তাজুল ইসলাম পলাশ, চট্টগ্রাম ব্যুরো:
রাজধানী ঢাকায় একের পর এক অভিযানের পর চট্টগ্রামে অভিযান চালানোর পরও আটক হয়নি কোনো জুয়াড়ি। প্রায় অর্ধশত ক্লাবে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব উদ্যোগে বন্ধ রাখা হয়েছে জুয়ার আসর। গা ঢাকা দিয়ে জুয়াড়ি ও পরিচালনায় জড়িত প্রভাবশালীরা। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এরমধ্যে তিনটিতে জুয়ার আসর বসতো বলে র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ঢাকায় যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইয়াং মেন্স ক্লাব সহ কয়েকটি ক্যাসিনোতে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের পর চট্টগ্রামে তৎপর হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, অনুমোদিত এবং অনুমোদনহীন সবগুলো বার ও ক্লাবে জুয়ার আসর বন্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। এর নেপথ্যে যত বড় প্রভাবশালী থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। চট্টগ্রামে এধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, পুলিশ প্লাজাসহ নগরীর সকল ধরনের জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও জুয়ার আসর চালু রাখায় হেং আউটে অভিযান চালানো হয়। এতে ভিত নড়ে উঠে প্রভাবশালী জুয়াড়িদের।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, জুয়ার কারণে পরিবারে অশান্তি ও বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটছে। অনেকে জুয়া খেলাকে পেশায় পরিণত করেছে।
অনুসন্ধান বলছে, পুলিশের তালিকায় চট্টগ্রামে জুয়ার আসর মাত্র ৩২টি। কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা দুই শতাধিক। যেখানে রাত-দিন লেনদেন হয় লাখ লাখ টাকা। এসব আসরে চলে মাদকের কারবার। ক্লাবভেদে চলে পতিতার ব্যবসাও। আর এসব অপরাধে জড়িতদের বেশিরভাগই কোটিপতি প্রভাবশালী। অভিজাত ক্লাবগুলোতে প্রতিদিন জুয়ার বোর্ড থেকে আয় হয় লক্ষাধিক টাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জ্ঞাতসারেই এসব ক্লাব ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে বাসা-বাড়ি ও সামাজিক সংগঠনের কক্ষে বসে জুয়ার আসর। নামি-দামি হোটেলেও চলে জুয়া খেলা। ক্লাবগুলোতে জুয়ার বোর্ড বসিয়ে সাপ্তাহিক, মাসিক বা দৈনিক ভিত্তিতে টাকা তোলা হয়। এসব টাকা যায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশে উর্দ্বতম কর্মকতা ও ক্লাব পরিচালনায় জড়িত কর্মকর্তাদের পকেটে। একইসঙ্গে চলে নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিকিকিনি ও অসামাজিক কার্যকলাপ। নগরীতে মোহামেডান ক্লাব, আবাহনী ক্লাব, চট্টগ্রামে ফ্রেন্ডস ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, অফিসার্স ক্লাব, ওয়াজি উল্লাহ ইনস্টিটিউট, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ক্লাব, বন্দর রিপাবলিক ক্লাব, পুলিশ প্লাজাসহ চকবাজার, আগ্রাবাদ, হালিশহর, ডবলমুরিং, জিইসি, অক্সিজেন, পাথরঘাটা, বিআরটিসি ও পাহাড়তলী এলাকায় অনুমোদিত যেসব বার এবং ক্লাবে দীর্ঘদিন ধরে বসছে জুয়ার আসর। আর জুয়ার টাকায় চলছে ক্লাবগুলো পরিচালনার আনুষঙ্গিক খরচ। জুয়া খেলে অনেকে নিঃস্বও হয়েছেন।
সূত্র জানায়, হালিশহরে আবাহনী ক্লাব লিমিটেডের সভাপতি হিসেবে রয়েছে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এমএ লতিফ, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন একই দলের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। অন্যদিকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি শাহ আলম বাবুল ও সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন শাহবুদ্দিন শামীম। এরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। নামে ক্লাব হলেও সেখানে কোনো ক্রীড়া সামগ্রী নেই। প্রতিদিনই বসতো মদ ও জুয়ার আসর। লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা চলতো সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। টাকার বেশিরভাগ অংশ চলে যেত ওই এমপির তহবিলে। ক্লাবটি পরিচালনায় ওই এমপি থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করতেন যুবলীগ নেতা সালেহ আহমেদ দীঘল। তাছাড়া বিভিন্ন ক্লাবের সাথে জড়িত আছে সরকার দলীয় লোক।
সংশ্লিষ্টদের মতে, নগরীর হালিশহরের জে ব্লকের আবাহনী ক্লাবটিতে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী এক যুবলীগ নেতার মদত রয়েছে। এ ক্লাবের জুয়ার আসরের লেনদেন কোনো দিন কোটি টাকা পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। তবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ক্লাবটির ভেতরে তিন-চারটি কক্ষে থাকা জুয়ার আখড়াগুলো বন্ধ করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নগরীর এ কে খান মোড় এলাকায় একটি ভবনের তিনতলা ও চারতলা ভাড়া নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ক্লাব নাম দিয়ে জুয়ার আসর বসানো হয়। প্রতিদিন শতাধিক লোক সেখানে জুয়া খেলে ও মাদক গ্রহণ করে। বায়েজিদের আমিন কলোনি এলাকার আশপাশে অন্তত ৫টি স্থানে জুয়ার আসর বসে। আমিন কলোনি বেলতলা এলাকা, আমিন কলোনির মাঠ এলাকা, টেক্সটাইল জিএম বাংলো পাহাড়ের উপর, রউফাবাদ রেলক্রসিং এলাকা, স্টারশিপ গলি,শান্তিনগর কলোনিতে জুয়ার আসর বসে বলেও স্থানীয়রা তথ্য দিয়েছেন। বাকলিয়া থানা এলাকার শাহ আমানত সেতু এলাকা ঘিরে রয়েছে ১২টি জুয়ার আসর। এরমধ্যে চাক্তাই সি-বিচ কলোনির জুয়ার আসর অন্যতম। এ ছাড়া কর্ণফুলীর তীরে সীমার বাপ নামে পরিচিত খোরশেদ আলম, আবদুর রহমান ও কায়সারের মালিকানাধীন জুয়ার আসর রয়েছে। এ ছাড়া চাক্তাই চামড়ার গুদাম এলাকায় রয়েছে মমিন ও মামুনের জুয়ার আসর। কোতোয়ালি থানাধীন জলসা মার্কেটের ষষ্ঠ তলায়, গোয়ালপাড়া এলাকায়, আলকরণে সিলকন হোটেল গলিতে, কাজির দেউড়ি এলাকায়, স্টেশন রোডের ফলমন্ডি এলাকায় রেলওয়ে মেন্স সেন্টার, পলোগ্রাউন্ড মেলা কমিউনিটি সেন্টার, এনায়েত বাজার বাটালি রোড, নন্দনকানন আরএফ পুলিশ প্লাজায় চলে জুয়ার আসর। ডবলমুরিং থানাধীন দেওয়ানহাট ব্রিজের নিচে, আগ্রাবাদ সাউথ ল্যান্ড সেন্টার ভবনের পঞ্চম তলায়, পান্না পাড়ায়, মনসুরাবাদ মাঠের সামনে, ভেলোয়ার দীঘির পাড়ে, ঝর্ণাপাড়া, হাজী পাড়ায়, পাঠানটুলী জুয়ার আসর বসে। এ ছাড়াও সদরঘাট রোডে হোটেল শাহজাহান, চকবাজার আলিফ প্লাজা, চান্দগাঁও আবাসিক এ ব্লকে দৃষ্টি ভবন, শমসের পাড়া জানু মিস্ত্রির বাড়ি, বহদ্দারহাট মদিনা হোটেলের পাশের বিল্ডিং, খুলশী ৪ নম্বর, মেহেদীবাগ ন্যাশনাল হাসপাতাল সংলগ্ন গলি, ডিসি রোড খালপাড়ে চলে জুয়ার আসর।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোস্তাইন হোসাইন বলেন, জুয়া এ দেশে নিষিদ্ধ। ১৮৬৭ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন বাংলাদেশে এখনো প্রযোজ্য। সেই আইন অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
এদিকে গত শনিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও আবাহনী ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। আর পুলিশ অভিযান চালায় নগরির ফ্রেন্ডস ক্লাব ও শতদল ক্লাবে।
মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদে অভিযান চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। পরে এ ক্লাব থেকে কিছু দূরে সদরঘাট এলাকার মোহামেডান ক্লাবে যায় র‍্যাবের একটি দল। ক্লাবে কার্ড ও জুয়া খেলার বিভিন্ন আলামত পান র‍্যাবের কর্মকর্তারা। খাতা ঘেঁটে ক্লাবটিতে ১৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) পর্যন্ত কার্ড খেলার হিসাব পাওয়া গেছে। ঢাকায় জুয়ার আসর ও অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযানের পর বন্ধ রাখা হয় ক্লাবটি।
পরে নগরির হালিশহর এলাকার আবাহনী ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। সেখানেও একই ধরনের আলামত মেলে। কিন্তু চলমান অভিযানের ভয়ে কয়েকদিন আগে থেকে ক্লাবটি বন্ধ রাখা হয় এবং জুয়ার বোর্ডসহ খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলা হয়। পরে আবাহনী লিমিটেডের ব্যানার সরিয়ে বাইরে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যানার লাগানো হয়।
র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নিজামউদ্দিন বলেন, অন্য দুটি ক্লাবের মতো এখানেও একই ধরনের আলামত মিলেছে। তবে ক্লাবটিতে কেউ ছিল না। ধারণা করছি, চলমান অভিযানের কারণে তারা জুয়া বন্ধ রেখে গা ঢাকা দিয়েছে।