ডেস্ক নিউজ:
জি কে শামীম। পুরো নাম গোলাম কিবরিয়া শামীম। এক সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ যুবদলের নেতা ছিলেন। কিন্তু এক দশক থেকে যুবলীগ নেতা! সব সম্ভবের দেশে এটি হয়তো স্বাভাবিক ঘটনা।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার বড় পরিচয় তিনি গণপূর্তের প্রতাপশালী ঠিকাদার। বিশেষ জাদুবলে পূর্তের প্রায় সব কাজই তার কব্জায়। তাই ঘুষ কমিশনও দেন দু’হাত ভরে। সাবেক এক মন্ত্রীকে ঘুষ দিতেন রীতিমতো বস্তাভরে। গাড়িতে নিজেই পৌঁছে দিতেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।

শুধু মন্ত্রী নন, এভাবে ভাগ পেতেন প্রভাবশালী আমলা ও প্রকৌশলীরাও। নিজের রাজ্যের অঘোষিত এ ‘রাজা’ শুক্রবার র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই বেরিয়ে আসে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এদিকে হঠাৎ ক্যাসিনো-ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে যুবলীগের আন্ডারওয়ার্ল্ড। এই সুনামির তোড়ে ভেসে যাচ্ছেন অনেকে। আত্মগোপনে গিয়েও রেহাই পাচ্ছেন না। কোনো ‘ক্ষমতাধর লীগই’ টিকতে পারছে না আপসহীন এ অভিযানে। একে একে মুখোশ খুলে যাচ্ছে অনেকের।

সূত্রগুলো বলছে, সবে শুরু। এখনও বহু রথী-মহারথী বাকি আছে। একে একে সবাই ধরা পড়বে। শুধু রাজধানী ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সরকারি দলের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে যারা সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন তাদের কারোরই রেহাই হবে না এ যাত্রায়। এটি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ বার্তা।

সূত্র জানায়, যুবলীগের হর্তাকর্তাদের অনেকেরই এখন নির্ঘুম রাত কাটছে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করছেন। তবে ইতিমধ্যে বিমানবন্দরসহ সব সীমান্ত পথে এ তালিকার সন্দেহভাজনদের ছবিসহ নাম-ঠিকানা পাঠিয়ে বিদেশ গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় আড়াইশ যুবলীগ নেতার তালিকা ধরে গ্রেফতার অভিযান চালানো হচ্ছে।

সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম তার ৫টি ব্যাংকে ৭শ’ কোটি টাকা জমা থাকার তথ্য দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। কয়েক মাস আগে সেখানেও বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রেখেছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির মাধ্যমে জি কে শামীম বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার নিকেতন ও বাসাবো এলাকায় ৫টি করে ১০টি বহুতল বাড়ি, বাসাবোতে ১ বিঘার একটি বাণিজ্যিক প্লট, পর্যটন শহর বান্দরবানে একটি ৩ তারকা মানের রিসোর্টসহ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত ৯টায় আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।

সূত্র বলছে, ঢাকার যুবলীগ নেতাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকার শীর্ষে আছেন যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, রফিকুল ইসলাম রফিক, শাহে আলম মুরাদ, আরমানুল হক আরমান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, কাউন্সিলর সেন্টু, জসিম, এপিএস মিজান ও জনৈক যুবলীগ নেতা নিখিল।

এছাড়া তালিকায় রাজধানীর বিভিন্ন থানার ৫ জন ওসিসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। এসব অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার বিলাসী জীবনযাপনের তথ্য সংগ্রহসহ তাদের ক্লোজ মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে।

সূত্র বলছে, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী এই ঠিকাদার গত ১০ বছরে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার কাজ পায়। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ৮০ শতাংশ ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে শামীমের প্রতিষ্ঠান যুক্ত।

অনেকেই বলেন, এমনভাবে টেন্ডার আহ্বান করা হয় যাতে শামীমের প্রতিষ্ঠানই কাজ পায়। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, শামীমকে কাজ পাইয়ে দিতে টেন্ডারের শর্ত সেভাবে নির্ধারণ করা হয়।

সাম্প্রতিক একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘটনায় শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জি কে বিপিএল ব্ল্যাকলিস্টেড হয়। কারণ রূপপুরের বালিশ কাণ্ডের মাধ্যমে মূলত জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়। রূপপুরের গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের ব্যয় ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সেখানে বড় অঙ্কের কয়েকটি কাজ জি কে শামীম নিজেই করছেন।

এছাড়া ৫ পার্সেন্ট কমিশনের বিনিময়ে ৩-৪টি প্রতিষ্ঠানকে কয়েকটি কাজও দেন। ব্যাপক কমিশন বাণিজ্যের কারণেই মূলত রূপপুরে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে বালিশ, চাদর ও ইলেকট্রিক সামগ্রী সরবরাহে ব্যাপক দুর্নীতি হয়।

সূত্র বলছে, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সব ঠিকাদারই জি কে শামীমের নিয়ন্ত্রণে। বড় বড় কাজ তিনি নিজেই করেন। কিছু কাজ পছন্দের অন্য ঠিকাদারদের দিয়ে দেন মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে। তার মাধ্যমে কাজ পেয়ে ব্যাপকভাবে লাভবান সাজিন ট্রেডার্স, এনডিই (ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লি.) ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

শামীমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারি টেন্ডারের প্রাক্কলিত মূল্য বাড়িয়ে দেয়ার কাজটি করতেন মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মূল্যের একটি বড় অংশ অসৎ কর্মকর্তারা ভাগ করে নিতেন।

এছাড়া শামীমকে কাজ পাইয়ে দিলে আলাদা কমিশনও পাওয়া যায়। রূপপুরের বালিশ কাণ্ডে টাকা গেছে মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তার পকেটে। এদের মধ্যে অল্প কয়েকজন চিহ্নিত হলেও বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে। রহস্যজনক কারণে সুবিধাভোগী প্রভাবশালী আমলাদের নাম নেই।

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের পাশে গ্রিনসিটি আবাসিক এলাকা নির্মাণের জন্য মোট ২১টি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৯টি ভবনের কাঠামো ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। এসব ভবন নির্মাণের জন্য কয়েকটি স্তরে ঘুষ দিতে হয়েছে। ওয়ার্কঅর্ডার পাওয়ার পর টেন্ডার মূল্যের ৫ পার্সেন্ট দিতে হয়েছে নেগোসিয়েশন খরচ বাবদ।

এটি নিয়েছেন জি কে শামীম নিজেই। কারণ এই কাজ তিনিই সব কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এনেছেন বলে দাবি করেন। গণপূর্তের সাবেক এক ইঞ্জিনিয়ার নিয়েছেন ১ পার্সেন্ট। সাবেক একজন মন্ত্রীকে দিতে হয়েছে ১ পার্সেন্ট, একজন সচিব নিয়েছেন পয়েন্ট ৫ পার্সেন্ট এবং পূর্ত অধিদফতরের একজন প্রকৌশলী নেন আরও পয়েন্ট ৫ পার্সেন্ট।

গণপূর্ত অধিদফতরের একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শুক্রবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে একটি যুগের অবসান হল। ভাই বহু শান্তি পেলাম আজ। ওর যন্ত্রণায় আমাদের চাকরি করাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভাই উনার টাকার ভাগ কে পাননি, ফোনে সবার নাম বলতে চাই না।’

সূত্র বলছে, অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ঘুষের বিপুল অঙ্কের টাকা ভাগাভাগি হয়। মন্ত্রীর ভাগের ঘুষের টাকা নেন তার ঘনিষ্ঠভাজন হিসাবে পরিচিত জনৈক জিয়া ও নাইম। এছাড়া নিজেকে আড়াল করতে সতর্কতার অংশ হিসেবে চার-পাঁচ হাত ঘুরে এবং কয়েক দফা স্থান বদলিয়ে টাকা নেন সাবেক একজন প্রকৌশলী।

একজন আমলার টাকা নেন জনৈক মুমিতুর রহমান। পূর্ত মন্ত্রণালয়ে জিকে শামীমের প্রভাব-প্রতিপত্তি আঁচ করা যায় রূপপুরে দুর্নীতি নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেই।

কারণ ওই প্রতিবেদনে জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে শুধু দায়মুক্তি দেয়া হয়নি, তদন্ত কমিটি জি কে শামীমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করে। প্রতিবেদনে অন্য ঠিকাদারদের দুর্নীতির জন্য দায়ী করা হলেও জি কে শামীমের প্রশংসা করে বলা হয়, ‘জিকে বিপিএল কর্তৃক সরবরাহকৃত মালামাল খুবই ভালো এবং উন্নত মানের।’

সূত্র বলছে, রূপপুরে বালিশ কাণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর জি কে শামীম বিশাল নিরাপত্তা বহর নিয়ে চলাফেরা শুরু করেন। অন্তত ২০ জন গানম্যান পরিবেষ্টিত হয়ে তার চলাফেরা শুরু হয়। বহরের আগে-পিছে ২০-২৫টি মোটরসাইকেল থাকে।

শামীমকে বহনকারী গাড়ির আগে-পিছে দুটি গাড়িতে ভিআইপি প্রটোকলের মতো রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে তার লোকজন। পূর্ত অধিদফতরে এভাবে তিনি রাজসিক কায়দায় এসে ঢোকেন প্রতিদিন। তার এমন গাড়িবহর আর অস্ত্রধারী গানম্যান দেখে পূর্ত অধিদফতরের অনেকেই শামীমকে সমীহ করে চলেন।

শামীম তার হোন্ডা বাহিনী টেন্ডার ছিনতাইয়ের কাজেও ব্যবহার করেন। বছরখানেক আগেও প্রকাশ্যে বঙ্গ বিল্ডার্সের মালিক লিটনের কাছ থেকে তার লোকজন টেন্ডার ছিনতাই করে। বড় কাজ ছাড়া ছোট কাজের দিকে জি কে শামীমের তেমন আগ্রহ নেই।

পূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১শ’ কোটি টাকার বেশি কাজ হলেই সেখানে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম শোনা যায়।

পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানীতেও যেসব বড় বড় ভবন নির্মাণের কাজ হচ্ছে তার বেশির ভাগই নির্মাণ করছে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জি কে বিপিএল।

শামীমের প্রতিষ্ঠান যেসব কাজ করছে তার মধ্যে আছে দুটি ফেইজে নির্মিত জাতীয় রাজস্ব ভবনের ৫শ’ কোটি টাকার কাজ, রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাব সদর দফতর ভবন নির্মাণের ৪৫০ কোটি কাজ, ৪০০ কোটি টাকার পার্বত্য ভবন নির্মাণ, সচিবালয়ের কেবিনেট ভবন নির্মাণের ৩০০ কোটি টাকার কাজ।

সূত্র বলছে, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের সঙ্গে জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠতা ছিল ওপেন সিক্রেট। মূলত মান্নান খানের আমলে টেন্ডারবাজি করে তিনি বিপুল অঙ্কের অর্থ উপার্জন করেন। মান্নান খান যুগের অবসান হলেও জি কে শামীমের দৌরাত্ম্য কমেনি। বরং পরবর্তী সময়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।