সমকাল :

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিতে সুপারিশ করেছেন খোদ পুলিশ সুপার। একাধিক রোহিঙ্গার পাসপোর্ট ফরমে পাওয়া গেছে পুলিশ সুপারের সুপারিশ সংবলিত স্বাক্ষর। রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট দেওয়ার ঘটনা উদ্ঘাটন করতে গিয়ে মিলছে পিলে চমকানো আরও তথ্য। পুলিশ ভেরিফিকেশন ও নির্বাচন কমিশনকে ম্যানেজ করে ‘স্মার্টকার্ড’ পর্যন্ত বাগিয়ে নিয়েছে তারা। এতদিন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদের স্মার্টকার্ড আলোচনায় থাকলেও গণমাধ্যমের অনুসন্ধান বলছে, এমন স্মার্টকার্ড রোহিঙ্গারা পেয়েছে আরও। রোহিঙ্গাদের এমন কয়েকটি স্মার্টকার্ড এসেছে গণমাধ্যমের হাতে। আছে রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দিতে পুলিশ সুপারের সুপারিশ সংবলিত একাধিক নথিও। আবার রোহিঙ্গা পরিবারকে এনআইডি দিতে কিছু জনপ্রতিনিধিরও সুপারিশ সংবলিত নথি আছে সমকালের কাছে। এসব নথি পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও এনআইডি দেওয়ার নেপথ্যে আছে অনেক রাঘববোয়াল।

রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের শনাক্ত করতে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদক চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মাহমুদ হাসান তার কার্যালয়ে বসে সমকালকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও এনআইডি দেওয়ার পেছনে কাজ করেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। কারা কোন প্রক্রিয়ায় এ চক্রে যুক্ত হয়েছে, তা নিয়ে কাজ করছে দুদক।’ এ চক্রে কারা আছে তা বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিতে সুপারিশসহ প্রতিস্বাক্ষর করা কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘৯২ সালের দিকে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে, তাদের অনেকে জায়গা কিনে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে রয়েছে কক্সবাজারে। জনপ্রতিনিধিরাও এদের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয়তা সনদ দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন দিয়েছে এনআইডি। এ কারণে পুলিশ ভেরিফিকেশনে কোথাও কোথাও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। জ্ঞাতসারে আমি কোনো রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দিতে সুপারিশ করিনি। তৃণমূলে যে কর্মকর্তারা সরেজমিন তদন্ত করেছেন তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে আমি প্রতিস্বাক্ষর করেছি।’ কক্সবাজার যেহেতু স্পর্শকাতর এলাকা সেহেতু যাচাই-বাছাই ছাড়া এভাবে সুপারিশ করা কতটা যৌক্তিক ছিল-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুনরায় যাচাই-বাছাই করার পর্যাপ্ত জনবল আমার ছিল না। ভেরিফিকেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার মতামতের ওপর তাই আস্থা রাখতে হয়েছে আমাকে।’ তবে কক্সবাজারের বর্তমান পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় চলছে। তাই আমরা অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করছি। কোনো রোহিঙ্গা যাতে পাসপোর্ট না পায়, সে জন্য ভালো করে যাচাই-বাছাই করছি নথিপত্র। জায়গা কেনার নথি দেখালেও পুনরায় সরেজমিন গিয়ে তদন্ত করছি আমরা। একদিনে অনেকগুলো পাসপোর্টের আবেদন জমা হয় বলে পুনঃতদন্ত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।’

পাসপোর্ট ও এনআইডি পেতে কোথায় কত ধাপ : পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল ওয়ারিশ জানান, পাসপোর্ট পেতে হলে নিয়ম অনুযায়ী একটি ফরম পূরণ করতে হয় আবেদনকারীকে। এই ফরমে আবেদনকারীর স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানাসহ বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করতে হয়। দিতে হয় জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে স্থানীয় কোনো ব্যক্তির পরিচয় ও ঠিকানা। পাসপোর্টের ফরমে আবেদনকারীর দেওয়া তথ্য সরেজমিন গিয়ে যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দিতে হয় পুলিশের বিশেষ শাখাকে। সাধারণত এসআই কিংবা এএসআই পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা ঠিকানা যাচাই-বাছাই করে প্রথমে একটি প্রতিবেদন দেন। এই প্রতিবেদন পুনরায় যাচাই-বাছাই করেন পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক পদমর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা। এ দু’জনের দেওয়া তথ্য পুনরায় যাচাই-বাছাই করে প্রতিস্বাক্ষর করার কথা বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বা সমমর্যাদার কোনো কর্মকর্তার। একইভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র পেতেও পেরুতে হয় কিছু সুনির্দিষ্ট ধাপ। এনআইডি পেতে জমা দিতে হয় জন্মনিবন্ধন সনদ। আর জন্মনিবন্ধন পেতে পরিবারের অন্যদের এনআইডি, জায়গার খতিয়ান কিংবা বিদ্যুৎ বিলের কপি জমা দিতে হয়। প্রয়োজনে দিতে হয় শিক্ষা সনদের কপি। এতসব ধাপ থাকার পরও পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে রোহিঙ্গারা পেয়ে গেছে এনআইডি। কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে পেয়ে গেছে স্মার্টকার্ড।

রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দিতে পুলিশ সুপারের স্বাক্ষর : হাসিনা আকতার নামের এক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন ২০১৭ সালের ৪ মার্চ। আবেদন ফরমে তিনি স্বামীর নাম উল্লেখ করেন নুরুজ জমান। মাতার নাম নাজমা খাতুন। বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার ঘরে লেখেন- গ্রাম :তোতকখালী, রাস্তা :৩, ডাকঘর :পিএমখালী, কক্সবাজার সদর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম। উল্লেখিত ঠিকানায় এই নামে কেউ না থাকলেও কক্সবাজার বিশেষ শাখার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান, জেলা গোয়েন্দা কর্মকর্তা-১ কাজী মো. দিদারুল আলম ও পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন তাকে পাসপোর্ট দেওয়ার সুপারিশ করেন। পুলিশ সুপারের প্রতিস্বাক্ষরের ওপর লেখা আছে- ‘চরিত্র ও প্রাক-পরিচয় যাচাই করিয়া সব সঠিক পাওয়া গেল। সংশ্নিষ্ট থানা ও অত্র জেলা বিশেষ শাখায় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিরূপ কোনো তথ্য নাই।’ অথচ দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, হাসিনা আকতারের উল্লেখিত সব তথ্যই ভুয়া। আবার রোহিঙ্গা হওয়ার পরও হাসিনা আকতার ও তার স্বামী নুরুজ জমান পেয়েছে এনআইডি কার্ড। হাসিনার এনআইডি কার্ডের নম্বর- ১৯৯৩২২১২৪৪৭৪১৫৪৩২। আর তার স্বামীর এনআইডি নম্বর- ২২১২৪৪৭১১৪৬৪৪। একইভাবে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে এনআইডি নিয়েছে আরেক রোহিঙ্গা সাদিয়া বেগম (নম্বর-১৯৯২২২১২৪৪০০০০০২৪৮) ও তার স্বামী ওমর ফারুক (নম্বর-২২১২৪৪৭৪১৫৭১২)। সাদিয়া বেগমকে পাসপোর্ট দিতেও একইভাবে সুপারিশ করেছেন কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন। ২০১৭ সালের ২০ মার্চ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন রোহিঙ্গা নারী সাদিয়া। আবেদন ফরমে তিনি ঠিকানা উল্লেখ করেছিলেন- ফারুকের বাড়ি, দক্ষিণ হাজীপাড়া গ্রাম, ডাকঘর :ঝিলংজা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম। এ ঠিকানা ভুয়া হলেও ‘সব ঠিক আছে’ বলে পাসপোর্ট দিতে সুপারিশ করেন তৎকালীন পুলিশ সুপার। ২০১৭ সালে কক্সবাজারে পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা ড. একেএম ইকবাল হোসেন রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিতে এমন বেশ কয়েকটি ফরমে সুপারিশসহ প্রতিস্বাক্ষর করেছেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারে পুলিশ সুপার ছিলেন তিনি। ড. ইকবাল এখন ট্যুরিস্ট পুলিশে আছেন পুলিশ সুপারের পদে। তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে কক্সবাজারে এখন পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন এ বি এম মাসুদ হোসেন বিপিএম।

রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে স্মার্টকার্ড : সম্প্রতি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদের স্মার্টকার্ড এতদিন আলোচনায় থাকলেও এখন দেখা যাচ্ছে এমন স্মার্টকার্ডের মালিক হয়েছেন অনেক রোহিঙ্গা। এদেরই একজন হাফেজ আহম্মদ। নাবালক মিয়ার বাড়ি, আগ্রাবাদ, ডবলমুরিং, চট্টগ্রাম- এই ঠিকানা ব্যবহার করে স্মার্টকার্ড পেয়েছেন তিনি। আবার পাসপোর্টের আবেদনে তিনি ঠিকানা লিখেছেন গ্রাম :পূর্ব ধেছুয়া পালং, ওয়ার্ড নং :৪, রাবেতা, রামু, কক্সবাজার। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল তিনি এ আবেদন করেন। এতসব ঠিকানা ব্যবহারের পরও রোহিঙ্গা হাফেজ আহম্মদের হাতে গেছে নির্বাচন কমিশনের স্মার্টকার্ড (নম্বর-১৪৫৯৮০৯১৫৬)। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, হাফেজের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনও পেয়েছে স্মার্টকার্ড (নম্বর-৩২৫৮৮৩৭০১৬)।

রোহিঙ্গা হওয়ার পরও স্মার্টকার্ডধারী আরেক সৌভাগ্যবতী হচ্ছেন রাশেদা বেগম। নির্বাচন কমিশনকে ম্যানেজ করে গর্জনতলী, ৪নং ওয়ার্ড, ৭নং খুটাখালী ইউনিয়ন, চকরিয়া, কক্সবাজার ঠিকানা দিয়ে স্মার্টকার্ড পেয়েছেন তিনি (নম্বর-২৩৭৮৭২৫৯৪৫)। ৭নং খুটাখালী ইউনিয়ন থেকে ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর জন্মসনদও নিয়েছেন। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাসপোর্ট পেতেও আবেদন করেন তিনি।

রেহেনা আকতার নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী পেয়েছেন নির্বাচন কমিশনের স্মার্টকার্ড (নম্বর-৩২৮৪২৩১৩৪১)। দরগাপাড়া, খুটাখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার ঠিকানা দিয়ে স্মার্ট কার্ড পেয়েছেন তিনি। ২০১২ সালের ১৩ মে একই ইউনিয়ন থেকে জন্মসনদও নিয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গা হলেও তার মা লায়লা বেগম (নম্বর-৪৬১৬০২৯৪৩৭), ভাই নুরুল আলম (নম্বর-৮২২৮৪৯৭৯০৮) এবং মো. শওকত ওসমানও (নম্বর-৫৫২৪৮৭০৬৮৯) পেয়েছেন নির্বাচন কমিশনের স্মার্টকার্ড।