ইমরুল শাহেদ
(ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)

শৈশবে পাঠ্যবইয়ে পড়া একটি গল্প এখনো মনে আছে। একটি ছোট ছেলে অন্য একটি শহরের রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন। যদিও অভিজাত চেহারার, বিনয়ী ও রুচিসম্পন্ন সে ছেলের বিষয় মালিকের কাছে রহস্যময় মনে হত। চুক্তিভিত্তিক সে চাকরির নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রাপ্য ভেতন-ভাতাদি নিয়ে ছেলেটি বাড়ি ফিরে গেল।

অল্প কিছুদিন পর মালিকের মনে বিনয় ও ভদ্রতায় মন কেড়ে নেওয়া ছেলেটির বাড়ি যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। যাওয়ার সময় হাতে করে তিনি আধা কেজি মিষ্টিও নিয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন গরীব ঘরে আধা কেজি মিষ্টি পেয়েই খুশিতে আত্মহারা হবে।

কিন্তু ছেলেটির বাড়িতে গিয়ে মালিকের চোখ ছানাবড়া। তিনি দেখলেন অভিজাত বংশের বিশাল বাড়িটির স্বত্বাধিকারীরা অতিশয় ধনী। ছেলেটির বাবা সেই শহরের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, যিনি চুরুটের হাভানা পাইপ হাতে নিয়ে মালিককে সম্বাষণ জানালেন। ছেলের বাবা জানালেন, স্কুলের কিছুদিন ছুটির সময়ে ছেলে চেয়েছিল যে কোন কাজ করে সময়টুকু কাটানোর। আমাদের পরিবার থেকে এই শিক্ষা সে পেয়েছে, কোন কাজই ছোট নয়। কাজ মানেই পরিশ্রম এবং সততা।

মালিক এই কথা শুনে অত্যন্ত লজ্জা পেলেন এবং ঢোঁক গিলে হাতে করে নিয়ে যাওয়া সেই আধা কেজি মিষ্টি পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন।

গত কয়েকদিনে সামাজিক মাধ্যেম এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া রাজু ভাইয়ের কথা শুনে প্রথমেই আমার সেই গল্পের কথা মনে পড়ে গেল।

এই কথা সত্য, বর্তমান বাংলাদেশের পলিটিক্যাল এবং সামাজিক স্ট্যাটাসের বুহ্য রাজু ভাই ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিবিদ মানেই ফিনফিনে পাতলা পাঞ্জাবী পরা কোটিপতি ব্যবসায়ী নয়, অথবা সূটেড বুটেড পরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া নয়।

রাজু ভাই বংশগতভাবে অভিজাত পরিবারের সন্তান। উনার মরহুম পিতা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, যিনি একজন সাবেক সংসদ সদস্য। বাপ দাদার আমলের প্রচুর গ্রামের সম্পত্তি তিনি রেখে গিয়েছিলেন। সেই জমিদারের সন্তান, রাজু ভাই নিজেই দুই মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। সম্ভবত, বাংলাদেশে উনার এলাকায় উনার চেয়ে জনপ্রিয় চেয়ারম্যান বিরল। তবুও আজকে কেন তিনি পাঠাও, উবার চালাচ্ছেন? উনার কি আত্মসম্মানের অভাব? উনি কি মানসিকভাবে অসুস্থ? নাকি উনি সস্তা জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশের প্রাইম মিনিস্টার হবেন? চাইলে কি তিনি তৃতীয় মেয়াদে দলের কমান্ডের বাইরে গিয়ে পুনরায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান হতে পারতেন না? ভারতবর্ষের সর্বাদিক জনপ্রিয় এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবশালী শাসক সম্রাট আওরঙ্গজেব কি হাতে কুরআন লিখে তা বিক্রি করে নিজের ব্যয় নির্বাহ করেন নি?

রাজু ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ ২০১৭ সালের দিকে। পেকুয়ার রাস্তাটির কাজ করতে গিয়ে মেশিনারিজ বসানোর জন্য সরকারী স্থান ব্যবহার করার অনুমতির জন্য উনার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বিনয়ের সাথে ইউএনও সাহেবের কাছে রেফার করে বলেছিলেন, আমার এখতিয়ার নেই এই মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার।

এভাবেই উনার সাথে টুকটাক সখ্যতা। পরবর্তীতে যখন উনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সমাপ্ত করে অবসর যাপন করছিলেন, দেখলাম তিনি বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করছিলেন। আমিও যেহেতু ভ্রমণপ্রিয় ইনবক্সে এই বিষয়ে বিভিন্ন কথা হতে থাকল। এর মাঝে ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল আমাকে জানালেন, উনার একটা চাকরির খুব দরকার। আমি খুবই লজ্জা পেলাম। বুঝলাম আমার সাথে মশকারী করছে। অন্য বিষয়ে সরে গেলাম।
পরে ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি পুনরায় এমনভাবে একটি চাকরির জন্য রিকোয়েস্ট করলেন, আমি বুঝলাম আসলেই সিরিয়াস। কারণ সেদিন জানালেন, তিনি এখন পাঠাও চালাচ্ছেন, কিন্তু প্রথমদিনেই কাগজপত্র বাসায় ফেলে আসায় মোটরসাইকেলটি পুলিশ টো করেছে। এছাড়া উনি আরো অনেকজনকে চাকরির কথা বলেছেন, কিন্তু সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এর কয়েকদিন পরে উনার সাথে আমার সরাসরি দেখা হয়। নানা কথা প্রসঙ্গে পাঠাও চালানো বিষয়ে তিনি বহু কথা বলেন। তিনি জানালেন-

১. উনি শহরে থাকেন, বাসা ভাড়া ১৮ হাজার টাকা। যা উনার আম্মা দেন। উনার দুই সন্তান, যাদের পেছনে শিক্ষা ব্যয় ১৫ হাজার টাকার উপরে। এছাড়া সাংসারিক খরচ তো আছেই। যখন তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, ভাতা থেকে প্রাপ্ত ২০ হাজার টাকা ভাবীর হাতে দিয়ে দিতেন। বাকি টাকা দিয়ে নিজে চলতেন। কিন্তু এখন আর ভাতা যেহেতু পান না, এক্সট্রা কোন ইনকাম নেই।

২. পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে ভাই বোনদের সাথে অংশ ভাগের পর তিনিও কিছু পেয়েছেন। যেখান থেকে প্রথম নির্বাচনে ১ কানি, দ্বিতীয় নির্বাচনে ৪ কানি ধানি জমি বিক্রি করে এবং নিজের বিগত দিনের পুঁজিবাট্টাসহ দিয়ে নির্বাচনের খরচ সামলেছেন। বাকি যে অংশটুকু আছে, গ্রামের সেই জমিজমা থেকে বছরে ১ লাখ টাকা মত পান, যা মাসে ৮ হাজার টাকার চেয়ে কিছু বেশি। এই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের খরচ আর সংসার খরচ নির্বাহ করা সম্ভব নয়।

৩. তিনি নিজে উচ্চ শিক্ষিত। বি. কম পাশ। কিন্তু দলীয় কাজে সময় ব্যয় এবং নির্বাচিত হয়ে এক নাগাড়ে ১০ বছর সরকারী দায়িত্ব পেয়ে জনগণের সেবা করতে গিয়ে কোন চাকরিতে যোগ দেন নি। উনার বয়স এখন ৪৩, তাহলে উনি কোথা থেকে ইনকাম করবেন?

৪. তিনি জানালেন, সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ সালাহ উদ্দিন সাহেবের হাতে গড়া আদর্শের সৈনিক তিনি। যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পেকুয়া উপজেলা। সেই আদর্শে থেকেই বাকি জীবন নির্মোহভাবে কাটাতে চান।
৫. কোন কাজকেই তিনি ছোট করে ভাবেন না। পিতা বলে গিয়েছিলেন, তোমরা মনে রেখে, তোমরা কার ছেলে। এমন কোন কাজ করো না, যা দিয়ে তোমাদের মরহুম পিতার বদনাম হয়। যেহেতু চাকরির সন্ধান পাননি, সেহেতু সৎ পথে আয়ের জন্য নেমেছেন। এখন সেই কাজ কি পাঠাও চালাকের কাজ, নাকি পাথর ভাঙ্গার কাজ তা মুখ্য নয়। মুখ্য সেতাই, তিনি কিভাবে আয় করছেন।

৬. যেহেতু তিনি এখন অবসর যাপন করছেন, অভাবের তাড়না নেই, সেহেতু তিনি সৎ পথে আয়ের জন্য পরিশ্রম করতেই পারেন। এতে যারা এখানে বিশেষ উদ্দেশ্য খুঁজেন তারা উন্মাদ এবং বিকৃত রুচীর মানুষ।

আমি রাজু ভাইয়ের জন্য দোয়া করি এবং উনাকে নিয়ে গর্ব করি। উনার সম্মান এতটুকু নষ্ট হয়নি, বরঞ্চ আত্মসম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। আর যারা উনার বদনামে মুখর, তাদের মুখে ফুল চন্দন পড়ুক।