ডেস্ক নিউজ:

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন হচ্ছে প্রাকৃতিক এক লীলাভূমি। এ প্রবাল দ্বীপকে সংরক্ষণ করতে বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নেয়া হলেও প্রভাবশালীরা সে পদক্ষেপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে কৃত্রিম অবকাঠামো। যা প্রকৃতির জন্য যেমন হুমকি সাথে সাথে সেন্টমার্টিনের মতো একটি দ্বীপের জন্যও হুমকি।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্যকে প্রশাসন ইচ্ছা করেই ধ্বংস করছে। প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি চায় তাহলে এর সৌন্দর্য রক্ষা করা এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা সম্ভব। তাদের সদিচ্ছার কারণেই হচ্ছে না বলে তারা দাবি করেছেন।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালীরা প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য ধ্বংস করছেন প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে। তারা প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্যকে বাঁচাতে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ভাটার সময় সেন্টমার্টিনে জমির পরিমাণ আট বর্গকিলোমিটার আর জোয়ারের সময় পাঁচ বর্গকিলোমিটার। এর ওপরও চোখ পড়েছে দখলবাজদের। দ্বীপের রয়েছে তিনটি অংশ উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া আর দুই অংশের মাঝখানটা গলার মতো সরু বলে গলাচিপা নামে পরিচিত। এই তিন অংশের মাঝে উত্তর অংশ মূলত জনপদ। গলাচিপায় কিছু ভালো কটেজ, নৌবাহিনীর স্থাপনা আর কিছু স্থানীয় মানুষের বসবাস। নারিকেলগাছ আর আবাদি জমির বেশিরভাগই এ অংশে। দক্ষিণ অংশ এখন পর্যন্ত ‘রেস্ট্রিকটেড অ্যাকসেস জোন’ হিসেবেই পরিচিত। সেখানে পড়ে আছে বিশাল বিশাল প্রবাল পাথর।

দক্ষিণপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে শুধু জমি মালিকানার সীমানা আর সাইনবোর্ড। সীমিত প্রবেশাধিকার জোনের জমিগুলোও বিক্রি হয়ে গেছে। শত বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথর সরিয়ে মাটি বের করা হচ্ছে কটেজ বানানোর জন্য। শুধু তাই নয়, প্রবাল পাথরের টুকরাগুলো দিয়ে বানানো হচ্ছে প্লটের সীমানা প্রাচীর।

স্থানীয়রা জানান, পর্যটনশিল্প বিকাশের দোহাই দিয়ে ৯০ দশকের পর থেকে সেন্টমার্টিনে একের পর এক গড়ে ওঠে প্রাসাদ। সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ।

নির্দেশনা মতে, সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনো স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু প্রভাবশালীরা এই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গড়ে তুলছেন বড় বড় দালান।২০১৭ সালে ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) নামে কক্সবাজারের স্থানীয় একটি পরিবেশবাদী সংগঠন সেন্টমার্টিনের হোটেল-রিসোর্টের ওপর একটি জরিপ করে। সে জরিপে নির্মাণাধীনসহ ১০৬টি হোটেল-রিসোর্টের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। তারা কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন।

আবেদনে তারা জানায়, আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেন্টমার্টিন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপনা। বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি চলছে সরকারি স্থাপনার কাজ।

সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, সরেজমিন পরিদর্শন করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের নির্মিত এবং নির্মাণাধীন আবাসিক হোটেলের একটি তালিকা তৈরি করেছি। তালিকাটি আমলে নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করলে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা সেন্টমার্টিন দ্বীপে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

সরেজমিন দেখা যায়, দ্বীপের ডেইলপাড়া রাস্তার পাশে ‘হোটেল ফ্যান্টাসি’ নামে একটি বিশাল ভবনের কাজ চলছে। ৩০ জনের মতো শ্রমিক নির্মাণকাজ করছেন। এরই মধ্যে প্রায় কাজ শেষ পর্যায়ে থাকা ওই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডেও রয়েছে আলিশান কক্ষ ও সুইমিংপুল। নির্মাণ শেষ হওয়া অংশে রয়েছে চোখধাঁধানো সব ফিটিংস ও আলোকসজ্জার কাজ। পশ্চিম কোনাপাড়া সৈকতের সঙ্গে লাগোয়া ‘রিসোর্ট লাবিবা বিলাস’। সেখানেও তৃতীয় তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছে প্রকাশ্যে। এ দুটি ভবন ছাড়া আরও ১০-১৫টি ছোট-বড় স্থাপনার নির্মাণ কাজ চলছে। দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, দ্বীপের উত্তর অংশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে গড়ে উঠেছে ৮৪টিরও বেশি হোটেল-মোটেল ও ২৮টি রেস্টুরেন্ট। স্থানীয় সূত্রমতে, গত পাঁচ বছরে ৫৬টির মতো বহুতল হোটেল তৈরি হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলেই রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সরকারি কিছু কর্মকর্তার একটি চক্রকে ম্যানেজ করতে হয়। তাদের যোগসাজশে প্রকাশ্যে টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী পৌঁছে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ম্যানেজ থাকায় এসব নির্মাণসামগ্রী নির্বিঘ্নে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর সেখানেও কোনো বাধা ছাড়াই গড়ে উঠছে হোটেল, কটেজ ও রেস্তোরাঁ। আবার অনেক সময় দ্বীপের তিন দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহূত হচ্ছে অবকাঠামো তৈরিতে। দ্বীপে হোটেল ছাড়াও নির্মিত হয়েছে পাকা পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, আবহাওয়া ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান।

সেন্টমার্টিনের গলাচিপা এলাকাটি এ দ্বীপের সবচেয়ে সংকীর্ণ এলাকা। এখানে দাঁড়ালে একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমের সমুদ্র চোখে পড়ে। দ্বীপটির পরিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য স্পর্শকাতর এ জায়গায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী নির্মাণ করেছে মেরিন পার্ক ও ‘কোরাল ভিউ’ নামে পাকা গেস্টহাউস। দ্বীপে রাস্তার একপাশ ও সৈকতের পাড় দখল করে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে শতাধিক দোকান। এসব দোকানে বিক্রি হচ্ছে শুঁটকি, শামুক-ঝিনুকের পণ্য, কাপড়চোপড় ও রকমারি খাবার-দাবার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. রাশেদ-উন-নবী বলেন, জায়গা বিশেষে ১২ থেকে ২০ ফুট মাটির নিচেই পাথরের স্তর রয়েছে সেন্টমার্টিনের। এভাবে ভবন তৈরি হলে দ্বীপের মাটিতে ফাটল দেখা দিতে পারে, এমনকি পাথরের স্তরটিও ভেঙে যেতে পারে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, সেন্টমার্টিনে ইট-সিমেন্ট-রডসহ নির্মাণসামগ্রী আনতে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি লাগে। এ কারণে স্থানীয় লোকজন ঘর তৈরি করতে পারেন না। অথচ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা কৌশলে ইট-সিমেন্ট নিয়ে আসছেন। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ছৈয়দ আলম জানান, সেন্টমার্টিনকে রক্ষা আমাদের দায়িত্ব। এখানে ইট-বালির স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কাঠ ও বাঁশ দিয়ে পরিবেশ-সম্মত আধুনিক কটেজ ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা সম্ভব। পর্যটকরা ইট-বালির স্থাপনা থেকে বাঁশ কাঠের তৈরি স্থাপনায় থাকতে বেশি পছন্দ করে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা সেখানে স্থাপনা নির্মাণ না করতে পারলেও বাইরের প্রভাবশালী লোকজন প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বড় বড় স্থাপনা গড়ে তুলছেন। ছৈয়দ আলমের মতো সমাজ সেবক হাবিবও একই তালে সুর মিলিয়েছেন। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনের শতকরা ৭০ জন লোক পর্যটন নির্ভর। পর্যটকদের নিরাপত্তায় আমরা সবসময় সজাগ থাকি। কারণ তারা এলে আমরা চলতে পারি। আমাদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি থাকবে সেন্টমার্টিনের প্রবালগুলো রক্ষা করতে হবে এবং পরিবেশ সম্মত নূহাশ পল্লীর মতো কাঠের ঘর তৈরি করলে পরিবেশ ঠিক থাকবে। কোনো রকমের অট্টালিকা নির্মাণ করা যাবে না যাতে পরিবেশ তথা সেন্টমার্টিনের ক্ষতি হয়।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, সেখানে আসলে বিল্ডিং করার কোনো প্রয়োজন নেই। যারা যাবে সেখানকার স্থানীয়দের যে ব্যবস্থাপনা আছে সেগুলোতেই থেকে চলে আসবে। অন্যদিকে সেখানে প্রবাল অনেক সম্পদ রয়েছে যা পর্যটনের ভিড়ে নষ্ট হচ্ছে সেগুলোর প্রতিও সংশ্লিষ্টদের খেয়াল করা উচিত। এটি একটি ক্রিটিক্যাল এরিয়া। এখানে হাইকোর্টের রায় দ্রুত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা দৃষ্টি দেবেন বলে আশা রাখি। তবে একটা কথা সত্য যে, ট্যুরিজম নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের এ ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া উচিত এবং আইনের ধারাগুলো আরও শক্তিশালী করা উচিত।

এ প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের পেছনে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দায়ী করেছেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন চাইলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করা কারো পক্ষে সম্ভব না। কারণ মহামান্য হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব হচ্ছে প্রশাসনের। কিন্তু তারা সেটা বাস্তাবায়ন না করাতেই আজকে এর পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এখানে ক্যাপাসিটির বাইরে পর্যটক যাচ্ছে। যাদের বর্জ্য ও বিভিন্ন ধরনের প্রবাল নষ্ট করার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। সুতরাং পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে প্রতিদিন কত দর্শনার্থী সেখানে যেতে পারবে সেটা নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। সময় থাকতে এ সিদ্ধান্ত না নিলে পরবর্তীতে মাটির স্তর বা পাথরের স্তরে ফাটল ধরলে এ চিন্তা করে কোনো লাভ হবে না।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সচিব মো. মহিবুল হক আমার সংবাদকে বলেন, আমরা সেখানে কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম। সমস্যাগুলো আইডেনটিফাই করেছি। এর আগেও অনেকবার সেখানে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আবার পদক্ষেপ নিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হবে।