এইচ এম আবু ছিদ্দিক

স্রষ্টার অনবদ্য সৃষ্টি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদে পরিপূর্ণ কক্সবাজার জেলার অন্যতম আকর্ষণ সবুজ পাহাড়ঘেরা সমুদ্র সৈকতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, “পৃথিবীর ভিতরেই যেন, অভিনব এক পৃথিবী”।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেসব পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে, দীর্ঘ প্রবাস জীবনে ২/১টি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেগুলো দেখতে প্রথমে ভাল লাগলেও দ্বিতীয়বার আকর্ষণীয় মনে হয় না। কক্সবাজারের প্রাকৃতিক দৃশ্য এতই সুন্দর, যতই দেখি ততই নিজেকে উৎফুল্ল ও সতেজ মনে হয়। বারবার দেখা সত্ত্বেও আবার দেখতে ইচ্ছে করে। সু- নির্দ্বন্দ্বে বলা যায়, বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়তে হলে, সমুদ্র গবেষণা ও পর্যটন শিল্পের বিকল্প নেই।

কক্সবাজার জেলায় পর্যটন শিল্প ছাড়াও মংস্য, লবন, সুটকি, রাবার ও সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুকসহ মূল্যবান বহু সম্পদ এদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। শুধু তাই নয়, কক্সবাজারের প্রকৃতি ও বিশ্বসেরা দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এ প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণসহ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ অত্যাবশ্যক।

ইতিমধ্যেই ডাইবেটিক পয়েন্ট বিমান বাহিনীর দখলে চলে গেছে। লাবনী পয়েন্টে বিজিবি, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও জেলা পরিষদের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনসহ শেখ কামাল স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও মহাজোট মার্কেট করায় বীচের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।

সুগন্ধা পয়েন্টে কয়েকশ ঝুপড়ি দোকানঘর ও ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে শ্বাস নেয়া কষ্টসাধ্য।

কলাতলী থেকে শহরে যাতায়তের জন্য একটিমাত্র প্রধান সড়ক। অনেক সময় কথিত ভিআইপিদের আগমনে প্রধান সড়কটি বন্ধ করে দেয় আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী। তখন যানজটের কারণে পর্যটকসহ স্থানীয়রা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেনা। বিকল্প সড়ক না থাকায় প্রায় সময় এই সমস্যায় পড়তে হয়। সৈকত আবাসিক এলাকার পূর্বপার্শ্বের পাহাড় লাগোয়া সড়কটি সম্প্রসারণ ও সংস্কার করে বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা করা হলে যানজট অনেকটা নিরসন হবে বলে আমার বিশ্বাস।

কক্সবাজার শহরের সড়ক বা উপসড়ক, প্রতিটি রাস্তায় যেন এক একটি ভাইব্রেইশ্ন যন্ত্র। একটু হালকা থেকে মাঝারি ধরণের বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। বিশেষ করে শহরের প্রধান সড়ক ও পর্যটকদের আবাসনকেন্দ্র সৈকত আবাসিক এলাকার উপসড়কগুলোর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।

রাস্তার কাজ একেবারে হয়না সেটা বলা যাবে না। অতি সুবিধাভোগী কথিত ভি,আই,পিরা যখন কক্সবাজার আসে। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙ্গে। রাতের অন্ধকারে হলেও তড়িগড়ি করে রাস্তার খানাখন্দ সমান করে তাদের নিরাপদে যাতায়তের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবার যেই রাস্তা, সেই ডোবা।

জোড়াতালি দিয়ে ভি,আই,পি উন্নয়ন জনগনের করের টাকা অপচয় ও লুটপাট ছাড়া, পর্যটন শহরের টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। এসব ভিআইপি উন্নয়নের কাজের মান ও বাজেট নিয়ে জবাবদিহিতা নেই বলে দুর্নীতির সুযোগ থাকে বেশী।

স্থানীয় সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে।

কক্সবাজার জেলায় এখনো পর্যন্ত বড় ধরণের কোন শিল্প-খারখানা গড়ে উঠেনি। বলতে গেলে পুরোপুরি পর্যটক নির্ভর একটি শহর। দেশী-বিদেশী যেসব পর্যটক কক্সবাজার বেড়াতে আসে। অন্তত একবার হলেও বার্মিজ মার্কেটসহ শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ান।

পর্যটন শিল্পের স্বার্থে হোক, বা স্থানীয়দের দুর্ভোগ লাঘবে হোক, শহরের প্রধান সড়কসহ উপসড়কগুলো সংস্কার ও প্রশস্তকরণ অত্যন্ত জরুরী। তাছাড়া রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্নসহ প্রত্যেক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন শুধু জেলার উন্নয়ন নয়, জাতীয় উন্নয়ন। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কক্সবাজার জেলাটি যতই উন্নত হবে, বাংলাদেশ ততই এগিয়ে যাবে। তবে শর্ত একটাই, উন্নয়ন করতে গিয়ে যেন প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি না হয়।

টেকনাফ উপজেলায় চাষ যোগ্য কৃষি জমিসহ প্রায় ১ হাজার ১৬৫ একর বীচ দখল করে বিদেশী পর্যটকদের জন্য এক্সক্লুসিভ টুরিস্ট জোনে ক্যাসিনোসহ (অর্থাৎ জুয়ার আসরসহ) আধুনিক সব আয়োজনের কথা বলেছে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক। তিনি পরিষ্কার ভাষায় এও বলেছেন। সেখানে দেশের মানুষেরা ঢুকতে পারবে না। শুধু বিদেশীরা পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রবেশাধিকার পাবে। আধুনিক সব আয়োজন বলতে তিনি কি কোন অবৈধ ব্যবসার কথা ভাবছেন? তা নাহলে দেশের নাগরিকদের ঢুকতে না দেয়ার প্রশ্ন আসে কেন?

সারাদেশে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চললেও টুরিস্ট এলাকায় অবৈধ জুয়াখেলা দেশের প্রচলিত আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। এমন অবৈধ জুয়াখেলার আসর বসিয়ে যারা পর্যটন শিল্পের উন্নতির কথা ভাবছেন। তারা হয়তো জ্ঞানপাপী, নতুবা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিদেশ থেকে যারা এখানে জুয়া খেলতে আসবেন। তাদের ভিসা দেয়া উচিত নয়। পর্যটক দেশী হোক, বা বিদেশী হোক, কোন অবস্থাতেই বৈষম্য করা ঠিক হবে না।

কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প হচ্ছে প্রকৃতি নির্ভর। প্রকৃতির টানে দেশী-বিদেশী লক্ষ লক্ষ পর্যটক বেড়াতে আসে কক্সবাজার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যতদিন সংরক্ষণ থাকবে, ততদিন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ কক্সবাজার বেড়াতে আসবে। যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ করে প্রকৃতির শোরুম, সমুদ্রসৈকতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ধ্বংস করলে অদুর ভবিষ্যতে পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

এক্সক্লুসিভ টুরিস্ট জোনের অজুহাতে এসব প্রকল্প দিয়ে সুবিধাভোগীরা সাময়িক লাভবান হলেও, দীর্ঘ মেয়াদী পর্যটন শিল্প ও আগামী প্রজন্মের জন্য প্রকল্পটি হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে, সর্বশেষ আমও যাবে, ছালাও যাবে।

সুতরাং- পুরো সৈকত এলাকাজুড়েই বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে পর্যটকদের আকর্ষণীয় করাসহ দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত এলাকাজুড়েই এক্সক্লুসিভ টুরিষ্ট জোনের পরিবর্তে, এক্সক্লুসিভ ন্যাচারাল জোন ঘোষণা দেওয়ার দাবী জানাচ্ছি।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি যতদ্রুত সম্ভব, ছয় লেনে প্রশস্তকরণসহ আরও একটি বিকল্প মহাসড়ক করা যায় কিনা, তাও আলোচ্য বিষয়।

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।