মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের শেষ কর্মদিবস আগামী সোমবার ২৮ অক্টোবর। সুদীর্ঘ ৩৬ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষে মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর থেকে তিনি অবসরে যাচ্ছেন। ইতি টানছেন সুদীর্ঘ তিন যুগের আমলাতান্ত্রিক জীবনের।

১৯৮৩ সালের ২৭ আক্টোবর তিনিসহ আরও ৫৫ জন একসাথে যোগদান করেন সরকারি চাকুরি বিসিএস (প্রশাসন)। বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই কর্মমুখর জীবন সোমবার বিদায় নেবেন তিনি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ২১তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

কক্সবাজারবাসীর গর্বের ধন উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের রুমখা পালং গ্রামের বাসিন্দা মোহম্মদ শফিউল আলম প্রশাসনে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছৈয়দ হোসাইন ও মাতার নাম আলমাস খাতুন। তিনি ১৯৫৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। শফিউল আলম ১৯৭৫ সালে পালং মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৭ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৭৯ সালে ওমরগনি এমইএস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএ ও ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধু ল’ টেম্পল থেকে এলএলবি পাশ করেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (প্রশাসন) উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৩ সালের ২৭ অক্টোবর বান্দারবনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে শফিউল আলম যুক্তরাজ্যে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভেলপমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশনের উপর এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভূমি মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব, রাষ্ট্রপতির সচিব, ভূমি আপীল বোর্ডের চেয়ারম্যান, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এমডিএস, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার, ময়মনসিংহ ও মাগুরার জেলা প্রশাসক, ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার ইউএনও সহ প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মোহাম্মদ শফিউল আলম বাংলাদেশ সরকারের ২১তম মন্ত্রীপরিষদ সচিব। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, স্পেন, ইতালি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, পাকিস্তান, নেপাল, কানাডা, জার্মানি, চীন, হংকং, কেনিয়া, গায়ানা, পানামা, তুরস্ক, কাতার, হাইতি ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন।
তিনি একজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন জনকল্যাণমুখী সরকারি কর্মকর্তা। সেবাপ্রার্থীদের সার্বিক সেবা দেওয়ার মাধ্যমে এদেশের গরিব, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিলো তার কর্মজীবনের ব্রত।
মোহাম্মদ শফিউল আলম শহীদ পরিবারের সন্তান। ১৯৪৭ সালের ৫ মে জম্ম নেয়া তাঁর বড় ভাই এটিএম জাফর আলম মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শাহাদত বরণ করেন। শহীদ হওয়ার আগে এটিএম জাফর আলম সিএসপি (প্রশাসন) এ উত্তীর্ণ একজন কর্মকর্তা ছিলেন। চলতি বছর এটিএম জাফর আলম সিএসপিকে সরকার মরণোত্তর দেশের সবচেয়ে পর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার স্বাধীনতা পদক প্রদান করেন।

পুরো কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে তিনি বাংলাদেশের ২১তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৩ অক্টোবর ২০১৯ থেকে ৩ বছরের জন্য বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কেবিনেট সেক্রেটারি হিসাবেও সোমবার তাঁর ৪ বছর পূর্ণ হবে। কক্সবাজারের কৃতিসন্তান মোহাম্মদ শফিউল আলমের (পরিচিতি নম্বর : ১০৯৮) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আগামী ২৯ অক্টোবর থেকে বাতিল করে তাঁকে মন্ত্রীপরিষদ সচিবের পদমর্যাদা ও সে অনুযায়ী অন্যান্য সকল সরকারি সুবিধাদি দিয়ে আগামী ১ নভেম্বর থেকে পরবর্তী ৩ বছরের জন্য ওয়াশিংটনস্থ বিশ্ব ব্যাংকের সদর দপ্তরে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ শফিউল আলম আগামী ১ নভেম্বর বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসাবে যোগদান করবেন বলে প্রশাসনের বিশ্বস্থ সুত্র সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন।

কক্সবাজারের কৃতি সন্তান মন্ত্রীপরিষদ সচিব শফিউল আলমের চাকুরীর নিয়মিত মেয়াদ শেষে বিগত ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য বিগত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় ১৩ অক্টোবর রোববার চুক্তির আরো দেড় মাস বাকী থাকতেই আগামী ২৯ অক্টোবর থেকে তাঁর চুক্তি বাতিল করে আগামী ১ নভেম্বর হতে পরবর্তী ৩ বছরের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পেলেন। বিশ্বস্ত সুত্র সিবিএন-কে জানিয়েছেন, ২৮ অক্টোবর অপরাহ্নে মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম নতুন নিয়োগ পাওয়া মন্ত্রীপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। নতুন নিয়োগ পাওয়া খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সোমবার ২৮ অক্টোবর অপরাহ্নে ২১ তম কেবিনেট সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ২২ তম কেবিনেট সচিব হিসাবে সদ্য নিয়োগ পাওয়া খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে দেশের কর্মকর্তা কর্মচারীদের অভিবাবকের পদ হিসাবে পরিচিত কেবিনেট সেক্রেটারির দায়িত্ব অর্পন করবেন। মোহাম্মদ শফিউল আলমই ছিলেন কক্সবাজার জেলার প্রথম নাগরিক, যিনি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পোস্ট কেবিনেট সেক্রেটারির পদ অলংকৃত করে দীর্ঘ ৪ বছর সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে বিদায় নিচ্ছেন। নতুন নিয়োগ পাওয়া কেবিনেট সেক্রেটারি খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের বিদায়ী কর্মস্থল সেতু বিভাগের সচিব হিসাবে রোববার ২৬ অক্টোবর শেষ কর্মদিবস পার করছেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন (৪৬৭৮) কে সেতু বিভাগের সচিব ও সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক হিসাবে গত ২২ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

নিজের কর্মদিবসের স্মৃতিচারণ করে বিদায়ী কেবিনেট সেক্রেটারি মোহাম্মদ শফিউল আলম আবেগে আপ্লুত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর নিজস্ব আইডিতে তিনি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যেখানে তিনি লিখেছেন: “বিসিএস প্রথম ব্যাচের সদস্য হিসেবে ১৯৮৩ সালের ২৭ অক্টোবর আমরা ৫৫ জন কোটায় সরাসরি যোগদান করি। আজ ৩৬ বছর পূর্ণ হল। আগামীকাল রোববার ৩৬ বছর পর বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে সিভিল সার্ভিসকে বিদায় জানাচ্ছি। মনটা বড়ই বিষণ্ণ। অনেক স্মৃতি অনেক স্মৃতি। অনেককে হারিয়েছি। কত কিছুই করার ছিলো, করতে পারিনি। অম্লমধুর অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদায় নিচ্ছি। ভালোয় ভালোয় শেষ করার জন্য আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। তার সাথে আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও সহযোগী সহকর্মীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা। চলার পথে আমার কথা-কর্ম বা আচরণে কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে আমাকে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন। মহান আল্লাহ আপনাদের সবার প্রতি সহায় হোন আজকের দিনে এই কামনা।”