ছবি : নিহত মিলা বড়ুয়া
মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
মিলা বড়ুয়া (২৫)। স্বামী-রোকেন বড়ুয়া। বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর শেষ বিকেল। বিভিন্ন শপিং করতে গিয়েছিল উখিয়া কোটবাজারে। অনেক বাজার করেছে। তারমধ্যে ছিলো ৭টা ৩৪ মিনিটে সুকুমার বাবুর ফার্মেসী থেকে ওষুধ ক্রয়, চৌধুরী টাওয়ারের চিত্ত বাবু’র দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা, স্বামীর বড়বোন অর্থাৎ ননশ এনে দেন কাঁচা মাছ ও তরকারি। তারপর মামাশ্বশুর গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলে মিলা বড়ুয়া রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়াপাড়া স্বামীর বাড়ীতে চলে যান। মিলা বড়ুয়া কোটবাজারে যখন এসব কাজ করছিলো-তখন কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট পরা একজন যুবক মিলা বড়ুয়াকে অনবরত অনুসরণ করছিলো। অসাধারণ সুন্দরী মিলা বড়ুয়া যে দিকে যায়, যুবকটা তার পিছু পিছু সেদিকে যায়। আবার মিলা বড়ুয়ার পেছনে অনুসরণ করার সময় যুবকটা কার সাথে মোবাইলে কি যেন কথা বলছিল বার বার। সুশ্রী মিলা বড়ুয়া তার কাজে ব্যস্ত থাকায় এবং যুবকটা কৌশলী হয়ে মিলা বড়ুয়াকে অনুসরণ করছিলো বলে, তা মিলা বড়ুয়া একটুও বুঝে উঠতে পারেনি। এ বর্ণনা কোটবাজার মার্কেটের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ থেকে জানা গেছে। পিবিআই এর ফরেনসিক এক্সপার্ট টিম, সিআইডি’র ক্রাইম সীন টিম ও জেলা পুলিশ সিসিটিভি’র এই ফুটেজ নিয়ে সন্দেহজনক সেই কালো প্যান্ট, আর সাদা শার্ট পরা যুবককে গত ৪ দিন ধরে হন্য হয়ে খুঁজছে। ইতিমধ্যে যুবকটির শরীরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ক’জন যুবককে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ করলেও পজেটিভ কোন কিছু উদঘাটন করতে পারেনি।
এদিকে, মঙ্গলবার ১ অক্টোবর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়া কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের নেতা প্রশান্ত ভূষন বড়ুয়াকে স্বজনহারা প্রবাসী রোকেন বড়ুয়া বলেছেন-গত ২৯ সেপ্টেম্বর রোববার তার সেই অভিশপ্ত বাড়ি পরিস্কার করার সময় পলিথিনের ব্যাগে এক কেজি আপেল পাওয়া যায়। তার স্ত্রী মিলা বড়ুয়া ও তার বোন ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কোটবাজার থেকে যে বাজার করেছিলো সে আধাকেজি আপেল, ওষুধ পত্র সহ অন্যান্য জিনিস গুলো অন্য স্থানে একত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু অতিরিক্ত পাওয়া এক কেজি আপেল নিয়ে তার বাড়িতে ঘটনার রাত্রে কে বেড়াতে এসেছিল, এই রহস্য বের করতে পারলে হয়ত ঘটনার প্রকৃত ক্লু বের হতে পারে বলে রোকেন বড়ুয়া ধারণা করছেন। এ বিষয়টাকেও গুরুত্ব দেওয়ার জন্য রোকেন বড়ুয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। এছাড়া হত্যাকান্ডের আসামীরা এখনো আইনের আওতায় না আসায় রোকেন বড়ুয়া এ অজানা আতংকে আছেন বলে সিবিএন-কে জানিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্দেহজনকভাবে এখনো ৭/৮ জনের গতিবিধি তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তারা হলো-নিহত শিশু সনী বড়ুয়ার মা রিকু বড়ুয়ার ভাই ভাগ্যধন বড়ুয়া। ভাগ্যধন বড়ুয়ার বাড়ি চকরিয়া উপজেলার কাকরা ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামে। সে ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর বুধবার দিবাগত রাত্রে মানিকপুর গ্রামে তার নিজ বাড়িতে ছিলোনা বলে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি সিবিএন-কে জানিয়েছেন। তাকে চকরিয়ার রামপুর থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনেছে। ভাগ্যধন বড়ুয়া একজন পাথরভাঙ্গার শ্রমিক ও মাংস শ্রমিক (কসাই) বলে জানা গেছে। আরো যাদের গতিবিধি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তারা হলো-নিহত ৫ বছরের শিশু সনী বড়ুয়া পিতা-শিপু বড়ুয়া, মাতা-রিকু বড়ুয়া। ২ জন কাঠুরিয়া, যাদের মধ্যে একজনের বাড়ি রাজাপালং ইউনিয়নের পিঞ্জিরকূল গ্রামে, অপরজনের বাড়ি জালিয়াপালং ইউনিয়নের পাইন্নিস্যা গ্রামে। আর হলো-কুয়েত প্রবাসী রোকন বড়ুয়ার অভিশপ্ত বাড়ীর কেয়ারটেকার ও তার ভায়রাভাই অসীম বড়ুয়া সহ মোট ৬ জন। তাদের সকলের নেয়া জবানবন্দি চুলচেরা বিশ্লেষণ ও ঘটনাবলী পরস্পর ক্রস করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডারের ঘাতক ও কেন এই পৈশাচিক হত্যাকান্ড সংগঠিত করলো সে সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এদিকে, খুন হওয়া বাড়ির ভেতরের রক্তের পায়ের চাপের সাথে স্বজনহারা রোকন বড়ুয়ার এক আত্মীয়ের পায়ের চাপ কিছুটা মিলে গেছে বলে জানা গেছে। তার গতিবিধিও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এরা সকলকে গত সোমবার ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বিভাগের জেলা কার্যালয়ে আরো অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে এবং তারা এখনো সেখানে রয়েছে। সেখানে পৃথক পৃথকভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও প্রত্যেকে একই ধরণের কথা বলায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী হত্যাকারী সনাক্ত করার ব্যাপারে হিমশিম খাচ্ছেন বলে একটি সুত্র সিবিএন-কে জানিয়েছেন।
কিন্তু সকলকে জিজ্ঞাসাবাদে বুধবার ২ অক্টোবর পর্যন্ত এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের প্রকৃত খুনী বা খুনীদের সনাক্ত করা যায়নি। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব প্রচেষ্টায় প্রায় ব্যর্থ বললে বেশী বলা হবেনা। এখন তাদের হাতে রয়েছে এক কেজি আপেল ক্যারিশমা ও কালো পেন্ট সাদা শার্ট পরা যুবককে খুঁজে বের করা। আর রক্তে পায়ের চাপ, বিভিন্ন আলামত আধুনিক ডিজিটাল ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে বের করা ফলাফলের উপর নির্ভরতা।
এদিকে, রত্নাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল আলম চৌধুরী বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবারের মধ্যে এই নারকীয় হত্যা যজ্ঞের প্রকৃত খুনীদের আইনের আওতায় আনা যাবে বলে সিবিএন-এর কাছে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম এর তত্বাবধানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান ও উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মজুমদার এই হত্যাকান্ডের প্রকৃত খুনীদের সনাক্ত করতে গত এক সপ্তাহ ধরে যে পরিশ্রম করছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাদের অসাধারণ তৎপরতায় স্থানীয় জনসাধারণ বেশ সন্তুষ্ট।
প্রসঙ্গত, উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়া পাড়ায় প্রবাসী রোকন বড়ুয়ার বাড়ীতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বুধবার দিবাগত রাত্রে রোকন বড়ুয়ার মা সুখী বালা বড়ুয়া (৬৫), সহধর্মিণী মিলা বড়ুয়া (২৫), একমাত্র পুত্র রবিন বড়ুয়া (৫) ও ভাইজি সনি বড়ুয়া (৬) কে বা কারা জবাই করে হত্যা করে। এরমধ্যে রবিন বড়ুয়া রুমখা সয়েরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির ছাত্র এবং সনি বড়ুয়া একই স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো।
এবিষয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ৪৭/২০১৯, ধারা : ফৌজদারি দন্ড বিধি : ৩০২ ও ৩৪। মামলায় নিহত মিলা বড়ুয়ার পিতা ও রোকন বড়ুয়ার শ্বশুর শশাংক বড়ুয়া বাদী হয়েছেন। মামলার এজাহারে সুনির্দিষ্ট কাউকে আসামী করা হয়নি, আসামী অজ্ঞাত হিসাবে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। মামলাটির পরিবর্তিত তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) হচ্ছেন-উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।