বিদেশ ডেস্ক:

রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় মিয়ানমারের কঠোর সমালোচনা করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দফতরে ওআইসি এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন কর্তৃক আয়োজিত এক বৈঠকে তিনি বলেন, রাখাইনে যা ঘটেছে তা স্পষ্টত গণহত্যা। মাহাথির মনে করেন, মিয়ানমার এই সংকট সমাধানে আগ্রহী নয় বলে সেই দায় এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাকালিন উদ্দেশ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে এই সংকট নিরসনে তিনি সংস্থাটিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাত লাখেরও বেশি মানুষ। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানাবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার আলামত। তবে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। দেশটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ও রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি’ও রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে সক্ষম হননি। বরং গণহত্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতরে স্থানীয় সময় বিকালে ওআইসি সেক্রেটারিয়েট ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সংকট: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন মাহাথির। সে সময় তিনি বলেন, আসুন সোজাসাপ্টা কথা বলি। রাখাইনে যা ঘটেছে তা গণহত্যা। সেখানে গণহত্যা, পদ্ধতিগত ধর্ষণসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।মিয়ানমারের দাবি, সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবেলায় তারা রাখাইনে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এখন মিয়ানমার যেহেতু এ সমস্যার সমাধানে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, তখন এর সমাধানের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপরই বর্তায়। ভবিষ্যতে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখন সংস্থাটির উচিত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখা।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর কোনও প্ল্যাটফর্মে এটিই মাহাথিরের প্রথম ভাষণ। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। ড. মাহাথির বলেন, ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় আমরা বাংলাদেশকে সাধুবাদ জানাই। মালয়েশিয়াও যতটুকু সম্ভব করার চেষ্টা করেছে।
মাহাথির জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার বাইরেও কক্সবাজারে একটি ফিল্ড হসপিটাল পরিচালনা করছে মালয়েশিয়া। ওই হাসপাতালের পাশেই এক লাখ নিবন্ধিত শরণার্থী রয়েছে। এছাড়া আরও বহু অবনিবন্ধিত শরণার্থীও রয়েছে সেখানে। তারপরও বাংলাদেশের জন্য এটি অপ্রতুল। রোহিঙ্গাদের ভালো জীবনযাপনের জন্য বাংলাদেশ প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমরাও আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সাহায্য করবো। আশা করি অন্যান্য দেশগুলোও এগিয়ে আসবে। এই সংকটের অবসান ঘটনো দরকার এবং এটি এখনই করা দরকার। তিনি বলেন, শরণার্থীরা যত দিন শিবিরে থাকবে ততই তারা আরও হতাশ ও মরিয়া হয়ে উঠবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে যা হয়, সেটি হচ্ছে শরণার্থীরা অন্য ধরণের শোষণের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তারা মানব পাচার এবং যৌন দাসত্বের মতো ঘটনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তারা কেবল সামনে একটি হিমশীতল ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।
মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ভালো ছিল না। কারণ রাখাইনের বহু রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবেই বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছিল। মিয়ানমারকে এর প্রমাণ দেওয়া উচিত যে, সংকট নিরসনে তারা সিরিয়াস ছিল। এক্ষেত্রে তাদের উচিত প্রত্যাবাসনকে প্রধান অগ্রাধিকার দেওয়া। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন মাহাথির। তিনি বলেন, এর কারণগুলো স্পষ্ট। কেউ যদি তার সুরক্ষার নিশ্চয়তা বোধ না করে তবে সে ফিরবে না। এজন্য রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বতঃস্ফূর্ত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ওপর মালয়েশিয়া জোর দিচ্ছে। এটি শুধু রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দেওয়ার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বাইরে অন্যদেরও এ সংকট সমাধান এবং অপরাধীদের বিচারের জন্য ভূমিকা নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরবেন। সংকট নিরসনে বিশ্বনেতাদের সামনে চার প্রস্তাব তুলে ধরা হবে। বৈঠকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে।