বিশেষ প্রতিবেদক:
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সাক্ষর জালিয়াতি করে ইউএনডিপির শিক্ষা প্রকল্পে শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সোনাইছড়ির প্রুছা থোয়াই মার্মা প্রকাশ এনিন মার্মা। এ অভিযোগে ফিল্ড সুপারভাইজার পদ থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়।
অভিযুক্ত এনিন মার্মা সোনাইছড়ির মায়োগ্যাপাড়ার বাসিন্দা উক্যাচিং মার্মার ছেলে। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আগামী ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী।
স্থানীয় সুত্র জানায়, পার্বত্য জেলা বান্দরবানে শিক্ষা কার্যক্রমকে বিস্তৃত করণে শিক্ষা প্রকল্পে অর্থায়ন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইউএনডিপি। সংস্থাটির শিক্ষা প্রকল্পের জেলা সুপারভাইজারের দায়িত্বে ছিলেন এনিন মার্মা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, ইউএনডিপির শিক্ষা প্রকল্পের অধীন বিভিন্ন উপজেলায় সরকারীকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা প্রায় ৬০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা করে শতাধিক লোক থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা পকেটস্থ করেন এনিন মার্মা।
এমনকি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের জাল সাক্ষরে নিয়োগপত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে জালিয়াতির বিষয়টি অবগত হলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় শিক্ষামন্ত্রণালয়। নির্দেশ মতে জেলা শিক্ষা অফিসের তদন্তে বেরিয়ে আসে এনিন মার্মার ভয়ানক জালিয়াতি-দুর্নীতির অনেক অজানা তথ্য। সরেজমিন তদন্তে নিয়োগপ্রার্থীরা কিভাবে টাকা দিয়েছে, এনিন কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছে, সব খোলাসা হয়ে যায়। যা এনিন মার্মা নিজেই তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে এনিন মার্মার কাছে জানতে চাইলে বলেন, এটি অনেক আগের কথা। প্রকল্পটি ২০১৪ সালে শেষ হয়ে গেছে। এরকম কোন ঘটনা ঘটেনি। সব ভুঁয়া কথা। আমাকে ছোট করার চেষ্টা চলছে। অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।
তবে, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ স্বীকার করেছেন এনিন মার্মা। তিনি বলেন, জালিয়াতির কথা সত্য। কিন্তু টাকা পয়সার লেনদেন ছিলনা। এখানে পলিটিক্যালি রাঘববোয়ালরা জড়িত। তা স্যারও জানেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যাশৈহ্লা বলেন, রুমা, থানচিসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার সাক্ষরে শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে তা মন্ত্রণালয়ে ফরোয়ার্ডিং পাঠায় এনিন মার্মা। চাকুরি প্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় অনেক টাকা। যা তদন্ত করতে গিয়ে সত্যতা প্রমাণিত হয়।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, এনিন মার্মা নিজের জালিয়াতির কথা তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছে। জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে তাকে বহিস্কার করা হয়েছে।
এতেই শেষ নয়, বিভিন্ন বেকার যুবক ও ছাত্রকে চাকুরি দেয়ার কথা বলে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগে নেতা এনিন মার্মার বিরুদ্ধে। তার মিষ্টি কথার প্রতারণা প্রথমে ধরা না পড়লেও লেনদের পর টের পেয়েছে ভুক্তভোগিরা।
সোনাইছড়ি ইউনিয়নের তুমব্রু ডেম্যানপাড়ার মংখাইনু তংচংগ্যার ছেলে ক্যালাথোয়াই তংচংগ্যা গত ৩০ আগস্ট ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, তাকে শিক্ষক পদের চাকুরি দেবে বলে ১,৫০,০০০ টাকা দরদাম করেন এনিন মার্মা। ইসলামী ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা নেন। বাকি টাকা নগদে পাঠানো হয়। এযাবত চাকুরি দেননি। টাকা খোঁজলে ‘আজ দেব কাল দেব’ বলে প্রতারণা করে আসছেন। এদিকে, চাকুরির আশায় পথেপথে ঘুরছে গরীব-অসহায় পরীবারের সন্তান ক্যালাথোয়াই তংচংগ্যা। একই অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ঠাকুরপাড়ার চাচিং থোয়াই।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহাইন মার্মাও কাছে জানতে চাইলে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত কওে বলেন, এনিন মার্মা চাকুরি দেয়ার নামে বেশ কিছু লোকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। লিখিত অভিযোগও পাওয়া গেছে। বিষয়টি খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
চাকুরির লোভ দেখিয়ে এনিন মার্মার প্রতারণার ফাঁদ শুধু পাহাড়ী এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। কক্সবাজারের বেশ কিছু ছাত্র-যুবক থেকেও কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। চাকুরি তো দূরের, প্রার্থীদের ফোন নাম্বারও ব্লকে ফেলেছেন এনিন।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ১৬,৫০০ টাকা বেতনে মহেশখালী বা কুতুবদিয়া শিক্ষা অফিসে ‘অফিস সহকারী’ পদে চাকুরির আশ্বাসে রামুর জোয়ারিয়া নালার রমজান আলীর কাছ থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেন এনিন মার্মা। পরে চাকুরি দিতে না পেরে ২ লাখ টাকা ফেরত দিলেও বাকি টাকা দেননি। জমিজমা বন্ধক দিয়ে এনিন মার্মাকে টাকাগুলো দিয়েছিলেন রমজানের মা।
একটি বাড়ি একটি খামারে চাকুরির কথা বলে কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালীর মাহমুদ উল্লাহ নামের ছাত্রের নিকট থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ফেরত দিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ২ লাখ টাকা খোঁজতে গেলে তাকে হুমকি দিয়েছেন এনিন মার্মা।
চাকুরি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে এনিন মার্মা বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি ডা. ইসমাঈলের মাধ্যমে ঢাকার একজনের সাথে লেনদেন হয়। তিনি মারা যাওয়ায় আমি কিনারা করতে পারিনি। চাকা ফেরত চাইতে গিয়ে উল্টো আমাকে ধমক খেতে হয়েছে।
তিনি বলেন, তবু টাকাগুলো পরিশোধের চেষ্টায় আছি। কিছু টাকা ইতোমধ্যে পরিশোধ করেছি। ক্রমান্বয়ে সব পাওয়ার পরিশোধ করবো।