মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়াপাড়ায় সংগঠিত চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তভার দেওয়া হচ্ছে-পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)কে। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়া চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে দায়িত্বশীল সুত্র সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর উক্ত এলাকার কুয়েত প্রবাসী রোকেন বড়ুয়ার বাড়িতে রাত্রে যেকোন সময় তার মা সুখী বালা বড়ুয়া, স্ত্রী মিলা বড়ুয়া, একমাত্র সন্তান রবিন বড়ুয়া ও ভাইজি সনি বড়ুয়াকে কে বা কারা জবাই করে হত্যা করে। পরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক তাদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করে। ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ দিন প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও কক্সবাজার আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের প্রকৃত খুনীদের আইনের আওতায় আনতে পারেননি। হত্যাকারী সনাক্তকরণে এখনো কোন কুল কিনারা করতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই বাংলাদেশ পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে এ মামলার তদন্তভার তদন্তের জন্য বাংলাদেশ পুলিশের গঠিত ইউনিট পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) এর উপর ন্যাস্ত করা হচ্ছে। আগামী ৪ অক্টোবর শুক্রবারের মধ্যে কক্সবাজার জেলা পুলিশ ঘটনার প্রকৃত আসামীকে সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে নাপারলে পরবর্তীতে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি তদন্তদের জন্য পিবিআই কে হস্তান্তর করা হবে। পিবিআই কর্তৃপক্ষ এ ধরনের নির্দেশনা পেয়ে মামলাটির প্রকৃত খুনীদের সনাক্ত করতে কোমর বেঁধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পিবিআই এর চট্টগ্রাম অঞ্চলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সিবিএন-কে এমন আভাস দিয়েছেন।

এই চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডারের তদন্তের দায়িত্বে থাকা বর্তমান আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের প্রচন্ড চাপে রয়েছেন। শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বর্তমানে তদন্তের দায়িত্বে থাকা জেলা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আরো অধিকতর তদন্তের জন্য ৩ দিন সময় চেয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর শীর্ষ পদে রয়েছেন ২০০৮ সালে কক্সবাজারে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তা ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার (বিপিএম-পিপিএম)।

তবে রত্নাপালং ও উখিয়ার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তদন্তভার হস্তান্তরের বিষয়ে বক্তব্য হলো-মামলার খুনীদের সনাক্তকরণে গত ৬ দিনে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেনের তত্বাবধানে কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, উখিয়া সার্কেলের পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান, উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মজুমদার সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিলো বেশ লক্ষনীয়। এ বিষয়ে তদের শ্রম ও পেশাদারিত্ব ছিলো সর্বোচ্চ। দিবারাত্রি সমান ভাবে কঠোর পরিশ্রম করছেন তাঁরা। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বক্তব্য হচ্ছে-একটু দেরী হলেও এখন যাঁরা তদন্তের দায়িত্বে আছে তাঁরা স্থানীয়দের সাথে, জনপ্রতিনিধিদের সাথে, নিহতের স্বজনদের সাথে কাজ করে একটা পর্যায়ে ইতিমধ্যে পৌঁছেছেন। নতুন দায়িত্ব নিয়ে তদন্তে পিবিআই আসলে এখানে তারা নতুন হিসাবে এই হত্যাকান্ডের মোটিভ উদঘাটন করতে হয়ত আরো বেশী সময় লাগতে পারে। সে সময়ে প্রকৃত অপরাধীরা দূরে সরে যেতে পারে। তাই এই স্পর্শকাতর হত্যাকান্ডের বিষয়ে তদন্তভার পরিবর্তন করতে শীর্ষ কর্মকর্তাদের আরো চিন্তা করা দরকার বলে স্থানীয় জনসাধারণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

এদিকে, মঙ্গলবার ১ অক্টোবর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়া কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের নেতা প্রশান্ত ভূষন বড়ুয়াকে স্বজনহারা প্রবাসী রোকেন বড়ুয়া বলেছেন-গত ২৯ সেপ্টেম্বর রোববার তার সেই অভিশপ্ত বাড়ি পরিস্কার করার সময় পলিথিনের ব্যাগে এক কেজি আপেল পাওয়া যায়। তার স্ত্রী মিলা বড়ুয়া ও তার বোন ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কোটবাজার থেকে যে বাজার করেছিলো সে আধাকেজি আপেল, ওষুধ পত্র সহ অন্যান্য জিনিস গুলো অন্য স্থানে পাওয়া যায়। কিন্তু অতিরিক্ত পাওয়া এক কেজি আপেল নিয়ে তার বাড়িতে ঘটনার রাত্রে কে বেড়াতে এসেছিল, এই রহস্য বের করতে পারলে হয়ত ঘটনার প্রকৃত ক্লু বের হতে পারে বলে রোকেন বড়ুয়া ধারণা করছেন। এ বিষয়টাকেও গুরুত্ব দেওয়ার জন্য রোকেন বড়ুয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্দেহজনকভাবে এখনো ৬ জনের গতিবিধি তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তারা হলো-নিহত শিশু সনী বড়ুয়ার মা রিকু বড়ুয়ার ভাই ভাগ্যধন বড়ুয়া। ভাগ্যধন বড়ুয়ার বাড়ি চকরিয়া উপজেলার কাকরা ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামে। সে ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর বুধবার দিবাগত রাত্রে মানিকপুর গ্রামে তার নিজ বাড়িতে ছিলোনা বলে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি সিবিএন-কে জানিয়েছেন। ভাগ্যধন বড়ুয়া একজন পাথরভাঙ্গার শ্রমিক ও মাংস শ্রমিক (কসাই) বলে জানা গেছে। আরো যাদের গতিবিধি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তারা হলো-নিহত ৫ বছরের শিশু সনী বড়ুয়া পিতা-শিপু বড়ুয়া, মাতা-রিকু বড়ুয়া। ২ জন কাঠুরিয়া, যাদের মধ্যে একজনের বাড়ি রাজাপালং ইউনিয়নের পিঞ্জিরকূল গ্রামে, অপরজনের বাড়ি জালিয়াপালং ইউনিয়নের পাইন্নিস্যা গ্রামে। আর হলো-কুয়েত প্রবাসী রোকন বড়ুয়ার অভিশপ্ত বাড়ীর কেয়ারটেকার ও তার ভায়রাভাই অসীম বড়ুয়া সহ মোট ৬ জন। তাদের সকলের নেয়া জবানবন্দি চুলচেরা বিশ্লেষণ ও ঘটনাবলী পরস্পর ক্রস করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডারের ঘাতক ও কেন এই পৈশাচিক হত্যাকান্ড সংগঠিত করলো সে সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এদিকে, খুন হওয়া বাড়ির ভেতরের রক্তের পায়ের চাপের সাথে স্বজনহারা রোকন বড়ুয়ার এক আত্মীয়ের পায়ের চাপ কিছুটা মিলে গেছে বলে জানা গেছে। তার গতিবিধিও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এরা সকলকে গত সোমবার ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বিভাগের জেলা কার্যালয়ে আরো অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে এবং তারা এখনো সেখানে রয়েছে। সেখানে পৃথক পৃথকভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও প্রত্যেকে একই ধরণের কথা বলায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী হত্যাকারী সনাক্ত করার ব্যাপারে হিমশিম খাচ্ছেন বলে একটি সুত্র সিবিএন-কে জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়া পাড়ায় প্রবাসী রোকন বড়ুয়ার বাড়ীতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বুধবার দিবাগত রাত্রে রোকন বড়ুয়ার মা সুখী বালা বড়ুয়া (৬৫), সহধর্মিণী মিলা বড়ুয়া (২৫), একমাত্র পুত্র রবিন বড়ুয়া (৫) ও ভাইজি সনি বড়ুয়া (৬) কে বা কারা জবাই করে হত্যা করে। এরমধ্যে রবিন বড়ুয়া রুমখা সয়েরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির ছাত্র এবং সনি বড়ুয়া একই স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো।

এবিষয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ৪৭/২০১৯, ধারা : ফৌজদারি দন্ড বিধি : ৩০২ ও ৩৪। মামলায় নিহত মিলা বড়ুয়ার পিতা ও রোকন বড়ুয়ার শ্বশুর শশাংক বড়ুয়া বাদী হয়েছেন। মামলার এজাহারে সুনির্দিষ্ট কাউকে আসামী করা হয়নি, আসামী অজ্ঞাত হিসাবে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। মামলাটির পরিবর্তিত তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) হচ্ছেন-উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার।