মাহদী হাসান রিয়াদ:

বাবা: অবিশ্রান্ত সচল থাকা একটি যন্ত্রের নাম।
দৈনন্দিন জীবনে নেই কোনো নীরবতা,নিস্তব্ধতা। থমকে যান না তিনি।
ঝড়-তুফান বাবাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে রীতিমতো আড়ি দেয়।
প্রখর ভরা রৌদ্রকে তোয়াক্কা না করেই জীবিকার তাগিদে আপনা গতিতে দুর্বার ছুটে চলেন। কখনো এপথ থেকে ওপথে। আবার কখনো গ্রাম থেকে শহরে। কিংবা দেশ থেকে দেশান্তরে।
দুমুঠো অন্নের জন্য সবকিছুই যেনো বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর তিনি। সময়ের পালাবদলে বাবারা বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। কখনো মেথর, আবার কখনো মুচি,কিংবা দিনমজুর, আরো কতোযে কী।

দিনশেষে তবুও আমরা অনায়াসে বলি–বাবা আমার চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম। বাবার কথা তিত করলার শরবতের ন্যায়। অমায়িক ভাষায় কথা বললে বোধহয় ট্যাক্স দিতে হয়। বাবা ভালোবাসতে জানে না। দরিদ্র বাবার ঘরে জন্ম নেওয়াটা আমার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। এমন বাবার ঘরে জন্ম নেওয়াটা যেনো আজন্ম পাপ’।

বিশ্বাস করুন; ওই অসহায় বাবাকে এতোসব কথা শোনাতে নুন্যতম পরিমাণও দ্বিধাবোধ করি না। ভাবি না,চিমটি পরিমাণ চিন্তাও করি না। খুব সহজেই বিষাক্ত কথা গুলো দিব্যি বলতে পারি।
ভেঙে ছারখার করে দিতে পারি বাবার মন।

ওই অবহেলিত মানুষটি কোনো বছরই আমার আগে ঈদের জামা নিতে পারেনি। হয়তো পারবেও না।
যখনই বলতাম ‘আপনি নতুন জামা নিবেন না’?
দু’চার বছরের পুরোনো জামাটি হাতে নিয়ে
দাঁত দু’টো বের করে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলতো— ‘আমার জামা তো এখনো নতুন রয়ে গেছে’ একটু আয়রন করলে ঝকমক করবে। শুধুশুধু অপচয় করার কী প্রয়োজন। এটাতেই আমার চলবে। তোরা বাচ্চা মানুষ, তোদেরই নতুন জামা প্রয়োজন। এতো শানশওকত করার বয়স কী আমার আছে।

বাবার সোনালী রঙের হাতঘড়িটা আজ প্রায় সাদা হয়ে গেছে। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি একই ঘড়ি। কখন যে ওই ঘড়ি থমকে গিয়েছিলো,তা- আমার পক্ষে এবং বাবার পক্ষে বলাটা অসম্ভব। আল্লাহ ভালো জানেন।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে; প্রতি মাসেই কিন্তু লেটস মডেলের ব্রান্ডের ঘড়ি ঠিক আমার হাতে ঝকঝক করে ।

জুতার যদি জবান থাকতো, এতোদিনে বাবার জুতা জোড়া নির্ঘাত মামলা করতো। নির্যাতনের মামলা। পরতে পরতে সুচের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে জুতা দু’টি। দেখলে মনে হবে এ যেনো কাঁচাহাতে বানানো নকশিকাঁথা।
কিছু বললেই অমনি মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দেন— এইতো, আগামীকালই নতুন জুতা নিয়ে নিবো। কিন্তু, বছর-দু’বছর হয়ে গেলো, তবুও বাবার আগামীকালটা এখনো আসলো না।
সেই আগামীকালটা কখন আসবে আদৌও জানি না। ধারণা করাটাও বেশ কষ্টকর।

আমরা কখনোই বাবার ছলনাময়ী হাসির ভেতর ঢুকার চেষ্টা করিনিই।বোঝতে চাইনি ওনার চাপা কষ্ট। দিনদিন নির্মম ভাবে হত্যা করেছি বাবার ইচ্ছে গুলোকে।
তবুও বরাবরই নিশ্চুপ থেকেছেন। মুখফুটে অভিযোগ করেননি।কভু দেখাননি অভিমান। শুধুই হাসিয়েছেন, সুখ সাগরে ভাসিয়েছেন। আড়াল থেকে বারংবার ভালোবাসার ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছেন তিনি।

তবুও কীভাবে ওই মানুষটার প্রতি খুশি হতে পারি না আমরা? কেনো এতো অভিযোগ? ওনার প্রতি কেনোইবা এতো অভিমান?
সমস্যাটা একজায়গায়! তিনি অগোছালো, গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। সময়ে মিথ্যে বলে হাসান। হতাশার দুমড়োজালে আটকে যেতে দেয় না আমাদেরকে।
নিজের অকল্পনীয় পরিশ্রমের কথা শেয়ার করেন না। কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতে জানে না। এমনকি বুঝতে পর্যন্ত দেয় না।
পরিশেষে মায়ের মতো আলতো পরশে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারে না—খোকা, তোকে বড্ড ভালোবাসি।
এগুলোই হচ্ছে বাবাদের মারাত্মক দোষ-ক্রুটি।

আফসোস,আমরাও গাধার মতো অসহায় মানুষটাকে ভুল বুঝি হরহামেশাই।
কখনোই কী ভেবেছেন; যার গর্জনে পুরো বাড়ি প্রকম্পিত হয়, যার ভয়ে সবাই নিথর হয়ে যায়,
সে মানুষটা স্টেশনের মাঝে ভিজে বিড়ালের মতো বসে কেনোইবা মানুষের জুতা পালিশ করে?
কেনোইবা মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মেথরের কাজ করে?
সিক্ত তোলার মতো মিইয়ে গিয়ে কেনো অন্যের দাসত্ব করে?
ভাবতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য যে, এসব কিছু আমার/আমাদের জন্যই করে থাকেন।

আমার রিকশা চালক বাবা দিনভর রিকশা চালিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বাসায় ফিরে, আর কিছু থাকুকবা না থাকুক ,কপোল ভর্তি ফকফকা হাসির ঝুলি থাকবেই থাকবে৷ মনের দেহলিতে হাজারো কষ্ট থাকা সত্বেও হেসে যায় অবিরাম।
কারণ,সন্তানদের চেহারাতে বাবারা সুখ খোঁজে পায়। ভুলে যায় সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের কষ্ট।
বাবার পা- গুলো যখন কাছ থেকে দেখি,মনে হয় এ যেনো দগ্ধ কাঠ! রিকশার পেডেল মারতে মারতে বাবার পা- গুলো টেরাবাঁকা হয়ে গেছে।
কৃষ্ণবর্ণে ছেয়ে গেছে পা-দু’টি।
তবুও নিমকহারামের মতো বলি— ‘বাবা আমাকে ভালোবাসেন না’। কী অসুস্থ মনমানসিকতা আমাদের। আফসোস!

অনেকক্ষেত্রে ভালোবাসা প্রকাশ করা অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়,যে সমস্যাতে বাবা প্রতিদিন ভোগছেন।
বাবার ভালোবাসা লুকিয়ে আছে মানুষের জুতার আড়ালে। কিংবা দুর্গন্ধময় নর্দমার ভেতরে। অথবা রিকশার পেডেলে। বাবার ভালোবাসা একপ্রকার অধরা পাখি, সে ধরা দেয় না। ধরে নিতে হয়। খোঁজে নিতে হয়।অনুভব করতে হয়।
যেদিন আমিও বাবা হবো,দৃঢ়বিশ্বাস সেদিন অবশ্যই খাতা-কলমে অসহায় মানুষটির ভালোবাসার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবো। খোঁজে পাবো ভালোবাসার নেপথ্য।

পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক,
তারাও হাসুক।
প্রিয় আব্বা! আমিও অনেকটা ভালোবাসি আপনাকে। কখনোই প্রকাশ করতে পারিনিই।
আপনাকে কী পরিমাণ ভালোবাসি, সেটা বলা অসম্ভব! ভালোবাসা দেখা যায় না,ছোঁয়া যায় না, ভালোবাসা অনুভব করতে হয়। আমিও অনুভব করি।
আমার ছোট্ট হৃদয়ের সবটা উজাড় করে দিয়ে অনুভব করি আপনাকে এবং আপনাদেরকে।