ইমাম খাইর, সিবিএন:
কক্সবাজার সদর খাদ্য গুদামের বিরুদ্ধে একের পর বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযোগ যেন থামছেই না। একেক সময় একে অভিযোগ আসছে গণমাধ্যমে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখেমুখে খাদ্যগুদামের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির কথা। অবশেষে দীর্ঘদিনের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। প্রশাসনের অভিযানে ধরা পড়েছে চাউল নিয়ে ভয়ানক জালিয়াতি।
একটি দাতা সংস্থার জন্য ৩০ কেজি করে পরিমাপ করে রাখা প্রত্যেক বস্তা থেকে বিশেষ কায়দায় চাউল বের করে গোপনে আলাদা বস্তাভর্তি করার দৃশ্যে হতবাক হন অভিযানকারীরা।
রবিবার (২০ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, ৫ নং গুদামের পশ্চিম পাশে সাদা বস্তায় স্তুপ করে রাখা হয়েছে প্রায় ৩০০ টন মতো চাউল। যেগুলো নির্ধারিত একটি দাতাসংস্থাকে সরবরাহ করবে। কিন্তু সরবরাহের পূর্বেই প্রতিবস্তা থেকে অন্তত কেজি/দুই কেজি করে চাউল বিশেষ কায়দায় বের করে ফেলা হয়েছে। যা আলাদা বস্তায় ভরছে শ্রমিকরা। এখবর পৌঁছে যায় প্রশাসনের কাছে। ঘটনাস্থলে গেলে মেলে তার পুরোপুরি সত্যতা। চালানো হয় অভিযান।
তবে, অভিযানের খবরে জালিয়াতি ও অপকর্মের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত উপখাদ্য পরিদর্শক কামরুল ইসলামসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা পালিয়ে যায়। এমনকি বন্ধ রাখে তাদের ব্যবহারের মুঠোফোনও। বারবার চেষ্টা করেও কামরুল ইসলামের সংযোগ পাননি গুদামের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থল থেকে বড় কোন কর্মকর্তাকে আটক না করলেও জায়িলাতির কাজে নিয়োজিত দুই শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সদর মডেল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রবিবার রাত ৮ টায় রিপোর্ট তৈরীর সময় তারা থানা হেফাজতে ছিল বলে সুত্র মারফত জানা গেছে।
এূলতঃ স্থানীয়দের দেয়া তথ্য ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার খবরের সুত্র ধরে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মুক্তার।
চাল নিয়ে জালিয়াতির বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় তিনি নিজেই উপস্থিত থাকাবস্থায় ৬ নং গুদামটি সীলগালা করে দেন। সতর্ক করেন কর্তকর্তা-কর্মচারীদের। অবশ্য এর আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ‘মেজর’ পদের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা গুদামে জালিয়াতির বিষয়টি স্বচক্ষে দেখে গেছেন। সঙ্গে ছিলেন ২টি গোয়েন্দা সংস্থার তিনজন কর্মকর্তা। পরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এএইচএম মাহফুজুর রহমানের নির্দেশে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন এসিল্যান্ড শাহরিয়ার মুক্তার।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, সদর খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের আস্কারায় জালিয়াতির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে বদনাম হচ্ছে সরকারের। উর্ধ্বতন কর্তাদের সাথে হাত করে একযুগেরও বেশি সময় ধরে একই কর্মস্থলে রয়ে গেছেন কামরুল ইসলাম। বরং তিনি পদোন্নতি পেয়ে এখন উপখাদ্য পরিদর্শক হয়েছেন।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী মন্তব্য করেন, কামরুল ইসলামের হাত অনেক লম্বা। তাকে অপকর্মের জন্য শাস্তি বা বদলি করার সাহস কারো নাই। তাই অভিযোগের পাহাড়েও নড়েনা কামরুল। অক্ষত রয়ে যায় স্বপদে। অভিযোগের তীর সাবইন্সপেক্টর সোলতানা রাজির দিকেও।
সাইফুদ্দিন ভুচু (মাঝি), দারুয়ান ছৈয়দ হোসেন, ঝাড়ুদার স্বপন কুমার মল্লিকও চাল জালিয়াতির অংশিদার বলে গোয়েন্দা সুত্রে প্রকাশ পেয়েছে। গুদামের গেইটের আবদুল গফুর সওদাগরসহ আরো বেশ কয়েকজন লোক আকামে জড়িত। দুই নাম্বার চালের সিংহভাগ ক্রেতা ‘সাগর’ নামের বহুল আলোচিত এক ব্যক্তি। বিসিকে কালু হাজির পরিত্যক্ত ভবনে তিনি ভেজাল চালের গুদাম করেছেন। ডব্লিওএফপির ২৯ জনা ‘চাল সিন্ডিকেটের’ তিনি অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
এদিকে, সদর খাদ্যগুদামে ভয়ানক জালিয়াতির খবরে ছুটে যান জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দেবদাস চাকমা। তিনি ঘটনায় জড়িতদের কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।
বিশেষ করে ওসি মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, উপখাদ্য সহকারী কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে জানান।
রবিবার দিবাগত রাত ৮টার দিকে মুঠোফোনে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দেবদাস চাকমা কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)কে জানান, এ ঘটনায় উখিয়া উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সেলিম হেলালিকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন- মহেশখালী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা তপন বড়ুয়া ও রামুর ইন্সপেক্টর মুরশেদুল করিম। প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযানে নেতৃত্বদানকারী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মুক্তার জানান, চাউল জালিয়াতির বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। গুদাম সীলগালা করা হয়েছে। পরবর্তী তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের বিসিকে (র‌্যাব ক্যাম্প সংলগ্ন) কালু হাজির ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত গুদামে বিভিন্ন জায়গা থেকে কম দামে ভেজাল চাউল মজুত করে ওখান থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহ করা হয়। প্রায় ৩০ টাকায় টেন্ডারের চাউল কেজিতে ১৭ টাকা দরে কিনেছে সাগর এন্টারপ্রাইজ ও খাজা ভান্ডার। বর্তমানে ৫০০০ টন চাউল সরবরাহ করবে চিহ্নিত সিন্ডিকেটটি। তবে, সাগর কোল্ডস্টোরেজে বেশিরভাগই নিম্নমানের খাদ্য পন্য মজুত করা হয় বলে সুত্রটির দাবী। দাতা সংস্থা ডব্লিউএফপির চাউলের টেন্ডার ২৯ জনের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।