মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজার জেলার বিচারবিভাগে দু’টি মেধাবী দম্পতি একই কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ক্ষমতার সমতা বিধানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। শুধু তাই নয়, এ দু’টি দম্পতি পরস্পর স্বামী-স্ত্রী হওয়া সত্বেও একে অপরের পরিপূরক হিসাবে সবক্ষেত্রেই কাজ করে যাচ্ছে কোন জেন্ডার ভেদাভেদ ছাড়াই। পূরুষ শাসিত এ দেশের দীর্ঘদিনের গড়ে উঠা সামাজিক সংস্কৃতিতে তাঁরা বিশ্বাসী ও অভ্যস্থ নয় মোটেও। নারীকেই শুধু গৃহস্থালির কাজ করতে হবে, সন্তানকে লালনপালন করতে হবে, এদেশে দীর্ঘদিনের গড়ে উঠা এমন কুসংস্কৃতি তাদের কাছে হার মেনেছে। দু’দম্পতিই প্রায় সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বিচার বিভাগের চাকুরীতে যোগদান করেছেন।

এই দু’টি বিচারক দম্পতির একটি হচ্ছেন-কক্সবাজার জেলা জজশীপের সিনিয়র সহকারী জজ (সদর) আলাউল আকবর ও তাঁর সহধর্মিণী কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর অধীন ৪ নম্বর আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্।

অপর বিচারক দম্পতিটি হচ্ছেন-কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রসীর অধীন ১ নম্বর আদালত, দ্রুত বিচার আদালত ও বন আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ দোলয়ার হোসেন শামীম ও তাঁর সহধর্মিণী একই ম্যাজিস্ট্রেসীর অধীন ২ নম্বর আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জেরিন সুলতানা। বিস্ময়কর বিষয় হলো এদের মধ্যে তিনজনেরই স্থায়ী নিবাস হচ্ছে-চট্টগ্রাম জেলায় এবং অপরজনের চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়।

কক্সবাজার জেলা জজশীপের সিনিয়র সহকারী জজ আলাউল আকবরের গর্বিত পিতার নাম আবুল কাশেম। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন গুনী শিক্ষক ও সমাদৃত অভিভাবক। তাঁর মাতা শাহানারা বেগম একজন রত্নগর্ভা। ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার প্রত্যাশা ছিলো তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত। সে প্রত্যাশার সর্বোচ্চ সফলতা পেয়ে রত্নাগর্ভা মহিয়শী নারী শাহানারা বেগম। আলাউল আকবরের গ্রামের বাড়ি ব্রাম্মনবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার মিরপুর গ্রামে।

আর বিচারক আলাউল আকবরের সহধর্মিনী হচ্ছেন-কক্সবাজারের ৪ নম্বর আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ এলাকার তামান্না ফারাহ-র সাথে আলাউল আকবরের বিয়ে হয় ২০১০ সালের ৭ মে। আলাউল আকবর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে সম্মান সহ কৃতিত্বের সাথে এল.এল.এম ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তামান্না ফারাহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের দশম ব্যাচের কৃতি ছাত্রী ছিলেন। প্রখর দূরদর্শী ও অত্যন্ত মেধাবী তামান্না ফারাহ্ সম্মান সহ এল.এল.এম পাশ করেছেন রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে। ছাত্রজীবনে প্রথম বেঞ্চের শিক্ষার্থী ছাড়াও তিনি তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তামান্না ফারাহ্ শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক সহ জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) চতুর্থ ব্যাচে দু’জনই কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে একই সঙ্গে ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারী সহকারী জজ পদে সরকারি চাকুরী জীবন শুরু করেন। সিনিয়র সহকারী জজ আলাউল আকবরের জম্ম ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। আর একই বছরের ৯ মে তামান্না ফারাহ্ এর জম্ম। চাকুরী জীবনের প্রথম যোগদান মৌলভীবাজার জেলায় জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। এরপর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় নেতা তৈরীর কারখানা হিসাবে খ্যাত কিশোরগঞ্জ জেলা জজশীপে সিনিয়র সহকারী জজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তামান্না ফারাহ কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রসীতে যোগ দিয়ে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কক্সবাজার-৪ নম্বর (সদর) আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পাললন করছেন অদ্যাবধি। প্রায় একই সময়ে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থেকে বদলী হয়ে তামান্না ফারাহ্ এর স্বামী আলাউল আকবর কক্সবাজার জজশীপে যোগ দেন। একজন দ্রুত বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা ডায়নামিক বিচারক হিসাবে কর্মক্ষেত্রে সুনাম রয়েছে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্’র। নান্দনিক ও নিপুন অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্ এর জুড়ি মেলা ভার। বিচারক আলাউল আকবর এবং তামান্না ফারাহ্ বিচারক দম্পতির মুকুট ও নুসাইবা নামক ফুটফুটে চোখ জুড়ানো ২ কন্যা সন্তান রয়েছে।

অপরদিকে, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীম চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ থানার আহমদ মিয়া প্রাইমারি স্কুল লেইনের ১১৩/এ, শুলকবহর এলাকার বাসিন্দা। তাঁর পিতার নাম-মরহুম ফরহাদ হোসেন, মাতা-আয়েশা আক্তার। তিনি ১৯৮৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জম্মগ্রহন করেন। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীম কৃতিত্বের সাথে এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন চট্টগ্রাম শহরের প্রবর্ত্তক বিদ্যাপীঠ থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১১ তম ব্যাচে এলএলবি ও এলএলএম করেছেন অত্যন্ত সফলতার সাথে। অত্যন্ত সজ্জ্বন, অমায়িক হিসাবে সবার কাছে পরিচিত দীর্ঘদেহী মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীম জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) চতূর্থ ব্যাচের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বিচার বিভাগের একজন গর্বিত সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসাবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাঙ্গামাটি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর সরকারি চাকুরীতে প্রথম যোগদেন। এরপর ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদে সুনামগঞ্জ, সিলেট ও পূণরায় সুনামগঞ্জের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে দায়িত্ব পালন করছেন সততা ও সুনামের সাথে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর অসাধারণ মেধা ও প্রতিভাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীম কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে বদলী হয়ে আসেন। তখন থেকে অদ্যাবধি কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর ১ নম্বর আদালতের বিচারক হিসাবে কর্মরত আছেন। বিচারিক জীবনে তিনি আইন ও বিচার সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীম ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর জীবনসঙ্গিনী হিসাবে বেচে নিয়েছিলেন বিচার বিভাগীয় তৎকালীন নবীন কর্মকর্তা জেরিন সুলতানাকে। জেরিন সুলতানা চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার পূর্ব উরকির চর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী লাল মিয়া চৌধুরী বাড়িতে ১৯৮৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জম্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা হচ্ছেন-মরহুম জামাল উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা গুলনাহার। বিচারঙ্গনে অত্যন্ত সুনামের অধীকারী জেরিন সুলতানা চট্টগ্রাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইসএসসি পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। এরপর চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফলতার সাথে এলএলবি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। খুবই দক্ষ ও মেধাবী বিচারক জেরিন সুলতানা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন (বিজেএসসি) এর পঞ্চম ব্যাচের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। অসাধারণ গৌরব অর্জন করেন বিচার বিভাগের একজন সদস্য হয়ে। বিচারক হয়ে সহকারী জজ হিসাবে প্রথম যোগদেন কুমিল্লা জেলা জজশীপে। এরপর সিলেট চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে এবং সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সুনামগঞ্জ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে দায়িত্ব পালন করছেন সততা ও দক্ষতার সাথে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর তিনি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে যোগদান করেন। দক্ষ ও মেধাবী বিচারক জেরিন সুলতানা তখন থেকে অদ্যাবধি কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর ২ নম্বর আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিচারক মোঃ দেলোয়ার হোসেন ও বিচারক জেরিন সুলতানা দম্পত্তি ফুটফুটে প্রাণজুড়নো জুহাইরা হোসেন মেহরিস নামক এক কন্যা সন্তানের জনক ও জননী।

এই ২ বিচারক দম্পতি কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের শুধু ক্ষমতার সমতা বিধানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নয়, কর্মক্ষেত্রে একই বিভাগে একই প্রকৃতির কর্মে নিরন্তর কর্মরত থাকা উদাহরণ যোগ্য দু’টি সফল দম্পতিও। এই ৪ জন বিজ্ঞ বিচারক নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলছেন প্রতিনিয়ত। যেন সবার মাঝে “সেরাদের সেরা” হওয়ার নিরব এক প্রতিযোগিতা। অপ্রতিরোধ্য এ প্রতিযোগিতা যেন থামবার নয়। যাঁদের কর্মক্ষেত্র, সামাজিক ও পারিবারিক জীবন এদেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত, প্রেরণা ও প্রত্যয়ে সমৃদ্ধ করছে। জীবনযুদ্ধে হার নামানা অদম্য গতিতে অবিচল এগিয়ে চলা এ ২ বিচারক দম্পতি যেন আমাদের নতুন প্রজম্মের জন্য এক আদর্শ ও দুরন্ত সাহসের এক বাতিঘর।