রামু প্রতিনিধি:
চাকমারকুল জামেয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিষ্ঠানে গুলি, হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া মারধরে মাদ্রাসার এতিম শিক্ষার্থী সহ ৮ জন আহত হয়েছে।

সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭ টায় এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রণয় চাকমা ও রামু থানার ওসি (তদন্ত) মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। ঘটনা চলাকালে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছুটোছুটি ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

এ ঘটনায় মাদ্রাসা এবং আশপাশের এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সিকদার ঘটনাস্থলে যান। ইউএনও প্রণয় চাকমা বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় মামলা করার জন্য তিনি তাৎক্ষণিক ওসিকে নির্দেশ দেন।

হামলার শিকার ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তাসকিন হাসান তকি, মো. আব্দুল্লাহ, মো. সোহাদ, মো. জিসান, মো. রায়হান, মো. তৈয়ব উল্লাহ, সাইফুল ইসলাম ও মো. ইয়াছিন জানিয়েছেন, সন্ধ্যা ৭ টার দিকে মাদ্রাসার পেছন (পূর্বদিক) থেকে আকষ্মিকভাবে মাদ্রাসা লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু হয়। এসময় মুখোশপরা ১৫/২০ জন সন্ত্রাসী মাদ্রাসায় প্রবেশ করে তাদের মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা মাদ্রাসার বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মাদ্রাসায় বিভিন্ন কক্ষে ভাংচুর শুরু করে। এসময় আতংকিত হয়ে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছুটোছুটি ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা বলেন, ঐতিহ্যবাহি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের গুলিবর্ষণ ও মারধরের ঘটনা খুবই অমানবিক। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এ ধরনের ঘটনা যেন পূণরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকবে। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ ধরনের ঘৃণ্য অপকর্মের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহবান জানান। তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভয় দিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠানে সকল কার্যক্রম নির্বিঘেœ চলমান থাকবে। কেউ কোন প্রকার ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না।

রামু থানার ওসি (তদন্ত) মিজানুর রহমান বলেন, ‘মাদ্রাসায় হামলার ঘটনায় জড়িতদের আটক করতে পুলিশ কাজ করছে। এ ঘটনা ন্যাক্কারজনক। এ ঘটনায় জড়িতরা কোনভাবেই রেহায় পাবেনা। তিনি মাদ্রাসার সকল কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পুলিশি সহায়তা বা নিরাপত্তা দেয়ার আশ^াস দেন।

মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিভিন্ন অনিয়মের কারনে মাদ্রাসা থেকে ইতিপূর্বে বহিস্কার হওয়া শিক্ষক মাওলানা আবদুর রাজ্জাক ও তার সহযোগি নুরুল আলম, সাহাব উদ্দিন এবং ছলিম উল্লাহর নেতৃত্বে এ গোলাগুলি, হামলা, ভাংচুর ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। তারা পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

তিনি আরো জানান, হামলাকারিরা আগেরদিন রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) জোহরের নামাজের পর মসজিদের মাইক নিয়ে জোরপূর্বক মাদ্রাসার সকল শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করার ঘোষনা দেয়। এমনকি কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থী মাদ্রাসার শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করলে তাদের মারধরের হুমকী দেয়া হয়। এসময় মসজিদে আসা স্থানীয় মুসল্লী, মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটিয়েছে চক্রটি।

তিনি আরো জানান, ইতিপূর্বে এ চক্রটি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম অচল করার হীন উদ্দেশ্যে মাদ্রাসার প্রধান প্রবেশ গেইটে তালা দিয়েছিলো। তবে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদ ও স্থানীয় জনতার সহায়তায় তা প্রতিহত করা হয়। বর্তমানে মাদ্রাসায় পাঠদান সহ সকল কার্যক্রম সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারিরা একের পর এক ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে ঐহিত্যবাহি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে উঠে-পড়ে লেগেছে।

জানা গেছে, মাদ্রাসাটি ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস পটিয়ার তত্ত্বাবধানে ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা বোর্ডের আওতায় এ মাদ্রাসা (রেজিস্ট্রেশন নং-৪) পরিচালিত হয়ে আসছে। হুমকি-ধমকি দেয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত মাওলানা আবদুর রাজ্জাক এ মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক। মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার সময় অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, নিয়মিত উপস্থিত না থাকা, মাদ্রাসার বিধি বহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৭মে তাকে শিক্ষক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু বহিস্কারের পরও তিনি মসজিদ-মাদ্রাসার স্বার্থ বিরোধি বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছেন। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে তিনি মাদ্রাসার প্রধান প্রবেশ গেইটে তালা লাগিয়ে দিয়ে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কয়েকদফা হুমকি-ধমকি দিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির করে ঐতিহ্যবাহিন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বঃস্ব করার হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ২ জুলাই কক্সবাজার বিজ্ঞ সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা (সিআর-২৩১/২০১৯) দায়ের করেন। এ মামলায় মাওলানা আবদুর রাজ্জাক সহ আরো ৩/৪ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্ত আবদুর রাজ্জাক পশ্চিম চাকমারকুল এলাকার মৃত আবদুর রহিমের ছেলে। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধিন রয়েছে। কিন্তু মামলাকে তোয়াক্কা না করে তিনি ফের অপকর্ম শুরু করেছেন।

মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান, প্রতিষ্ঠানটির চলমান সংকট নিরসনে সংসদ সদস্য আলহাজ¦ সাইমুম সরওয়ার কমল দুইজন বিশিষ্ট আলেমেদ্বীনের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কিন্তু মাওলানা আবদুর রাজ্জাক ও তার সহযোগিরা তদন্ত কাজে কোন সহযোগিতা না করে উল্টো প্রভাব বিস্তার করে তদন্ত কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

জেলার বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন, রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মোহছেন শরীফ জানান, মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ বা যে কোন বিষয় নিয়ে দ্বন্ধ¦ সৃষ্টি হলে তা সবার প্রচেষ্টায় সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু কোনভাবে মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করা উচিত নয়।

চাকমারকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সিকদার জানান, ঐহিত্যবাহি প্রতিষ্ঠানে এভাবে গোলাগুলি, হামলা, ভাংচুর, বার বার মাদ্রাসায় এসে হামলা, তালা লাগিয়ে দেয়া ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধমকি দেয়ার ঘটনায় জনমনে ক্ষোভের মাত্রা বাড়ছে। একটি ঐতিহ্যবাহি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ন্যাক্কার জনক ঘটনা কোনভাবেই কাম্য নয়। এ ঘটনায় দোষিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়েছেন তিনি।