এইচ এম আবু ছিদ্দিক

সাম্প্রতিক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০/২৫জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করেছে। এমন জঘন্যতম ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। একই বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কীধরণের নরপশু হলে একজন সহকর্মীকে পিটিয়ে লাশ বানাতে পারে, তা বোধগম্য নয়। শহিদ আবরার হত্যা ও তার শোকার্ত পরিবারের আর্তনাদ পুরো জাতিকে থকমে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বকেও ঝাঁকুনি দিয়েছে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো আবরার হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। জাতিসংঘ থেকে এ বিষয়ে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে আবরারের ঝগড়াঝাঁটি বা তর্কাতর্কির কোন তথ্যপ্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যাইনি। তাঁর অপরাধকি শুধু একজন সচেতন নাগরিক, দেশপ্রেমিক, সাহসী ও প্রতিবাদী যোদ্ধা।

ভারতের সাথে চুক্তি দেশের স্বার্থে হোক, বা স্বার্থবিরোধী হোক। ফেসবুক আইডিতে মতামত দেয়াটা যদি তার অপরাধ হয়। তাহলে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রইলো কোথায়?

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসাবে স্বীকৃত। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের অপরাধের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে।

কোটা সংস্কৃার আন্দোলন কারিদের ওপর হামলা করে হেলমেড বাহিনী উপাধি পেয়েছে ছাত্রলীগ। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু বকর আহত হয়ে পরেরদিন মারা যান।

২০১২ সালে ছাত্রলীগের অর্ন্তকলহে বিরোধীপক্ষের হামলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহামদ আহত হয়ে একদিন পর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

ছাত্রলীগ নেতা দুর্ধর্ষ ক্যাডার জসিম উদ্দিন মানিক ১০০ ছাত্রীকে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব পালনসহ যৌনসন্ত্রাস, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, লুটপাট ও খুন-ধর্ষণের মতো অসংখ্য অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা দর্জি দোকানদার বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে রাস্তায় কোপিয়ে হত্যার দৃশ্যও বিশ্ববাসির কাছে জাতিকে লজ্জিত করেছে।

শহিদ আবরার সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেও বিশ্ব বিদ্যালয়ে র‌্যাগ নামের টর্চার সেল থেকে দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী এতোদিন দেশবাসি ও অভিভাবকদের জানা ছিল না।

কথিত বড় ভাই নামের খুনিরা গ্রেফতার হওয়ায় নির্যাতিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে সাহস পেয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক অধিকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেদেশে থাকেনা, সেদেশে গণতন্ত্রও ভূলুন্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ব বিদ্যালয়সহ (বুয়েট) দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একতাবদ্ধ হলে নাগরিক অধিকার আদায়সহ কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসীদের স্থান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কোন ভুমিকা পালন করেনা। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশের সকল ছাত্ররা একত্রিত হয়ে আওয়াজ দিলে সুশাসন নিশ্চিতসহ রাষ্ট্রও দুর্বৃত্তায়নের কবল থেকে রক্ষা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মুরব্বিদের যেই শিক্ষা দিয়েছ, সেটাই এর দৃষ্টান্ত।

প্রিয় শিক্ষার্থীরা: বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যায় যেমন কষ্ট পেয়েছি। তেমনি অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছি, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০/১২ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর হাতে হাতকড়া দেখে। তোমাদের হাতে যেখানে বই থাকার কথা, সেখানে হাতকড়া দেখলে সন্তানের বাবা হিসাবে আমিও ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত হই।

ছাত্রলীগ বাবারা: তোমরা কোন না কোন বাবা-মায়ের সন্তান, অর্থাৎ আমাদেরই সন্তান। সন্তানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও বিশ্বাস রেখেই প্রত্যেক বাবা-মা তাদের কষ্টার্জিত টাকায় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় তোমাদেরকে শিক্ষা বিদ্যালয়ে পাঠায়। তোমরা শিক্ষিত হয়ে যেন আদর্শবান মানুষের মতো মানুষ হও।

পড়ালেখায় মনোযোগ না দিয়ে নোংরা রাজনীতির নামে নরপশুর মতো মানুষ হত্যা করতে থাকলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

অবশ্য এরকম পরিস্থিতির জন্য ছাত্রলীগকে একা দোষারোপ করা সমীচীন হবে না। অভিভাবক ও শিক্ষকের দায়িত্ব যেমন রয়েছে। তেমনি শাসকগোষ্ঠী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর দায়িত্বটা বেশী বর্তায়। ছাত্রলীগের কথিত বড় ভাইরা র‌্যাগের অজুহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বছরের পর বছর অত্যাচার চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন ধরণের ব্যবস্থা’তো নেয়নি। বরং ছাত্রলীগকে জামাই আদরে প্রতিটা বিষয়ে সহযোগিতা করেছে। এরকম বিচারহীনতার সংস্কৃতি আজকে ছাত্রলীগকে খুনি বানিয়েছে।

আজকে যারা আবরারের খুনের দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। তাদের সবাইকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভাল মানুষ হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিল তাদের পরিবার। এদের এমন পরিণতির জন্য দায়ী কে?

প্রথমত:- রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা দেয়ার পরিবেশ তৈরী করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য না দেখে যোগ্যতারভিত্তিতে আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

(ক) সম্পদ ও ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার লড়ায়ে টিকে থাকার জন্য আবেগপ্রবণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

(খ) সুবিধবাদী দলকানা শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ আমরা যাদের মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে জানি এবং সম্মান করি। সেই শিক্ষকদের অধিকাংশই দলকানা। দলীয় আনুগত্য শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কল্যাণের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের নামে তছবি জপে বেশী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যত অনিয়ম, দুর্নীতি, সন্তাস-মাস্তানি হোক না কেন, এসব শিক্ষকরা প্রতিবাদ তো দুরের কথা। উল্টো সেখান থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে।

দলকানা শিক্ষকদের কারণে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক মহোদয়গণের বিকাশ হচ্ছে না। আর বিশ্ব বিদ্যালয় প্রশাসন’তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের পেটানোর সময় তাদের ঘুম ভাঙ্গে না। খুন হয়ে গেলে শুধু লাশটা পাহারা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ দলকানা শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট করছে। এদের অপসারণ করা না গেলে শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা দেয়া কখনো সম্ভব হবে না।

(গ) ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকা বড় ভাইদের অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদের সাহস পায় না। এসব নির্যাতনকারী বড় ভাইদের খুঁজে বের করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

(ঘ) ক্ষমতাসীন দলের সহযোগীরা আইনশৃঙ্গলা বাহিনীর সামনে অপরাধ করলেও তাদেরকে অনেক সময় আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। অর্থাৎ সুশাসনের ঘাটতি।

(ঙ) দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ সংকটে খেলাধুলার পরিবেশ ও সাংস্কৃতি চর্চা নেই বললেই চলে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা মানষিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাসভিত্তিক খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা বাধ্যতামূলক হওয়া অত্যাবশ্যক।

এছাড়া আরও বহুবিদ সমস্যা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। যা আজকের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়।

৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ যুদ্ধের মধ্যদিয়ে এদেশের স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের জুলুম-নির্যাতন ও লুটপাট থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি সাধারণ নাগরিক। এক সময় বিএনপি-জামাতসহ তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আধিপত্য বিস্তার করেছে। এখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগসহ তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রামরাজত্বকায়েম করছে। রাজনীতির নামে যারা অপরাধ করছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হলে, রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী আইনশৃঙ্গলা বাহিনীকে আরও সোচ্চার ও আন্তরিক হতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।

মোবাইল:-০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩,