষ্ট ভুলে হল থেকে বেরিয়ে পড়েন স্বপন দা। বাইকে চেপে বসেন। তারপর বাড়ির পথে রওয়ানা দেন। বাড়ি ফেরার পথেই হয়তো মেলানোর চেষ্টা করেন জীবনের অসমাপ্ত পাটিগণিত।

কক্সবাজার শিল্পকলা একাডেমি যেদিন দাদা কে সংবর্ধিত করেছিলো সেদিন অামি কোন এক অজানা কারনে দাদার স্ত্রী বনানী দির অাশে পাশে বসেছিলাম। দাদা বক্তব্য দিচ্ছেন। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। মঞ্চে দাদা অার দর্শক সারিতে বসা দিদি দুটো মানুষের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে৷ সেদিনই বুঝে নিয়েছিলাম
স্বপন দা ও থিয়েটার অান্দোলন একে অন্যের পরিপূরক। এই জীবন শিল্পের। এই বেঁচে থাকা কবিতার কিংবা নাটকের।
দাদা দিদির সংসারটুকু নিখাঁদ প্রেমের গল্প কিনা জানি না,তবে জীবন সুখময়।

বনানী দির চোখে জমানো জল,চট্রগ্রামের শহুরে জীবন,চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ভালো বেতনের চাকরি,ফিক্সড ডিপোজিট, ব্যাংক ব্যালেন্স,নিশ্চয়তার জীবন সব ছেড়ে ছুড়ে যে মানুষটা শুধুমাত্র নাটকের জন্যে, শিল্পের জন্যে এই শহরে পড়ে রইলেন। তাঁর প্রতিদান অামরা দিয়েছি শিল্পকলা নির্বাচনে ভোটের বাক্সে।

সেদিন পরাজিত হয়েছিলো কে??
এই প্রশ্নের উত্তর অামার কাছে খুব সহজ।

সেদিন পরাজিত হয়েছিলো শিল্প। সেদিন পরাজিত হয়েছিলো পাবলিক লাইব্রেরির মাঠ,শহীদ সুভাষ হল,শহীদ মিনারের লাল ইট।

সেদিন পরাজিত হয়েছিলো নীল সমুদ্রের ঝড়,টু-ইডিয়েটস,বৃত্তের বাইরে কিংবা বাঁধ ও বিশ্বাসের দ্বন্ধ।

অামি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি অামি শিল্পকলার সদস্য ছিলাম না। এবং অামার ভোট প্রদানের অধিকার ছিলো না।
স্বপন ভট্টাচার্য কে ভোটের মাঠে দাঁড় করানোটা এক ধরনের বালখিল্যতা। যারা প্রার্থী বানিয়েছিলেন তাদের সমীকরনটা অামি এখনো বুঝতে পারি না।
কিন্তুু দাদার হেরে যাওয়ার খবর শোনার পর অামার অশান্ত মন দ্বারস্থ হয়েছিলো শেক্সপিয়ারের কাছে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বললেন-

“পুরো দুনিয়াটাই একটা রঙ্গমঞ্চ,
আর প্রতিটি নারী ও পুরুষ সে মঞ্চের অভিনেতা;

এই মঞ্চে প্রবেশ পথও আছে আবার বহির্গমণ পথও আছে,
জীবনে একজন মানুষ এই মঞ্চে অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন”

দাদাও হয়তো একবার অভিনেতা হিসেবে অাপনাদের কাছে হাজির হয়েছিলেন। অাপনারা নির্দেশক স্বপন ভট্টাচার্যকে গ্রহন করেছেন।

অভিনেতা স্বপন ভট্টাচার্য???
অভিনেতা হিসেবে অাপনারা দাদাকে কতটুকু গ্রহণ করেছেন এই প্রশ্নটা অাপনাদের কাছেই রাখলাম।

আসলে বাস্তবকে এড়িয়ে জীবন হয় না। মঞ্চে সেই জীবনকে কিংবা সময়ের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে অপ্রিয় সত্যকে সামনে এনে দাঁড় করাতে হয়। দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্না, ঘাত-প্রতিঘাত, সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটে মঞ্চে। জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া ছোট ছোট গল্পগুলোই অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে দর্শকদের মাঝে ছড়িয়ে দেন একজন নাট্য নির্দেশক।

মঞ্চের ঘেরাটোপে দর্শক দেখেন শুধু কিছু মানুষের আগমন ও প্রস্থান। দর্শকের দেখাটুকু কখনই শুধুমাত্র নাটক নয়, গোটা একটা জীবন। থিয়েটার মানুষের গতির, অনুভূতির,রিক্ততা কিংবা ব্যর্থতার সমস্ত পরিস্থিতির দায় থেকেই জন্ম নেয়। অার একজন নাট্যকার অামার অাপনার না বলা কথা,মনের অব্যক্ত কষ্ট কিংবা সুখের বহিঃপ্রকাশ ঘটান মঞ্চে।

যে চোখে চোখ রেখে অাপনি অাপনার না বলা গল্প মঞ্চায়িত হতে দেখেন। তাঁর শুধুই কি গল্প বলার দায়??

অভাবের খরা ও ভালোবাসার বন্যা – দুই-ই থাকে স্বপনদার চোখে। কিন্তু বাস্তবতা ও সময়ের তাগিদ দাদার চোখের খরার দিকটিই বেরিয়ে এসে পোড়ায় অামাদের।

তাই হয়তো নাট্যকার বাদল সরকার খুব দুঃখ নিয়েই বলতেন, “সাহিত্যের জগতে নাটক ব্রাত্য হয়ে আছে। হয়তো কিছুটা বিনোদন ব্যবস্থার চাহিদা মেটায় তার বাইরে কিছু নয়।”

-সদস্য, থিয়েটার আর্ট কক্সবাজার।