বিদেশ ডেস্ক:

ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের পরিস্থিতি সরেজমিনে ঘুরে দেখতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ২৭ জন সদস্য মঙ্গলবার সেখানে পৌঁছেছেন। দিল্লির পক্ষ থেকে কাশ্মির সফরের আমন্ত্রণ পাওয়া এই ২৭ জনের মধ্যে ২২ জনই বিভিন্ন কট্টর দক্ষিণপন্থী দলের রাজনীতিক। উগ্র ইসলামবিদ্বেষী ও অভিবাসীবিদ্বেষী অবস্থানের জন্য তাদের আলাদা পরিচিতি রয়েছে। কাশ্মিরে পা রাখার আগেই দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও দেখা করে এসেছেন তারা। এই সফরকে অবশ্য তাদের ‘ব্যক্তিগত সফর’ হিসেবেই বর্ণনা করা হচ্ছে। কেননা, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের এ সফর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে নয়। আর শেষ মুহূর্তে এই সফর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া একজন ব্রিটিশ এমইপি (মেম্বার অব ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট)-ও এ সফরকে একটি প্রচারণার কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

ভারতের বিরোধী দলগুলো প্রশ্ন তুলেছে, যেখানে ভারতের বিরোধী নেতাদেরই কাশ্মিরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, সেখানে কিভাবে এই এমইপি-রা অঞ্চলটি ঘুরে দেখার অনুমতি পেলেন?

বস্তুত মাস-তিনেক আগে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর এই প্রথম ভারত সরকার সেখানে কোনও বিদেশি প্রতিনিধি দলকে পা রাখতে দিলো। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এদের বেশিরভাগই কোনও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নন; বরং তারা উগ্র মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত। ২৭ জনের মধ্যে ২২ জনই বিভিন্ন কট্টর দক্ষিণপন্থী দলের হয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ফ্রান্সে জঁ মারি লঁ পেনের প্রতিষ্ঠিত দলের ছয় জন, পোল্যান্ডের একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের পাঁচ জন, যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট পার্টির চারজন এবং ইতালি, জার্মানি, চেক প্রজাতন্ত্র, বেলজিয়াম ও স্পেনের কট্টর দক্ষিণপন্থী দলগুলোরও এক বা একাধিক সদস্য রয়েছেন এই প্রতিনিধি দলে। আর এই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অভিবাসনবিরোধী নীতির জন্য, কয়েকটি তো আবার তীব্র ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য-বিবৃতির জন্য পরিচিত।

দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পরই এই এমইপিরা বিমানযোগে কাশ্মিরের পথে যাত্রা করেন। দিল্লির বৈঠকে পাকিস্তানের নাম না নিয়েই মোদি বলেন, সন্ত্রাসবাদকে যেসব দেশ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে অনুসরণ করছে তাদের জন্যই গণতন্ত্র আজ হুমকির মুখে। ভারত ও ইউরোপ উভয়েই তার ভুক্তভোগী।

প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য যুক্তরাজ্যের লিবারেল ডেমোক্র্যাটস দলের রাজনীতিক বিল নিউটন ডান বলেন, আমি চাই কাশ্মিরের বাস্তব পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে, সেখানকার স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। কাশ্মিরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি দ্রুত ফিরে আসুক। মানুষ ভালোভাবে দিন কাটাক। এটিই সবার প্রত্যাশা।

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে শ্রীনগরের দুইটি হোটেলে ইউরোপীয় এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় নেতার বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য এই এমপিদের কাশ্মির ঘুরে দেখানো হয়েছে অনেকটা সরকারি গাইডেড ট্যুর-এর মতো করেই।

বর্তমানে গৃহবন্দি ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির মেয়ে ইলতিজা-র মতে, এই বিদেশি অতিথিদের সফরে কাশ্মিরের কোনও লাভ হবে না। তিনি বিবিসিকে বলেন, এই সফর তখনই অর্থবহ হবে যদি তারা মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাহ বা ফারুক আবদুল্লাহর মতো সাবেক মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। একইসঙ্গে এই মুহুর্তে কাশ্মিরে বন্দি থাকা শত শত রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা আনন্দ শর্মা এই সফর আপত্তি তুলছেন অন্য যুক্তিতে। তার বক্তব্য, যেখানে দেশের বিরোধী নেতাদের শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে এই বিদেশি এমপিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসে আসলে ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বেরই অমর্যাদা করা হচ্ছে। কাশ্মিরে সুশীল সমাজসহ সব পক্ষের সঙ্গে দেখা করার প্রথম অধিকার যে ভারতীয় রাজনীতিকদেরই; সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্যের লিবডেম পার্টি থেকে নির্বাচিত এমইপি ক্রিস ডেভিস জানিয়েছেন, সেনা পাহারায় নয়; কাশ্মিরে তিনি স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এটা জানানোর পরই ভারত সরকার তার কাছ থেকে সফরের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে নেয়। ফলে কাশ্মিরে এমইপিরা গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের সফর বিতর্ক থামানোর বদলে আসলে আরও উসকে দিচ্ছে। সূত্র: বিবিসি।