মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

উখিয়া উপজেলার পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়া পাড়া গ্রামে একই বাড়িতে বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত্রে যেকোন সময় জবাই করে ৪ জনকে খুন হওয়ার বিষয়ে উখিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নম্বর ৪৭/২০১৯, তারিখ : ২৬/৯/২০১৯ ইংরেজি। ধারা : ফৌজদারি দন্ড বিধি : ৩০২ ও ৩৪। মামলায় নিহত মিলা বড়ুয়ার পিতা ও রোকন বড়ুয়ার শ্বশুর শশাংক বড়ুয়া বাদী হয়েছেন। মামলার এজাহারে সুনির্দিষ্ট কাউকে আসামী করা হয়নি, আসামী অজ্ঞাত হিসাবে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। বিষয়টি উখিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ আবুল মনসুর ও ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন।

কুয়েত প্রবাসী রোকন বড়ুয়া শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯ টায় বিমানযোগে কক্সবাজার পৌঁছেন। সেখান থেকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ৪ আপনজনের লাশ দেখতে মর্গে যান। সেখানে রোকন বড়ুয়ার জম্মদাতা মা সখী বড়ুয়া (৬৪), স্ত্রী মিলা বড়ুয়া (২৫), পুত্র রবিন বড়ুয়া (৫) ও ভাইঝি সনি বড়ুয়ার নিথর ও রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে নির্বাক হয়ে যান। মৃতদেহ ৪ টির শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষ করে বেলা আড়াইটার দিকে পূর্ব রত্না পালং বড়ুয়াপাড়ায় রোকন বড়ুয়ার সেই অভিশপ্ত বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। রোকন বড়ুয়ার বাড়ীতে ৪ জনের মৃতদেহ পৌঁছালে সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। হাজার হাজার মানুষের আহাজারিতে সেখানকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলে তাকে একাকী নিঃস্ব করে ফেলা কেউ সহজে মেনে নিতে পারছেন না। এরপর প্রায় ২ ঘন্টা ধরে বৌদ্ধ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মহাঅনিত্য সভা সম্পন্ন করা হয়। মহাঅনিত্য সভায় অংশ নেয়া বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যান ট্রাস্টের ট্রাস্টি এডভোকেট দীপংকর বড়ুয়া পিন্টু সিবিএন-কে জানান, রামু উপজেলার ফারিকুল বৌদ্ধ বিহারের পরিচালক বিজয় রক্ষিত মহাথেরোর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত মহাঅনিত্য সভায় জ্ঞাতি করেন-উখিয়া উপজেলা ভিক্ষু সমিতির সভাপতি ধর্মপাল মহাথেরো। মহাঅনিত্য সভায় ধর্মীয় বক্তব্য রাখেন প্রজ্ঞাবোধি মহাথেরো, জীনানন্দ মহাথেরো, রত্নাপালং আনন্দ বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ জ্যেতিলায়নথেরো, ইন্দ্রবংশ মহাথেরো, শাসনোপ্রিয় থেরো প্রমুখ। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু (ভিক্ষু), জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সহ হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে বলে কক্সবাজার জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সিনিয়র প্রেসেডিয়াম সদস্য উদয় শংকর পাল মিটু সিবিএন-কে জানিয়েছেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মহাঅনিত্য সভা শেষে মধ্য রত্নাপালং খোন্দকার পাড়া বৌদ্ধ শ্মশানে একইদিন বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে ৪ জনকে সমাহিত করা হয়। এখানেও হাজার হাজার বৌদ্ধ ধর্মালম্বী ও সর্বস্থরের মানুষের ভীড় জমে যায়। পুরো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও সমাহিত করার প্রক্রিয়াটিতে চলছিলো শোকের মাতম। সবার একটি প্রশ্ন, ‘এতবড় হত্যাকান্ড কে বা কারা সংগঠিত করলো।’

এদিকে, শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপরেশনস এন্ড ক্রাইম) আবুল ফয়েজ চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডারের ঘটনাস্থল পরিদর্শন, এবিষয়ে জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছেন বলে বিশ্বস্থ সুত্র সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন। হত্যাকান্ডের অনেক ক্লু ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে, তবে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ এসব ক্লু প্রকাশ করছে না। একজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তাঁরা চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডারের মোটিভ উদঘাটনে প্রায় শেষপর্যায়ে এসেছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, সিআইডি’র ক্রাইম সিন টিমের রিপোর্ট, পিবিআই এর চট্টগ্রাম থেকে আসা ফরেনসিক এক্সপার্ট টিমের রিপোর্ট, অন্যান্য সংগ্রহকৃত আলামত ও তথ্য উপাত্ত সহ সমন্বিত করে প্রকৃত খুনীদের নাম ঠিকানা বের করে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে, চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার নিয়ে স্থানীয় কিছু লোকজন ধারণামূলকভাবে রোকন বড়ুয়ার ভাই শিবু বড়ুয়ার স্ত্রী রিকু বড়ুয়া ও তার বাড়িতে থাকা টমটম (ই-বাইক) ড্রাইভারের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছেন। কারণ বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে খুনের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রিকু বড়ুয়ার স্বামী শিবু বড়ুয়া উক্ত টমটম (ই-বাইক) ড্রাইভারকে খুঁজলে রিকু বড়ুয়া উক্ত টমটম ড্রাইভার কোটবাজারে গেছে বলে কর্কশ ভাষায় উত্তর দেন এবং রিকু বড়ুয়া থেকে উক্ত টমটম ড্রাইভারের মোবাইল নম্বর চাইলে রিকু বড়ুয়া মোবাইল নম্বর দিতে স্বামীকে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ নিয়ে ঘটনাস্থলে উভয়ের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হয় বলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জনপ্রতিনিধি সিবিএন-কে জানিয়েছেন। এছাড়া চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডারে রিকু বড়ুয়া’র ৫ বছরের কন্যা সনি বড়ুয়া খুন হলেও বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর দৃঢ় মনোবল নিয়ে হত্যাকান্ড সম্পর্কে গণমাধ্যমে একনাগাড়ে সাক্ষাতকার দিচ্ছিলেন। নিজের মেয়ে খুন হওয়ার পরও এভাবে শক্ত মানসিকতা নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলা একজন মা হয়ে রিকা বড়ুয়ার কাছে কিভাবে সম্ভব হলো তা সবার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই রিকু বড়ুয়াই গণমাধ্যমে রোকন বড়ুয়া ও শিবু বড়ুয়ার মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে পূর্বশত্রুতা রয়েছে বলে দৃঢ়তার সাথে গণমাধ্যমকে বলেছেন। আবার যে টমটম (ই-বাইক) ড্রাইভারের কথা বার বার উঠে আসছে সেও রিকা বড়ুয়ার বাপের বাড়ি চকরিয়া উপজেলার কাকরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও রিকু বড়ুয়ার নিকটাত্মীয় বলে জানা গেছে। রোকন বড়ুয়ার পরিবার আগে খুব একটা স্বচ্ছল ছিলোনা। পরে রোকন বড়ুয়া কুয়েত গিয়ে সেখানে পরিশ্রম করা অর্থে তার পরিবারে বেশ আর্থিক স্বচ্ছলতা আসলে তাতে রিকা বড়ুয়া খুব পরশ্রীকাতর হয়ে উঠে বলে রোকন বড়ুয়ার প্রতিবেশীরা সিবিএন-কে জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, খুন হওয়া রোকন বড়ুয়ার স্ত্রী মিলা বড়ুয়া (২৫) সুন্দরী মহিলা হওয়ায় হয়ত নারী ঘটিত কারণেও এই হত্যাকান্ড ঘটতে পারে বলে অনেকের ধারণা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষন জাতীয় পরোক্ষ কিছু আলামতও তাঁরা ঘটনাস্থলে পেয়েছেন বলে সিবিএন-কে জানান। স্থানীয় জনসাধারণের মতে, মিলা বড়ুয়া খুবই সংরক্ষণশীল ছিলো।

এদিকে, উখিয়া থানা পুলিশ হত্যাকান্ডের মোটিভ উদঘাটনে খুন হওয়া সনী বড়ুয়া’র পিতা শিবু বড়ুয়া ও তার স্ত্রী রিকা বড়ুয়া, তাদের বাড়িতে থাকা উক্ত টমটমের ড্রাইভার সহ মোট ৫ জনকে বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় উখিয়া থানায় আনা হয়েছিল। উখিয়া থানা কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানার পর তাদেরকে একইদিন রাত্রে ছেড়ে দিয়েছে বলে উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার সিবিএন-কে জানিয়েছেন।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন ও উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান, উখিয়ার ইউএনও নিকারুজ্জামান, র‍্যাবের কর্মকর্তারা, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি ও হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ কক্সবাজারের নির্বাহী সভাপতি এডভোকেট দীপংকর বড়ুয়া পিন্টু, উখিয়ার ওসি মোহাম্মদ আবুল মনসুর, ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার, রত্নাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল আলম চৌধুরী সহ প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও ধর্মিয় নেতারা বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

প্রবাসী রোকন বড়ুয়ার ঘরের ভিতর খুন হয়ে থাকা প্রতিটি লাশের গলায় জবাই এর চিহ্ন ছিলো। খুন হওয়া ঘরের ভিতর টেলিভিশন চলমান ছিল, নাস্তার প্লেটে নাস্তা ছিলো, বাড়ির দরজা, জানালা বন্ধ ছিল। এক রুমে ৪ টি বালিশ ছিলো। কিন্তু খুন হওয়া ৪ টি মৃতদেহ পাওয়া গেছে পৃথক ৩ টি রুমে। স্থানীয় দীপালি বড়ুয়া নামক একজন মহিলা পুজোর ফুল কুড়াতে গিয়ে বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৬ টার দিকে দরজার নীচ থেকে খুন হওয়া সখী বড়ুয়ার রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখতে পেয়ে স্থানীয় লোকজনকে জানায়। স্থানীয় লোকজন তাৎক্ষণিক উখিয়া থানা পুলিশ ও ইউপি মেম্বার ডা. মোকতার আহমদকে খবর দেয়।

প্রসঙ্গত, উখিয়া উপজেলার রত্মাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়াপাড়ায় বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে একটি বাড়িতে একই পরিবারের জবাই করা ৪ জনের লাশ পাওয়া যায়। লাশ ৪টি হলো মৃত প্রবীণ বড়ুয়ার স্ত্রী (১) সখী বড়ুয়া (বয়স-৬৩), সখী বড়ুয়ার পুত্র, কুয়েত প্রবাসী রোকন বড়ুয়ার স্ত্রী (২) মিলা বড়ুয়া (বয়স-২৫), মিলা বড়ুয়ার পুত্র (৩) রবীন বড়ুয়া (বয়স-৫), শিবু বড়ুয়ার কন্যা (৬) সনী বড়ুয়া (বয়স-৬) সহ ৪ জন। খুনের খবর পেয়ে পুলিশ বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে বাড়ির চাদের উপর উঠে চিলাকোঠা দিয়ে সিড়ি দিয়ে নীচে প্রবেশ করে ৪ টি জবাই করা লাশ দেখতে পায়। পরে তাঁরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে খবর দেন।