ডেস্ক নিউজ:
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী শক্তির দাবিদার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী চারদলীয় জোট সরকারের রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বি চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত দল বিকল্পধারা এখন সংসদে তিনটি আসন নিয়ে সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র।

রাজনীতিতে অবস্থান পরিবর্তনের ধারা বা ঘটনা এ দেশে হাতে গুনেও শেষ করা যাবে না। তবে অন্য অনেকের তুলনায় বি চৌধুরীর অবস্থান পরিবর্তন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। কারণ, ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ এবং নতুন দল বিকল্পধারা গঠনের পর তৎকালীন জোট সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল বি চৌধুরী ও তাঁর পরিবারকে। কিন্তু এসব ঘটনা বিবেচনায় থাকার পরও সর্বশেষ নির্বাচনে সরকার তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা সুবিধাজনক বলে মনে করেছেন বি চৌধুরী।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ করেই গত ৪ আগস্ট দুদকের একটি নোটিশ বি চৌধুরীর পরিবারকে আবার আলোচনায় নিয়ে আসে। আবার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নানের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করে ৮ আগস্ট। ফলে ওই মামলা ও নোটিশের সূত্র ধরে পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও বি চৌধুরী পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে গিয়ে রাজনীতিতে কী অর্জন করলেন বি চৌধুরী?

শুধু কি মামলা? প্রশ্ন উঠেছে সরকারি দলের সঙ্গে থেকে, সখ্য গড়ে বিকল্পধারার বিকাশ, ভূমিকা আর ভবিষ্যৎই বা কী হবে? কী হবে বি চৌধুরীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ?

যদিও এ প্রশ্নের মীমাংসা অনেকে ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। তদুপরি দুদকের সেই চিঠির ঘটনায় সরকারের সঙ্গে আসন সমঝোতায় যাওয়ার ওই সিদ্ধান্ত সঠিক নাকি ভুল হয়েছে—এ প্রশ্ন বা বিতর্ক রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সামনে চলে আসে। কারো মতে, সমঝোতায় না গিয়ে বি চৌধুরীর উপায় ছিল না। কারণ বিএনপি, বিশেষ করে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই তাঁর সঙ্গে জোট করার বিরোধী ছিলেন। মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে তারেক রহমানের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি বিএনপিতে বেশ আলোচিত। আবার কেউ বলছেন, ছেলে মাহীর কথায় বিএনপির সঙ্গে না থেকে বি চৌধুরীর সারা জীবনের রাজনৈতিক অর্জন ধ্বংস হয়ে গেছে।

গত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টসহ বিরোধী দলের জন্য বিএনপির কাছে ১৫০ আসন দাবি করেছিলেন মাহী। যদিও বিএনপিকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন অনেক দূর এগিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিরোধের সূত্র ধরে বি চৌধুরীর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া হয়নি। ড. কামালসহ অন্য তিনটি দলকে নিয়ে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। অনেকে মনে করেন, তারেক রহমানই কৌশল করে বি চৌধুরীর বদলে ড. কামালকে সামনে এনেছেন। আবার অনেকের মতে, সরকারের সঙ্গে মাহীর যোগাযোগ একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মাহীর কারণেই আওয়ামী লীগমুখী হয়ে পড়েন বি চৌধুরী।

বস্তুত, ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বি চৌধুরীর পদত্যাগের আগে ও পরে সংঘটিত অনেক ঘটনার জন্য তারেক রহমানের নেপথ্য ভূমিকাকে দায়ী করে থাকেন তাঁর পরিবার। কিন্তু ওই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে কোনো সময়ই বিএনপির পক্ষ থেকে বি চৌধুরীকে ‘সব ভুলে’ ‘নতুন পথ চলার’ আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। উপরন্তু ২০১৫ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর) নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েও পাননি মাহী।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘বিগত জোট সরকারের সময় বি চৌধুরীকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করে তাঁকে অপমান করা হয়েছে। এটা বিএনপি ঠিক করেনি। কিন্তু তার পরও বি চৌধুরীর সরকারের সঙ্গে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না।’ তাঁর মতে, জনগণ এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তা ছাড়া তিনি বা তাঁর পরিবারের পক্ষে আওয়ামী লীগ হওয়া সম্ভব না।

এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের এ সদস্য বলেন, ‘দুদকের নোটিশ নিয়েও নানা কথা চালু আছে। মাহী বি চৌধুরীর বিরুদ্ধে কিছু না পাওয়া গেলে ভালো। কিন্তু মামলা হলে তো দুই দিকই গেল।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কথা বলা হয়, তা প্রতিষ্ঠার অগ্রভাগে ছিলেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি বোধ হয় ছেলের স্বার্থকে বড় করে দেখতে গিয়ে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করলেন। এতে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।’

‘আবার এ কথাও ঠিক, বিএনপি তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। অপমান-অপদস্থ করে বিএনপি তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এর পরও আমি বলব, জাতীয়তাবাদী শক্তিকে বি চৌধুরীই একত্র করতে পারতেন। কিন্তু মহাজোটের শরিক হিসেবে রাজনীতির ইতিহাসে তাঁর অবস্থান ইতিবাচক থাকবে না’, বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক।

অবশ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নিজে মনে করেন, দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে তিনি ভুল করেননি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইট ওয়াজ রাইট ডিসিশন। তা ছাড়া রাজনীতিতে শেখ হাসিনা জয়লাভ করেছেন। অন্য কেউ ক্ষমতায় এলে দেশের পরিস্থিতি অনেক খারাপ হতো।’

এক প্রশ্নের জবাবে বিকল্পধারার সভাপতি বলেন, ‘দুদকের ওই চিঠিতে কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ। মাহী পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে আসবেন।’

বি চৌধুরীর পুত্র মাহী বি চৌধুরী বলছেন, ‘এটি এখনই বলা যাবে না যে আওয়ামী লীগ জোটের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে লাভ নাকি লোকসান হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট গঠন করে সমঝোতার রাজনীতির বীজ বপন মাত্র।

এটির মাত্র অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে। এরপর ফল পাওয়ার প্রশ্ন আসবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে আমার কোনো লোকসান হয়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার লোকসান হয়েছে। বিএনপির কাছ থেকে আমি অনেক বিপদের মুখে পড়েছি।’ দুদকের চিঠি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই চিঠিতে কিছু সময়ের জন্য একটু বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি যখন এখান থেকে ক্লিন হয়ে বের হয়ে আসব, তখন স্পষ্ট হবে যে ক্ষমতাসীন জোটে থাকার পরও আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে এবং কিছু পাওয়া যায়নি।’ ‘তা ছাড়া রাজনীতি করতে হলে আইনের ঊর্ধ্বে না উঠে এ ধরনের তদন্ত হওয়া উচিত এবং পরীক্ষাও দেওয়া উচিত’ বলছেন মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মাহী।

আদর্শগত প্রশ্নে মাহী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো জাতীয়তাবাদী শক্তির বাইরে নয়। এই দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলছে।’

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে বিএনপির দেওয়া প্রায় সব প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন বি চৌধুরী। শুধু তা-ই নয়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বিএনপির বিরুদ্ধে এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে মাহী বি চৌধুরীর দেওয়া বক্তব্যে কার্যত বি চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ চলে গেছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, জনগণ এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শেষ জীবনে বি চৌধুরীর জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। ফখরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ সময়ে এসে বি চৌধুরী দেশের মানুষের ভালোবাসা হারিয়েছেন। কারণ, এ দেশের মানুষের তথা গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে তিনি গণতন্ত্র হত্যাকারীদের পক্ষ নিয়েছেন। এ ঘটনাকে জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।’

১৯৭৮ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০২ সালের ২১ জুন পর্যন্ত মোট ২৪ বছর বিএনপির শীর্ষ পদে ছিলেন বি চৌধুরী। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকারের প্রথমে তিনি কিছুদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে ওই বছরের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না যাওয়া, রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে উল্লেখ না করা এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সীগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে মাহী বি চৌধুরীর তোরণ নির্মাণসহ কয়েকটি ঘটনায় মাত্র সাত মাসের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। ওই বছরের ১৯ ও ২০ জুন বিএনপির সংসদীয় দলের সভায় রাষ্ট্রপতির পদ থেকে তাঁকে ‘ইমপিচ’ করার সিদ্ধান্ত হলে ২১ জুন বি চৌধুরী পদত্যাগ করেন। ২০০৪ সালের ১০ মার্চ পুত্র মাহী বি চৌধুরীও বিএনপির সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে বাবার প্রতিষ্ঠিত দল বিকল্পধারায় যোগদান করেন। এর পরদিন ১১ মার্চ রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হলেও বিএনপি সমর্থকদের হামলায় তা পণ্ড হয়ে যায়। ওই দিন বি চৌধুরী, তাঁর ছেলে মাহী বি চৌধুরী ও মেজর (অব.) মান্নানের গায়ের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দেয় বিএনপি সমর্থকরা। বি চৌধুরীকে ওই দিন চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এরপর ২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিল বি চৌধুরীর বারিধারার বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যে ঘটনার জন্য তাঁরা বিএনপিকে দায়ী করেন। এসব ঘটনার কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের একমঞ্চে শামিল হন বি চৌধুরী। যদিও শেষ পর্যন্ত ওই জোটে গিয়ে নির্বাচন করা তাঁর সম্ভব হয়নি। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও বিএনপির পাশাপাশি বর্জন করে বি চৌধুরীর দল। এরপর সর্বশেষ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পাঁচ বছরে বি চৌধুরী, বিএনপি ও উদারপন্থী চারটি দলের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হলেও শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট গঠন সম্ভব হয়নি।

যুক্তফ্রন্ট গঠনে উদ্যোগী ভূমিকায় ছিলেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিএনপি অতীতে অন্যায় অচরণ করলেও শেষ জীবনে বি চৌধুরীর বিএনপির সঙ্গেই থাকা উচিত ছিল। তাহলে তিনি হয়তো মানুষের শেষ সালামটা পেতেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি সবই হারিয়েছেন।’ অবশ্য এ জন্য বিএনপিও দায়ী বলে তিনি উল্লেখ করেন।