এইচ এম আবু ছিদ্দিক

লেখার শিরোনাম অনেকটা ব্যতিক্রম মনে হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক বা রাজনৈতিক অঙ্গনে আধিপত্যবাদীদের দায়িত্ববোধের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

বাচ্চাদের খেলার মাঠ, পুকুর-জলাশয়, নদী-নালা, সমুদ্রসৈকত, পাহাড়-পর্বতসহ সরকারি খাস জায়গা থেকে শুরু করে এমন কিছু বাদ নেই, সবখানে চলছে দখল আর দখল। এই দখল প্রক্রিয়ার সাথে একশ্রেনীর সুবিধাবাদী ক্ষমতাশালী ও সমাজে আধিপত্য বিস্তারকারি ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে অনেকটা চাপা পড়ে যায়।

গত কয়েকবছর পূর্বে সমুদ্র সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়েই শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়। সেই স্টেডিয়াম বছরে দুই/একবার পুলিশি কড়া পাহারায় গেট খুলতে দেখা গেলেও বাকি সময় বছরজুড়েই তালাবদ্ধ পড়ে থাকে।

সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত স্টেডিয়ামের পাশে আরেকটি আন্তর্জাতিক ফুটবল স্টেডিয়াম নির্মানের নির্দেশ দিয়েছেন। এরকম কয়েক’শ আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম নির্মাণ করলেও কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়, বরং স্বানন্দে সরকারকে সাধুবাদ দেয়ার কথা। কিন্তু এসব আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে খেলার মতো যেরকম দক্ষ খেলোয়াড় তৈরীর পরিবেশ দরকার, তা সরকারের মাথায় আছে কিনা?

বিশেষ করে কক্সবাজার সদরে যেসব খেলার মাঠ ছিল। বিগত কয়েক বছরে তার অধিকাংশই দখল হয়ে গেছে। সংক্ষিপ্ত লেখার দৈর্ঘ্য বিবেচনা করে সবগুলোর উদাহরণ দেওয়া সম্ভব নয়। জেলেপার্কসহ যেসব খেলার মাঠ দখল হয়ে গেছে, বা হচ্ছে সেগুলো অন্যদিন আলোচনার চেষ্টা করব।

আজকে শুধু সৈকত আবাসিক এলাকা, লাইটহাউজপাড়া ও সৈকতপাড়াসহ এর আশেপাশে বসবাসকারী স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও যুব সমাজের আর্তনাদ তুলে ধরার চেষ্টা করছি। উল্লেখিত এলাকায় খেলার উপযুক্ত কোন মাঠ না থাকায় খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় তিন’শ শিক্ষার্থীসহ অধিকাংশ যুবসমাজ।

যার ফলে, প্রায় বাচ্চারাই ফুটপাথে আড্ডা দেয়াসহ চার দেয়ালের ভিতরে বন্দি হয়ে পড়ছে। বহু যুবসমাজ পরিবার এবং সমাজের অবাধ্য হয়ে মাদকাসক্ত, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও ইয়াবাবহনসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব যুবকদের অবৈধ পথে ব্যবহার করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্বসহ শত শত কোটি টাকার মালিক হচ্ছে একশ্রেনীর সুবিধাবাদী মুখোশপরা রাঘববোয়াল।

আজকের শিশু-কিশোরেরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কথাটি সরকারের মন্ত্রী, আমলা বা নেতারা রাজনৈতিক মঞ্চে অহরহ উদাহরণ দিয়ে থাকে। তাদের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণের কোন সুযোগও নেই। তবে এসব ভবিষ্যৎকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে যেসব উপকরণ, বা খেলার মাঠসহ পরিবেশ দরকার তা’কি বর্তমানে আছে?

জন্ম সুত্রে পুত-পবিত্র শিশুটি বেড়ে উঠার সাথে সাথেই চার পাশের পরিবেশকে উপলব্ধি করতে থাকে, এবং সেখান থেকেই সবকিছু শিখে। এসব শিশু-কিশোরদের পড়ালেখার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সুস্থ থাকার বা বিনোদনের অন্যতম অংশ হচ্ছে খেলাধুলা। নিয়মিত খেলাধুলা করতে পারলে বাচ্চাদের মন-মানসিকতা ভাল থাকে, এবং অপরাধজগৎ থেকে অনেকটা বিরত থাকে। সৈকত আবাসিক এলাকার নির্ধারিত খেলার একমাত্র মাঠটি ভূমির মালিকানা দ্বন্দ্বে খেলার অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে।

প্রসঙ্গত: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তরাধীন চট্টগ্রাম পি, ডব্লিউ, ডি সার্কেল-১ এর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত আবাসিক এলাকায় বিগত ০৭-০৪-১৯৭৭ইং তারিখের ৮৯৭/২/৭৭ আর পি ডি নং প্লানভুক্ত প্রায় ২২৬টি আবাসিক প্লট বরাদ্দ দেয়ার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। চট্টগ্রাম ১নং সার্কেলের তত্ববধায়ক প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত ১১১৫/১নং স্মারক এর বরাদ্দপত্র মুলে বরাদ্দ দেওয়া সম্পত্তি আবাসিক প্লট হয়। তদনুযায়ী সরকার পক্ষে নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগ কক্সবাজারের সহিত প্রত্যেক প্লটের মালিক বা লীজ গ্রহীতার সাথে ৯৯ বছর মেয়াদী লীজ দলিল সম্পাদিত ও নিবন্ধিত হয়। তৎকালিন গণপূর্ত বিভাগের নিখুঁত মাষ্টার প্লান অনুযায়ী সৈকত আবাসিক এলাকায় নির্ধারিত খেলার মাঠ, মসজিদ-মাদ্রাসা, প্রাইমারি স্কুলের জন্য পর্যাপ্ত খালি জায়গা ও পূর্ব পাশে পাহাড় লাগোয়া সবুজ বেষ্টনীসহ আবাসিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট সরকার পক্ষ। হালের বিবর্তনে সৈকত আবাসিক এলাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ১৪টি খালি জায়গায় বিশাল বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া আশেপাশের সরকারি জায়গা গুলিও অধিকাংশ বেদখল হয়ে গেছে। অবশিষ্ট রয়েছে শুধু দু’টি খালি মাঠ। যার একটিতে পর্যটন বান্ধব পার্ক করার অজুহাতে বাউন্ডারিসহ মাটি ভরাটের কাজ চলছে। অন্যটিতে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে গণপূর্ত বিভাগের পক্ষে “নির্ধারিত খেলার মাঠ” লিখা বড় সাইনর্বোড ঝোলানো ছিল। গত বছর গণপূর্ত বিভাগ মাঠটিতে খেলার উপযোগী করতে বাউন্ডারির কাজ চলাকালিন হঠাৎ থমকে যায়, এবং নির্ধারিত খেলার মাঠ লিখা সাইবোর্ডটি উধাও হয়ে যায়। তৎস্থলে স্থলাভিষিক্ত হয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যক্তি মালিকানা সাইবোর্ড। এমন আজগুবি কর্মকান্ড দেখে সৈকত আবাসিক এলাকায় বসবাসরত কয়েকজন প্লটের মালিক, বা লীজ গ্রহীতা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বেশ কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করেন। তাদের অভিযোগ, সম্পূর্ণ আবাসিক সুবিধাদীসহ তৎকালিন সরকারের নির্ধারিত মূল্যে তাঁরা আবাসিক প্লট বরাদ্ধ পেয়েছেন। তাদের বাচ্চাদের খেলার মাঠসহ অন্যান্য আবাসিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। গণপূর্ত অধিদপ্তরাধীন জনস্বার্থে ব্যবহৃতব্য খেলার মাঠটি যদি কারো ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি হয়। তাহলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালতে বিচার চাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আদালতের চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র কাজের সাময়িক স্থগিতাদেশ বলে সরকারি সাইনবোর্ড গায়েব হওয়ায় গণপূর্ত বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাফেলতিকেই দায়ী করছেন ভুক্তভোগী প্লট মালিকরা।

“আজকের শিশু-কিশোরেরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ” কথাটি যদি সত্যিকারভাবে মনে-প্রাণে সবাই বিশ্বাস করেন। তাহলে অপরাধজগৎ থেকে এলাকার কয়েক’শ শিক্ষার্থীসহ বাচ্চাদের পরিত্রাণ ও একমাত্র খেলার মাঠটি রক্ষা করতে জেলা প্রশাসক, পৌর মেয়র, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগ কক্সবাজার এর ভ্রুক্ষেপ প্রত্যাশা করার ন্যায্য অধিকার এলাকাবাসির রয়েছে।

দেশের প্রতিটা গ্রামে-গঞ্জে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ সংরক্ষণসহ খেলাধুলার পরিবেশ থাকা অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায়, শতকোটি টাকার আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেয়া ছাড়া খেলার জগতে ফলাফল মোটেও ভাল হবে না।

আমার ব্যক্তিগত মতামত, সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর যদি তৎকালিন ভূমি অধিগ্রহনের সময় প্রকৃতপক্ষে মূল মালিকের টাকা পরিশোধ না করে থাকে, জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে উক্ত খেলার মাঠটি পুনরায় অধিগ্রহনের ব্যবস্থা করলে সমস্যা কোথায়?

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।

মোবাইল:- ০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩,