শান্তারাম (২)

প্রকাশ: ৮ নভেম্বর, ২০১৯ ১০:৫১ , আপডেট: ৮ নভেম্বর, ২০১৯ ১০:৫২

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


(ইংরেজী থেকে অনুবাদ)

Md Max

বইটিকে ঠিক কোন ধারার বইয়ের কাতারে ফেলা উচিত তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে।

পড়ার পর আমার মনে হবে আসলেই তো, কী নেই এখানে! জীবন, দর্শন, তত্ত্ব, ধর্ম, নারী, মাদক, যুদ্ধ, অপরাধজগৎ, অন্ধকার, আলো সবকিছু নিয়েই মোটের উপর উপন্যাস হিসেবেই বাজারে প্রচলিত।

অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের কোবার্গ শহরে অবস্থিত ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন ‘পেন্টরিজ’। গল্পের মূল চরিত্র একসময় ছিলেন হিরোইনে আসক্ত একজন ব্যাংক ডাকাত, তার ১৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, আর তাকে রাখা হয় এই জেলখানায়। সেখান থেকে দিনে-দুপুরে দেয়াল টপকে পালিয়ে ভারতে আসেন। তারই জবানীতে পুরো উপন্যাসের যাত্রা, যেখানে প্রতিটা সংলাপে আপনি পাবেন ভিন্ন মাত্রা। ঘটনাক্রমে পরবর্তী দশ বছরে তিনি হয়ে উঠেন, অস্ট্রেলিয়ার মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান। Lindsay Ford নামে নকল পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে আসলেও পরবর্তীতে বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি লীন বা শান্তারাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

অপরাধী হিসেবে জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় তিনি লীন থেকে শান্তারাম কীভাবে হয়ে উঠেন সেই যাত্রার বর্ণনা উঠে আসে উপন্যাসে। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে তার মানবিক পরিবর্তন ঘটে, সাথে ঘটে আত্মিক উন্নতি। যাদের সংস্পর্শে এ সকল পরিবর্তন ঘটে এই উপন্যাসে, কিংবা বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ডে, কোনোটিতেই তাদের ভূমিকা কম নয়। তবে তার আগে বোম্বে’র বস্তিতে বসবাসরত সাদা চামড়ার মানুষ লীন কীভাবে বস্তির মানুষের সাথে মিশে যায়, মারাঠি ভাষা শিখে, এসবের দৈনন্দিন নিটোল বিবরণ শুনতে শুনতেই গল্প জমে যাবে।

এই উপন্যাসের৩ টি পার্ট আমি প্রথমবারের মত সিবিএন পাঠকদের জন্যে বাংলা অনুবাদ করেছি।

যেহেতু বইটি প্রায় ৯৩০ পৃষ্ঠার তাই আমি খুব আলোচিত ২ টি অংশের সাথে এ-র শুরু টি আর জেল থেকে পালানোর পর্বটি অনুবাদ করেছি।

পর্ব ২০

কলাবা পুলিশ স্টেশনের প্রথম ফ্লোরের স্টিলের গেইটের পরে একটি করিডোরের ভেতর দিয়ে ৪ টি রুমই পাশাপাশি। এর একদিক দিয়ে ঢুকার প্রবেশ মুখ আর অপর দিকে লোহা দিয়ে ঢাকা পুলিশ কম্পাউন্ড। নীচে অনেক সেল আছে। আমি যখন সেখানে ঢুকলাম মনে হলে নরকের এন্টিচেম্বারে ঢুকেছি।
স্টিল গেইট ছাড়া আর কোন রুমে দরজা নেই, প্রবেশ মুখ খুবই ছোট, একেকটি রুম সর্বোচ্চ ৩ মিটার, করিডরে হাটঁতে দুজনের কাধে কাধ লেগে যায়, আর করিডরটি প্রায় ১৬ মিটার লম্বা।
করিডরের শেষ প্রান্তে টয়লেট আর প্রসাবখানা, কোন দরজা নেই, একটি মাত্র পানির টেপ।
করিডরে আর রুমে মিলে কোনরকমে কষ্ট করে ৪০ জনের মত থাকা যাবে, যখন আমি প্রথম সকালে ঘুম থেকে উঠলাম, বুঝতে পারলাম আমরা প্রায় ২৪০ জনের মত কয়েদি৷
এটি যেন উইপোকার একটি মৌচাক, সব মানুষ আর মানুষের হামাগুড়ি, যুদ্ধে লিপ্ত সবাই, কাদাকাদা করে, একে অপরেকে ঠেলে জায়গা করে নেওয়ার প্রতিযোগিতা, হাটু বা কনুই নাড়ার কোন সুযোগ নেই।
টয়লেট প্রায় গোড়ালি পর্যন্ত মলে পরিপূর্ণ। প্রসাব বয়ে করিডরে এসে গেছে। প্রচন্ড গন্ধ আর জল করিডরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে।
বর্ষাকালের ভারী আদ্রতা, মানুষের চিৎকার, গোংগানী , কথাবার্তা, অভিযোগ, বিকট শব্দে কয়েকঘন্টা পরপর একেকজন পাগল হয়ে যায়। আমার সেখানে থাকতে হয়েছিল ৩ সপ্তাহ।

চার রুমের প্রথমটিতে যেখানে আমি আমার একটি মাত্র রাত কাটিয়েছিলাম, মাত্র ১৫ জন কয়েদি থাকেন। এটি টয়লেট থেকে সবচেয়ে দুরে বলে গন্ধ অনেক কম, কিছুটা পরিস্কার।

ঘুমানোর মত জায়গাও পাওয়া যায়।
এখানকার কয়েদিরা সবাই ধনী, যারা পুলিশকে অর্থ দিয়ে নতুন কাউকে সেই রুমে ঢুকতে বাধাগ্রস্ত করতে মারধর করে যদি তারা স্বেচ্ছায় আমন্ত্রণ না জানায়।
রুমটি ‘তাজমহল’ হিসেবে পরিচিত আর তার অধিবাসীদেরকে সবাই ‘১৫ রাজকুমার ‘ হিসেবে চেনেন।
দ্বিতীয় রুমটিতে ২৫ জন কয়েদিদের বসবাস। পরে আমি জানতে পারলাম এখানকার কয়েদিরা সবাই পেশাদার অপরাধী, যারা অতীতে একবার না হয় একবার কঠিন সাজা ভোগ করেছিলেন, যারা সবসময় নিজেদের রুমে জায়গা করে নিতে মারামারি করতে প্রস্তুত, সব নোংরামিতে ভরা আসামি।
তাদের রুমটি ‘ চোর মহল, হিসেবে পরিচিত আর এখানকার কয়েদিরা সবাই কালা টুপির মানুষ যেটি রনজিতের মত, কারন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা এই কালো টুপি পরতে বাধ্য।

তৃতীয় রুমটি ৪০ জনের মত কয়েদি থাকেন যারা প্রতিনিয়ত বসে থাকেন, দেওয়ালে পিঠ দিয়ে কাঁধে কাঁধ রেখে কোনরকম বসে থাকেন আর সামান্য পরিমাণ জায়গা পেলেই পা বাড়ানোর চেষ্টা করেন, তারা আবার দ্বিতীয় রুমের আসামিদের মত তত মারকুটে নন, কিন্তু সারাক্ষণ নিজের জায়গার জন্যে ফাইট করতে থাকেন আর নতুন যারা আসেন তাদের স্পেস না দিতে সজাগ থাকেন।

তারপরও প্রতিদিন তাদের কাউকে না কাউকেই নতুন পেশিবহুল কারও কাছে নিজের দখল করা জায়গা মারামারিতে হেরে ছেড়ে দিতে হয়।

যেহেতু এখানে সবসময় ৪০ জনের মত কয়েদি থাকেন তাই এটিকে বলা হয় ‘৪০ মহল’। আর চতুর্থ রুমটিকে জেলখানার ভাষায় বলা হয়, ‘ দুখের মহল’ আবার অনেকেই এটিকে পুলিশের দেওয়া নাম অনুযায়ী, , ডিটেনশন রুম’ ও বলেন।
যখন কোন নতুন আসামি প্রথম বার, স্টিলের গেইট পার হওয়ার পর, প্রথমেই রাজকুমারদের রুমে ঢুকার চেষ্টা করেন, তাৎক্ষনিক সবাই উঠে তাকে ধাক্কা, হুমকি দিয়ে ‘ পরের রুম, পরের রুম’ কুত্তার বাচ্চা বলে চিতকার করে বের করে দেন। করিডরে মানুষের ঠাসাঠাসিতে তিনি পরের রুমে ঢুকতে চাইলেই, কেউ তাকে না চিনলে, কেউ এসে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে, মুখে ঘুষি দিয়ে, পরের রুমে যা মাদারীচুত বলে বের করে দেন।
অনেক বকাঝকা খেয়ে লোকটা তৃতীয় রুমটিতে ঢুকতে চাইলেই দরজার পাশে বসা কয়েদি তাকে লাথি মেরে, পরের রুম, বাইঞ্চুত বলে বের করে দেন।
যখন সব রুম থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি শেষ প্রান্তের রুমে এসে পৌঁছেন, ডিটেনশন রুমের কয়েকজন তাকে সাদর সম্ভাষণ করে বলেন, আস বন্ধু, আস আমার ভাই।
যারা বোকা টাইপের, তারা সেখানে ঢুকার সাথে সাথেই ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি দল তাকে মেরে নগ্ন করে ফেলে, তার সব কাপড় কেড়ে নেওয়া হয়, কাপড় গুলো তাদের অপেক্ষমাণ তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়, আর লোকটার পুরো শরীরের প্রতিটি অংশ তল্লাশি চালানো হয় কোন জুয়েলারি, টাকা বা মাদকের খোঁজে।

দামী কিছু পেলেই তা চলে যেত ডিটেনশন রুমের রাজার কাছে, আমার থাকাকালীন সময়ে এই রুমের রাজা ছিলেন বিশালকার একলোক, মনে হয় তার কোন গলা নেই, গায়ে হাতে সব কেশ, পুরো চোখের ভ্রু।

নতুন লোকটাকে পচা একটি বস্তা পরিধান করতে দেওয়া হয়, যে বস্তা এতদিন আরও অনেকেই পরেছেন।
তখন লোকটার দুটো উপায় থাকে, হয় বাধ্য হয়ে, অসম্ভবভাবে থাকা ভীড় করিডরে যাও, না হয় ডিটেনশন রুমের গ্যাংদের সাথে থেকে নতুন শিকারের অপেক্ষায় থাক।
আমার ৩ সপ্তাহ থাকা কালে আমি যা দেখলাম, প্রতি ৫ জনের মধ্যে মারখাওয়া একজন দ্বিতীয় অপশনটা বেচে নিতেন।
করিডরে ও সবাই একটি নিয়ম মেনে থাকতেন, পা রাখারও জায়গা নেই, যারা সাহস করে টয়লেট থেকে দুরে প্রথম সারির দিকে থাকতে পারতেন তারা কিছুটা আরাম পেতেন।

কিন্তু টয়লেটের পাশে যেখানে সারাক্ষণ প্রসাব বেয়ে যায় আর মলে পূর্ণ থাকে, কদমার্ক্ত, গন্ধ্যে সয়লাব সেখানেও যুদ্ধ চলতে থাকে।

যে সমস্ত আসামিদের বাধ্য হয়ে গোড়ালি পর্যন্ত মলে দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন আর সারা রাত, শেষ পর্যন্ত অনেকেই ঢলে পরে গিয়ে মারা যান।
আমার থাকাকালীন সময়ে একজন লক আপেই মারা যান,আরেকজন মৃত্যুর এত কাছাকাছি চলে গেলেন যে তাকে শত চেষ্টা করেও জাগাতে পারিনি।
প্রতিটি মিনিট,ঘন্টা, দিন সবাইকে পাগলের মত চিল্লাতে দেখা যায় শুধুমাত্র এক মিটার জায়গা পাওয়ার জন্যে।
এটি মনে হয় যেন বিশাল এক এন্যাকুন্ডার পাকস্থলীতে আমরা সবাই, যতক্ষণ আছি বেঁচে থাকব আর না পারলেই স্টিলের থাবার মাঝে আমাদের পুরো জীবন সে গিলে ফেলবে।

প্রতিদিন বিকেলে ৪ টায় একবারেই আমরা খাবার পেতাম। ডালের সাথে রুটি অথবা ভাতের সাথে সামান্য ঝোল। সকালে চা আর সামান্য রুটি দেওয়া হত। কয়েদিরা দুটো লাইনে দাঁড়াতেন আর গার্ডরা খাবার পরিবেশন করতেন।
কিন্তু অনেক লোকের ভীড়ে, ক্ষুধার তাড়নায় প্রতিদিন বিশৃংখলা দেখা দিত, অনেকেই খাবার পেতেন না আর অনেকেই সারাদিন উপোষ থাকতেন।
আমাদের জেলে ঢুকানোর সময়ে সবাইক এলিমুনিয়ামের একটি করে প্লেট দেওয়া হয়েছিল, এটি ছিল আমাদের একমাত্র বৈধ সম্পত্তি।

কোন চামচ ছিলনা, আমরা হাত দিয়েই খেতাম, কাপ না থাকাতেই আমরা চাও প্লেটেই খেতাম।

কিন্তু প্লেট গুলোর অন্য ব্যাবহার ছিল।

তা হল, দুটি এল্যুমিনিয়ামের প্লেট কে যখন v আকারে সেট করা হবে, অপর প্লেটটি উপরে রেখে স্টোভ বানানো হয়, আর রাবারের স্যান্ডেল দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে চুলোই পরিনত করে চা বা খাবার গরম করা হয়।
ডিটেনশন রুমে এই কাজ প্রতি রাতেই চলে, এতে পুরু রুমে ধোঁয়া হয়ে যায় সবার চোখেমুখে তা এসে লাগে।
এই স্টোভ ডিটেনশন রুমের মাস্তানদের আয়ের উৎস, এক নাম্বার রুমের কয়েদিদের জন্য তারা টাকার বিনিময়ে চা গরম করে দিতেন,
গার্ডরা যারা টাকা দিতে পারতেন তাদের জন্যে দিনের বেলায় খাবার ঢুকাতেন কিন্তু রাতে কোনপ্রকার খাবার যেতনা, ঐ ১৫ জন রাজকুমার তাদের আরামের জন্যে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে কতকগুলা সসপ্যান, প্লাস্টিক বোতল আর কন্টেইনার আনতে সক্ষ্ম হয়েছিলেন, যখন রাতে খাবার বন্ধ থাকত তখন ও তারা রাত্রে গরম চা আর খাবারের স্বাদ নিতেন।
যেহেতু এই প্লেট গুলো কিছুদিন পরেই অকার্যকর হয়ে যেত তাই নতুন প্লেটের সবসময় চাহিদা থাকত, কারন এই প্লেট আর রাবার স্যান্ডেল ছিল আয়ের উৎস। দুর্বলরা সবসময় তাদের প্লেট, স্যান্ডেল আর খাবার হারিয়ে ফেলতেন।
যারা তাদের সাহায্য করতেন তারা খাবার দ্রুত শেষ করেই তা আরেকজনকে দিতেন, এমনকি ৪ জনকে একটি প্লেটে খেতেও দেখেছি, কেননা মাত্র ৬ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যেই গার্ডরা খাবার দিয়ে চলে যেতেন।
প্রতিদিন আমি ক্ষুধার্ত মানুষের চোখের দিকে থাকাতাম, তারা, অন্যরা কিভাবে খাচ্ছে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন।

তাদের মাঝে আতংক বিরাজ করত, পাছে, যদি তারা আজ মিস হয়ে যায়।

তাদের চোখ দেখলেই বুঝা যেত তারা কিভাবে নির্মম ক্ষিধেই কাতরাচ্ছে।
আমি তা অত্যন্ত মায়ার সাথে অনুভব করতাম যে, তাদের এই সমস্যার কোন সমাধান নেই।

আর প্রতিদিনই রাজকুমাররা ১ নাম্বার রুমে বসে ঘুমানোর আগে গরম চা, খাবার খেতেন যেটি, ডিটেনশন রুমে প্রস্তুত হত তাদের জন্যে।

এমনকি যখন রাজকুমার দের টয়লেটে যেত হত তাদের ও মারাত্মক আর মনুষ্যচ্যতি পরিস্থিতিতে যেত হত অন্য গরীব আসামীদের মত, কারণ এ ক্ষেত্রে সবাই সমান।
করিডরে মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ যা টয়লেট পর্যন্ত বিস্তৃত, যেটি দুর্গন্ধযুক্ত জলাশয়ে রুপান্তরিত হয়েছে।
এক্ষেত্রে ধনী কয়েদি কাপড়ের ছেড়া অংশ নাকে এঁটে দিতেন আর একটি সিগারেট নিতেন মুখে যাতে প্রচন্ড গন্ধ থেকে বাচা যায়, জুতো হাতে নিয়ে, হাঁটুর উপর প্যান্টের কাপড় তুলে টয়লেট সারতেন।
টয়লেট ব্লক না থাকারই কথা, কিন্তু প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন মানুষ তা ব্যাবহার করার কারণে তা পুর্ন হয়ে যায়।
মলের স্তুপ দিয়ে আমাদের কমেটে যেতে হয়, সাথে প্রসাবের পানি উপরে পরে।

তারপর ধনী কয়েদি হাত পা ধোয়ে তাদের প্রবেশপথে রাখা বস্তার উপর পা মুছে রুমে ঢুকেন।

মাঝে মাঝে দেখা যায় অর্ধেক সিগারেটের জন্যে অনেকেই ধনী কয়েদির পা টয়লেট ব্যাবহার করার পর বস্তা দিয়ে মুছে দেন।

প্রথম সকালে যখন আমি তাদের রুমে ছিলাম রাজকুমাররা আমাকে বিদেশি দেখে ধনী মনে করে তাদের সাথে থাকার অফার দিয়েছিলেন ।
কিন্তু এই অফার আমাকে মানসিক ভাবে হেয় করেছিল, কেননা, আমি সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনে মোড়ানো পরিবারে বেড়ে উঠেছি, আর আমার এই জেদ, অগ্রাহ্যতা আর অনুভূতি আমার পারিবারিক ভাবে পাওয়া।

আমার এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমার খুব কম বয়স থেকেই পাওয়া৷

আমার এই দৃঢ়প্রত্যয়ের বীজ আমার মা আমার মাঝে বুপন করেছেন।

তাছাড়া আমি শহরে গরীবদের সাথে অনেকদিন বস্তিতে ছিলাম তাই আমি তাদের এই অফার প্রতাখ্যান করলাম।
আমি আমার সাময়িক আরাম কে বিসর্জন দিয়ে আমার পেশির শক্তি দিয়ে দ্বিতীয় রুমে ভয়ানক কয়েদিদের মাঝে ঢুকে গেলাম।
শুরুতেই দরজায় একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল পরে যখন তারা বুঝতে পারল আমি নাছোড়বান্দা তারা তখনই আমাকে জায়গা করে দিলেন । তারপরেও সেখানে কালা টুপির মানুষ ছিল যারা ছেড়ে কথা বলেনা, তারা আমাকে পরীক্ষা করার একটা ব্যাবস্থা করলেন।
আমার গ্রেফতারের ৩ দিনের মাথায়, টয়লেট থেকে ফেরার পথে একজন আসামি আমার কাছে থেকে প্লেট কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
আমি তাকে চিতকার করে হুশিয়ারি করে দিলাম আর যতসম্ভব হিন্দি আর মারাঠি ভাষায় অকথ্য, আমার শব্দভান্ডারে যা আছে তা দিয়ে গালি দিলাম।

কিন্তু সে থামার পাত্র নয়। লোকটা আমার চেয়েও লম্বা আর প্রায় ওজনে ৩০ কেজি বেশি।
সে আমার প্লেট নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, আমিও টানছি, কেউ কারও কাছে থেকে নিতে পারছিনা।
রুমে সবাই নীরবে দেখছে।
তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস আমাদের গায়ে এসে লাগছে, এটি এমন এক পরিস্থিতি ছিল যে, জিত না হয় মর।

আমি নিজেকে আস্তে আস্তে করিডরের কোনায় পচা নর্দমায় নিয়ে গেলাম।
তাকে প্লেটটি ধরতে দিয়ে আমি তার নাকে আমার মাথা দিয়ে ৫ থেকে ৭ বার প্রচন্ডভাবে আঘাত করলাম আর যখন সে তখনও টানতে চেষ্টা করছে আমি তার চিবুকে আঘাত করলাম।
এলার্ম বেজে উঠল আর অনেকেই এসে আমাদের সরাতে লাগল।
অন্যান্য লোকদের কারনে আমি হাত দিয়ে তার নাগাল পাচ্ছিলাম না বলে প্লেট টি ধরে রাখতে আমি তার মুখে কামড় দিলাম,

তার চিবুক ফেটে গেল আর তার রক্ত আমার মুখে।

সে প্লেট ছেড়ে দিয়েই চিতকার করে উঠল ।
সে পাগলের মত সব মানুষ ঠেলে ষ্টীলের গেইটের দিকে পালাল, আমি তাকে পেছন থেকে আটকাতে আটকাতে সেখানে গেলাম, সে তখন লোহার গ্রিলে সাহায্যের জন্যে ডাকতে লাগল।
আমি তাকে ধরে ফেললাম আর ওয়াচম্যান ততক্ষণে চাবি হাতে।

তার গেঞ্জি ছেড়া আর তখন সে কাপছে, আমি তাকে ধরার সময় সে গেঞ্জিটাই খুলে ফেলল আর ভয়ে ওয়াচম্যানের পেছনে আশ্রয় নিল দেওয়াল পিঠ ঠেকিয়ে।

তার নাকে মুখে আর পুরু শরীরে রক্ত বয়ে যাচ্ছে। পরে দরজা বন্ধ হল আর , পুলিশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন আর মুচকি হাসি দিলেন।

আমি তার ছেড়া গেঞ্জি দিয়ে মুখ আর প্লেট মুছলাম।

খুব খুশি মনে আমি গেইটের পাশেই গেঞ্জি ছুরে মারলাম।
তারপর সোজা চোরের রুমে নীরব দশর্কের মাঝে চলে আসলাম।
‘ কি খেলা দেখালে’ , আমার পাশে বসা তরুনটি ইংরেজিতে বলে উঠল।
‘ তেমন পারিনি, আমি তার কানে আঘাত করতে চেয়েছিলাম’।
বাবা, তার ঠোঁট চেপে বলল সে, তাও ভাল খাবার হত, আমাদের এখানে যা দিচ্ছে তার তুলনায়।

তোমার মামলা কি? আমি জানিনা, তুমি জাননা?
তারা একরাত্রে আমাকে ধরে এখানে নিয়ে আসল, আর বলেনি এর কারণ বা আমি এখানে কেন।
আমি তাকে তার মামলা কি জিজ্ঞেস করিনি কারন, আমি যখন অস্ট্রেলিয়ার জেলে ছিলাম সেখানে শিখেছি যে, ‘ তুমি কাউকেও তার অপরাধের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবেনা যতক্ষন না তাকে তুমি বন্ধু হিসেবে পছন্দ কর অথবা যতক্ষণ না তাকে শত্রু হিসেবে ঘৃণা কর।
‘তারা ত তোমাকে ভালোই ধোলাই দিল, যেটিকে এরোপ্লেন বলা হয়’ ।

বল না ভাই, আমি এরোপ্লেন ঘৃণা করি, তারা একবার আমাকে খুব জোরে বাধল আর আমার শুধু বাহুর অনুভূতি ফিরে আসতে ৩ দিন লেগেছিল।
আর তুমি ত জান রশিতে বাধলে কিভাবে শরীর ফুলে যায়, যখন তোমাকে এভাবে ওরা মেরেছিল তাইনা?
আমার নাম মহেস, আর তোমার ?
আমাকে সবাই লিন বলে ডাকে। লিন?
হ্যা। মজার নাম, তুমি এত মারাঠি কিভাবে শিখলে যখন ঐ লোকটা কে মারার আগে গালি দিয়েছিলে?
গ্রামে।
নিশ্চয়ই খুবি শক্ত গ্রাম।
আটকের পর এই প্রথম বার আমি একটু হাসলাম, কারন জেলে একজন মানুষ তার হাসিটা কে ভাগ করেই হাসেন, যেমন, শিকারী মানুষ তার হাসিকে দুর্বলতা মনে করে, দুর্বলরা মনে করে এটি একটি আমন্ত্রণ আর গার্ডরা দেখে এটিকে যন্ত্রণার একটি প্ররোচনা হিসেবে।

‘ আচ্ছা এখানে আসামিদের কতদিন রাখা হয়? মহেসের কালো মুখে চিন্তার ভাজ পরল, তার চোখেও রাজ্যের হতাশা এবং সেও পরিত্রাণ খুজে ফিরছে।
‘ এব্যাপারটা কেউ জানেনা এখানে, সে তার চোখ ছোট করে বলল, যেমটি প্রভাকর করে, এখানে এসে আমি আমার ঐ বন্ধটাকে খুব মিস করছি।
আমিও তোমার আসার ২ দিন আগে এসছি, শুনলাম আমাদের সবাইকে ট্রাকে করে রোডে নিয়ে যাবে।
রোডে? আরে আরথার রোড জেইল আর কি।
আমার যেভাবে পারি একজনকে খবর পাঠাতে হবে।
এজন্যে তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে লিন, কারন পুলিশ, গার্ড আমাদের সবাইকে তোমাকে সাহায্য না করার জন্যে হুমকি দিয়ে গেছে।
তোমাকে মনে হছে কেউ অভিসম্পাত করেছে, তোমার সাথে কথা বলার কারনে আমাকে অনেক চাপে পরতে হবে, কিন্ত কি আর করা বন্ধু।

যেভাবেই হোক আমাকে খবর পৌঁছাতে হবেই এখান থেকে।
বললাম ত যারা এখানে থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তাদের কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না।
তারা সবাই ভীত যেমনটি গোবরার ফাদে ইঁদুর।

কিন্ত তুমি আরথার রোড জেলে খবর পাঠাতে পারবে, বড় জেল কোন সমস্যা নেই।

প্রায় ১২ হাজার কয়েদি সেখানে, সরকার যদি ও তা স্বীকার করেনা, কিন্ত আমরা সবাই জানি যে ১২ হাজার।
তারপরও এখানকার চেয়েও অনেক ভালো।

সেখানে গেলে তুমি আমার সাথে থাকতে পারবে, আমার মামলা চুরি, কন্সট্রাকশন থেকে কপার আর তার চুরির অভিযোগ, ৩ বার হল জেল, এবার সহ ৪ বার একই কারনে।

কি আর করা দোস্ত, তারা বলে আমি নাকি সিরিয়াল চোর, ছিচকে চোর আইনে, ভাগ্য ভাল হলে ৩ বছর আর না হলে ৫ বছর।

আরথার রোড জেলে গেলে আমার সাথেই যাবে।
তারপর চেষ্টা করব যাতে তোমার বার্তা পাঠাতে পারি। ঠিক আছে? আর ততদিন পর্যন্ত আমরা প্রার্থনা করব আর আমদের প্লেট যারা কেড়ে নিতে চাইবে তাদের রক্ত পান করব।
এবং পরবর্তী ৩ সপ্তাহ আমরা তাই করলাম।
প্রতিদিন সিগারেট পান করছি, প্রার্থনা করছি আর নিজেদের টিকিয়ে রাখতে কলহে লিপ্ত হচ্ছি, আর যারা জীবনের আশা হারিয়ে ফেলছে তাদের আশা জাগাচ্ছি।

তারপর একদিন তারা আসল, আমাদের ফিংগারপ্রিন্ট নিল,একটি কালো কাগজে যেখানে শুধুমাত্র সত্য বলার অংগীকার আছে।

মহেস আর আমাকেও ধাক্কা মেরে একটি পুরাতন নীল প্রিজন ট্রাকে তুলল, আমরা প্রায় ৮০ জন যেখানে ৩০ জনের জায়গা সংকুলান হবেনা এই ট্রাকে, দ্রুত গতিতে আমাদের প্রিয় শহর ছেড়ে যাচ্ছে গাড়ি আরথার রোড জেলের দিকে।
তারপর জেল গেইটে আমাদের ধাক্কা মেরে নামাল আর বসার অর্ডার দিল, অন্য গার্ডরা প্রসেস করে, স্বাক্ষর নিয়ে ঢুকাতে লাগল।

এই কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ৪ ঘন্টা লাগল, আর দীর্ঘক্ষণ বসা থাকা আমি ছিলাম সবার শেষে।

গার্ডরা বলল, আমি মারাঠি জানি,তাই তাদের চীফ কমান্ডার আমাকে পরীক্ষা করলেন।

আমি যখন একা ছিলাম তিনি আমাকে উঠতে বললেন, আমি প্রচন্ড ব্যাথায় দাড়ালাম, আবার বসতে বললেন, আমি যখন বসতে গেলাম তিনি আবারও দাড়াতে বললেন।

তিনি এক হাস্যকর পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছেন অন্যান্য গার্ডদের সামনে, কিন্ত আমি তার কমান্ড আর মানিনি।
তিনি কমান্ড দিতেই আছেন তা আমি উপেক্ষা করছিলাম।

তারপর আমরা একে অপরের দিকে নীরবে থাকালাম যে নীরবতা আমি প্রিজনে বা যুদ্ধের ময়দানে জানি।

এই নীরবতা তুমি উপলব্ধি করতে পারবে, এই নীরবতার ভাষা আর গন্ধ তুমি অনুভব করতে পারবে।
চিফের হাসি ঘৃণায় রুপান্তরিত হল, আমার পায়ের দিকে তিনি থুথু ফেললেন।
‘ ব্রিটিশরা এই জেল তৈরি করেছিল, তারা আমাদের ভারতীয়দের মেরেছে, ফাসি দিয়েছে, শিকল পরিয়েছে, আর আমরা এখন এই জেল চালাই, তুমি একজন ব্রিটিশ কয়েদি’ ।
আমি খুন নম্র ভাবে বললাম, জনাব আমি ব্রিটিশ নয়, আমি নিউজিল্যান্ডের।
তিনি জোরে বললেন তুমি ব্রিটিশ।
জি না।
হ্যা তুমি ব্রিটিশ, সবাই ব্রিটিশ, তোমরা ব্রিটিশ আর আমরা এখন জেল চালাই, এই পথ দিয়েই যাবে।

তিনি জেলের ভেতরের পথ নির্দেশ দিলেন, একটু গিয়ে ডানে মোড়, আর আমরা সব পশুরা জানি যে সেখানে আমাদের জন্যে এক ভয়ানক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
গার্ড আমাকে ব্যাটন দিয়ে আমার পেছনে গুতু দিলেন আমি পথ দিয়ে হাঁটলাম আর ডানে মোড় নিলাম, প্রায় ২০ জনের মত সেখানে আমার অপেক্ষায় দন্ডায়মান লাঠি হাতে।
এই খেলাটা আমি অন্যান্য লোকদের চেয়েও বেশি জানি, কারন এরকম আরেকটি দেশে আরেকটি টানেল ছিল, পানিশম্যান্ট ইউনিট ছিল, যখন আমি অস্ট্রেলিয়ার জেল থেকে পালিয়েছিলাম।
গার্ডরা আমাদের সংকীর্ণ করিডর দিয়ে যেতে বাধ্য করালেন, ছোট একটি উঠোনে, আমাদের দৌড়ার সময়ে তারা সার্বক্ষণিক আমাদের ব্যাটন দিয়ে মেরে মেরে নিয়ে গেলেন ।
আমি আরথার রোড জেলে টানেলে দাড়ালাম আর হেসে বলতে চেয়েছিলাম , আচ্ছা তোমরা কি একটু অরিজিনাল হতে পারনা?
কিন্তু আমি কথা বলতে পারলাম না, কেননা, ভয় একজন মানুষের মুখ শুকিয়ে দেয় আর ঘৃণা তাকে গলা চেপে ধরে। তাই ঘৃণার কোন ভাষা নেই ভয়ের কোন শব্দ নেই।
আমি আস্তে আস্তে সামনে গেলাম, দেখলাম কতকগুলো কয়েদি সাদা শার্ট আর প্যান্ট পরা, সাদা টুপি তাদের মাথায়, কোমরে কালো চামড়ার বেল্ট, সেখানে লিখা ‘ সাজাপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক’।
তারা কিন্তু জেলের গার্ড নন, আমি পরে জানতে পারলাম যে, ভারতীয় জেলগুলোতে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রিজন গার্ডদের ভুমিকা কম ছিল।
প্রতিদেনের অপারশন, রুটিনবাঁধা কাজ আর শৃঙ্খলা সব দেখাশোনা করেন এই সাজাপ্রাপ্ত তত্বাবধায়করা।

তারাই তত্বাবধায়ক হবেন যারা কোন সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামি বা যাদের সাজার মেয়াদ ১৫ বছরের মত হয়েছে।

প্রথম ৫ বছর তারা সাধারণ আসামি, পরের ৫ বছর তারা বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ পান যেমন রান্নাবান্না, লন্ড্রি, ক্লিন আপ গ্যাংস ইত্যাদি।
পরের ৫ বছর তারা তত্বাবধায়ক এর দায়িত্ব পান, তাদের টুপি, লাঠি আর চামড়ার বেল্ট দেওয়া হয়।

তাদের হাতেই আমাদের জীবন আর মৃত্যু ।
এই তত্বাবধায়ক দুটো দল আমার অপেক্ষায় দন্ডায়মান , তারা তাদের লাঠি তুললেন আর আমার দিকে চোখ রাখলেন।
তারা ভাবলেন আমি দৌড় দিব আর তারা মজা নিতে পারবেন না।
আমি কিন্তু দৌড়িনি, আমি আজ হয়ত বলতে পারতাম, আমি সেদিন সাহস আর সম্মানের কারনে তা করেনি, কিন্ত না তা আমি বলছিনা,
আমার ঐ দিনের হাটার কথা প্রায় হাজার বার মনে পরে, আর তখন আমি ভাবি, ( প্রত্যেক সাহসী কাজে একটি রহস্য থাকে) , কাদের ভাই একবার বলেছিলেন ‘ যে প্রত্যেক ঝুঁকি আমরা নিই তাতে যে রহস্য তাকে কখনো খোলাসা হবেনা’.
আমি আস্তে আস্তে তাদের দিকে গেলাম, আমি এই লম্বা পথের দিকে তাকালাম আর ভাবতে লাগলাম এটি সেই পথ যেটি হাজি আলি মাজারের দিকে গিয়েছে, এবং মসজিদ, যেটিকে চাঁদের আলোর সাগরে একটি জাহাজ যায় মনে হয়।
এই মাজারের দৃশ্য আর প্যাভিলিয়নের দুই পাশের জোয়ার বেয়ে যাওয়া শহরে আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য।
এটি আমার কাছে এমন এক সৌন্দর্য যা একজন ফেরেস্তা রাতে ঘুমানোর সময়ে তার প্রিয়তমা আসার মত।

তাই বলা যায় এই সৌন্দর্য আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আমি শহরের সবচেয়ে নোংরা আর অপরাধের রাজ্যও হেঁটেছি, প্রীতি আমার মনকে আছন্ন করে রাখে যেটি আমি টম্ব, সাগর সেই পথের মাঝে খুজে পায়।
লাঠির আঘাতে আমার হাত, পা, পিঠ ভেংগে যাচ্ছে, আমার মুখে মাথায় আর গলায়ও বারি পরছে।
তারা যত জোড়ে পারে আমাকে লোহার মেটাল দিয়ে মারছে মনে হচ্ছে আর আমার সারা শরীর বৈদ্যুতিক শক লাগছে যেন।

লাঠিগুলোর পশ্চাদ্ভাগ ধারালো, যেদিকে লাগছে কেটে যাচ্ছে।

আমার চেহারা আর হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

আমি যত সম্ভব আস্তেই হাটতে লাগলাম, আমি কাতরাচ্ছিলাম প্রতিটি আঘাতে কিন্তু আমি ভীরুদের মত হাত তুলিনি, আমি আমার হাত নিজের সাথের রাখার জন্যে জিন্সের প্যান্ট তুলছিলাম, প্রচন্ড শক্তির আঘাত কমে আসতে লাগল, এটি একেবারে কমে গেল যখন আমি শেষ লাইনে এসে দাড়ালাম।

এটি ছিল আমার জন্যে একপ্রকার বিজয় যখন দেখলাম তারা লাঠি নামিয়ে ফেলছে যখন আমি তাদের দিকে তাকালাম।
একজন সাজাপ্রাপ্ত অস্ট্রেলিয়ার কয়েদি আমাকে একসময় বলেছিলেন যে, ‘জেলে সত্যিকারের বিজয় হল যদি তুমি ঠিকে বেঁচে যাও’।
ঠিকে যাওয়া মানে বেঁচে থাকা নয়, তোমাকে মানসিক ভাবে শক্ত থাকতে হবে, যদি কেউ ভেংগে পরে যদি তার জামিনও হয়ে যায় তাহলে তার কোন মূল্য নেই।
এটি হবে সেই বিজয় যা তোমার শরীর যখন কোন ঝুঁকি নিবে।
ঘনীভূত হয়ে আসা সন্ধায় কয়েকজন গার্ড আর তত্বাবধায়াক আমাকে ডরমিটরি ব্লকে নিয়ে আসলেন।

বিশাল রুম, প্রায় ২৫ কদম লম্বা আর ১০ কদম চওড়া , উচু সেলিং এর রুম।
ছিল ছোট ছিদ্রের জানালা যেখান থেকে অন্যান্য ভবন দেখা যায়, সাথে স্টিলের বড় গেইট।
প্রবেশপথের দিকে ৩ টি পরিস্কার টয়লেট।
যখন গার্ডরা আমাদের রাতে দিয়ে গেলেন দেখলাম আমরা প্রায় ১৮০ জন আসামি আর ২০ জনের মত তত্বাবধায়াক।
এক তৃতীয়াংশ রুম তত্বাবধায়াকদের জন্যে বরাদ্দ থাকে।
তাদের নিজেদের পরিস্কার কম্বল আছে, তারা তা সবসময় সাজিয়ে রাখে আর অনেক কম্বল দিয়ে আরাম করে বিছানা তৈরি করে।
আর আমরা বাকিরা রুমের অবশিষ্ট যা আছে তাতে থাকি, দুই লাইন করে।
রুমের কোনায় আমরা আমাদের কম্বলগুলো নিলাম, কম্বল গুলো তাকে তাকে রুমের একপাশে সাজিয়ে রাখা হয়।
আমরা কাদাকাদা করে একটি কম্বলের উপর শুয়ে পরি আর আমাদের মাথা পাশের দেওয়ালে লেগেই থাকে, আর সারারাত লাইটগুলো জ্বালানো থাকে।

তত্বাবধায়াকরা আমাদের পায়ের অবস্থান দেখতে মাঝে মাঝে হাঁটতে থাকেন, তাদের সবসময় হুইসল থাকে যেটি তারা কোন বড় সমস্যা হলে বা তারা কোন ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাজায়।
পরে আমি লক্ষ্য করলাম তারা হুইসল দিতে তেমন চাই না, তাছাড়া তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না তেমন কাজ নেই।
আমাকে তারা মাত্র ৫ মিনিট সময় দিলেন আমার রক্ত ধুয়ে ফেলতে আর পরিস্কার টয়লেট ব্যাবহার করতে।
আমি যখন রুমে আসলাম তারা আমাকে তাদের একপাশে থাকার জন্য অনুরোধ করেন।

কোন সন্দেহ নেই তারা ভেবেছিলেন আমি সাদা চামড়া, নিশ্চয়ই টাকার স্বাদ আছে।

তাছাড়া আমি যখন তাদের আঘাতের সময় দৌড় দিইনি তারা এতেও নাড়া খেলেন।

যাইহোক আমি রাজি হয়নি, কেননা কিছুক্ষণ আগেই ত তারা আমাকে মারল, তারা এখন গার্ডে রুপান্তর হল, আমি তাদের অফার প্রত্যাখ্যান করলাম।

এটি বিরাট ভুল ছিল আমার জন্যে।

আমি কম্বল নিয়ে মাহিসের পাশে বসলাম তারা আমার দিকে হাসল আর ভেংচি কাটল।
তারা আমি কতৃক উপেক্ষিত হওয়াতে খুবই ক্ষেপে গেল আর আমার তেজঁদীপ্ততা নষ্ট করতে সবসময় প্রয়াস চালাত।
সকালে রাজ্যের সব ব্যাথা নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম, পিঠে প্রচন্ড ব্যাথা, পরে ছোট একটা কীটপতঙ্গ পেলাম যেটি ঘ্যানঘ্যান করে, আমি সেটা ফ্লোরে পরিক্ষা করার জন্যে রাখলাম, দেখতে কালো, ধুসর, গোলাকার আর অনেকটা শতপদী।

আমার হাতে তা মুছড়ে দিলাম, রক্ত ঝরল, এটি ছিল আমার নিজের রক্ত, আমাকে সে ঘুমানোর সময় কামড়িয়েছিল।

কিছুক্ষণ পরে বাজে গন্ধ পেলাম, এটি ছিল ‘কাদমাল’ এর সাথে আমার প্রথম মুখামুখি।
আরথার রোড জেলে এটি বেশি থাকে আর কেউ তার সাথে পারেনা।

তারা রক্তচোষা আর কামড় দেয়৷ তাদের কামড়ে শরীরের অংশ বিষাক্ত হয়ে যায়।

একরাতে ৩ থেকে ৫ বার, সপ্তাহে ২০ বার, মাসে কয়েকশো বার, কিছুতেই থামানো অসম্ভব।
আমি অবাক হয়ে এই কাদমালের দিকে তাকালাম, এত রক্ত কিভাবে সে আমার থেকে পান করল।
ঠিক তখনই
তত্বাবধায়াকদের মারের আঘাতে আমার কান ও ফুলে গেল।
আমার খুব রাগ হচ্ছিল, তখনই আমাকে মাহেস বিরত রাখল।
তত্বাবধায়াকরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল যতক্ষণ না আমি বসে পরি৷
সে যখন চলে গেল তখনই মাহেস আমাকে মৌখিক ভাবে হুশিয়ারি দিল।
আমরা ঘুমানোর সময় একজনের পা আরেকজনের সাথে লেগে যায়, দুরত্ব তেমন থাকেনা।
মাহেসের চোখে ভয় আর উৎকন্ঠা দেখলাম আমি খুব কাছে থেকেই।

‘ তারা যাই করুক না কেন, প্লিজ তোমার জীবনের বিনিময়ে হলেও তাদের পাল্টা কিছু বলো না’, এটি থাকার জায়গা নই লিন, আমারা সবাই এখানে মৃত, তুমি কিছুই করতে পারবেনা ‘।
আমি আমার চোখ আর হৃদয় বন্ধ করলাম আর ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।