রুমিন ফারহানা

রুমিন ফারহানা‘আমি কিন্তু ভিআইপি, আমি এখন একটা ফেরি আটকে রাখতে পারি, রাস্তার উল্টোদিকে গাড়ি চালাতে পারি। আগে যাওয়ার জন্য অন্য গাড়ি থামাতে পারি। সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা ফাঁকা করার চেষ্টা করতে পারি। ট্রেন আটকে রাখতে পারি। বাস থামাতে পারি। আসলে পারি আরও অনেক কিছুই। তালিকা দিলে শেষ হবে না।’ এসব ‘পারি’, ‘করি’ এবং করে পারও পাই।
দেশে বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের নিরাপত্তা ও বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে একটি রেড বুক আছে, যা কয়েকজন নাগরিককে ভিভিআইপি, ভিআইপি ও সিআইপি—এই তিন ভাগে ভাগ করে। এর মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন ভিভিআইপি, যেমন– রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এরপরের লাইনে আছেন ভিআইপি, যার মধ্যে পড়েন জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, সিনিয়র সচিব, সচিব, তিন বাহিনী প্রধান ও পুলিশ প্রধান। তবে হ্যাঁ, সরকার যদি প্রয়োজন বোধ করে, তবে যে কাউকে ভিআইপি’র মর্যাদা দিতে পারে।

মজার ব্যাপার হলো, কারা কোন ধরনের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে তা সরকারি প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করা আছে। অর্থাৎ ভিআইপি হলেই যে সবাই একই সুযোগ-সুবিধা পাবেন, বিষয়টি তা না। তবে মোটা দাগে এই ‘বিশেষ শ্রেণির’ ব্যক্তিরা প্রোটোকল, নিরাপত্তা গার্ড, গানম্যান পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ তার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিষয়টিই প্রাধান্য পায়।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, পরপর বেশ কয়েক দিন আগে রাস্তার উল্টোদিকে চালানোর অভিযোগে ‘পতাকা ওড়া’ ও ‘পতাকা ছাড়া’ কিছু ভিআইপি’র গাড়ির গতি রোধ করেছিলেন কর্তব্যরত ট্রাফিক সদস্যরা। এর মধ্যে কয়েকজনের কাছে গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সেই অপরাধে যে, কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তেমনটিও শোনা যায় না। এমন দেশে বাস করি, যেখানে নিয়ম ভাঙা, আইন না মানা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর ভিআইপি’র তকমা থাকলে তো কথাই নেই, যা মন চায় করে যাও, কোনও সমস্যা নেই, জবাবদিহিতার বালাই নেই।

দেশে আইনের শাসন থাক বা না থাক, আইন কিন্তু আছে। আর সেই আইন অনুযায়ী দেশের কোনও সড়কেই কোনও ভিআইপি’র জন্য কোনও বিশেষ ব্যবস্থা থাকার কথা নয়। বিধি অনুযায়ী তাদের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল থাকবে কিন্তু তাদের চলার জন্য কোনও রাস্তা বন্ধ বা অন্য কোনও যান চলাচল বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তারা কোনও অগ্রাধিকারও পাবেন না। উলটো পথে চলা বা অন্য গাড়ি থামিয়ে অথবা সরিয়ে চলাচলের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রেড বুক অনুযায়ী সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা ফাঁকা করে কোনও ভিআইপি’র চলাচল অনুমোদিত নয়। মন্ত্রিরা কেবল পুলিশি নিরাপত্তা পান, এর বেশি কিছু নয়। গত বছর যদিও ভিআইপিদের জন্য আলাদা সার্ভিস লেন করার কথা উঠেছিল, তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়।

ভিআইপি নিয়ে এত কথা বলার কারণ ‘তিতাস’ নামের ১২ বছরের এক কিশোর, যার কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। একজন ‘ভিআইপি’র আসাকে কেন্দ্র করে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় ফেরি আটকে রাখার কারণে সেই তিতাসকে পথেই প্রাণ হারাতে হয়। গুরুতর আহত ছেলেটিকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্সটি সেদিন দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ফেরি ঘাটে আটকে ছিল। ছেলেটির স্বজনদের কথায় তখন কর্ণপাত করেননি কেউ; না উপস্থিত কর্মচারীরা, না ঘাটের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যা। এমনকী ৯৯৯-এ ফোন করেও কোনও সুরাহা করতে পারেননি স্বজনরা। এক পর্যায়ে তিতাসের মা ও বোন পুলিশ সদস্যদের পায়ে ধরে অনুনয় করলেও কোনও কাজ হয়নি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরিতে উঠতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু ছেলেটিকে আর বাঁচানো যায়নি।

বাংলা ট্রিবিউনের ৫ সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট বলছে, এই মৃত্যুর ঘটনায় করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটি। এই প্রতিবেদনে মাত্র তিন জনকে দায়ী করা হয়েছে। তারা সবাই ফেরি ঘাটের কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ঘটনায় ভিআইপি যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডল ও জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলামের কোনও দোষ খুঁজে পায়নি কমিটি। এ বিষয়ে বলা হয়েছে যুগ্ম সচিব জানতেন না যে ফেরিঘাটে মুমূর্ষু রোগী আছে। আরও মজার বিষয় হলো ফেরিঘাটে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘ভিআইপি’ সুবিধার পক্ষেই সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ফেরি চলাচলের ক্ষেত্রে যে ৭ দফা সুপারিশ করেছে কমিটি তার অন্যতম হলো–

‘নীতিমালা অনুযায়ী ভিআইপি সুবিধা চেয়ে কেউ ফেরি পারাপার হতে চাইলে তাকে অবশ্যই তার সরকারি ভ্রমণ বিবরণী আগেই ফেরি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হবে। তবে, জরুরি প্রয়োজনে আগে যোগাযোগ সাপেক্ষে ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ম শিথিল করা যেতে পারে।’

প্রসঙ্গত, এ ঘটনায় আরও তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেসব প্রতিবেদন এখনও জমা পড়েনি। এখানে বলে রাখা ভালো, যে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিবেদন জমা পড়ে, তার শুনানির সময় ভিআইপি প্রটোকল বিষয়ে আদালত মন্তব্য করেন, ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ভিআইপি নয়, বাকিরা সবাই রাষ্ট্রের কর্মচারী।’

এই তদন্ত রিপোর্টে যুগ্ম সচিবের নাম আসেনি। তিনি নাকি বিষয়টি জানতেন না। যার জন্য অ্যাম্বুলেন্সবাহী ফেরি আটকে রইলো ২ ঘণ্টার বেশি, ৯৯৯-এ কলের পরেও ফেরি নড়লো না, পায়ে ধরার পরও কোনও পুলিশ সদস্যের মন নরম হলো না এবং শেষমেষ ছেলেটি মারা গেলো, সেই তিনিই এই বিষয়ে কিছু জানেন না। যাক, প্রশাসনের করা তদন্ত রিপোর্টে তার নাম আসবে—এমন আশা আমরাও করি না। বাস্তবতা হলো, জামালপুরের ডিসি’র মতো ভিডিও কিংবা ডিআইজি মিজানের মতো অডিও না থাকলে আমলাতন্ত্রের উচ্চপদে আসীন কেউ বিচারের মুখোমুখি হবেন, সেটা আমরা ভাবি না। কিন্তু প্রশ্ন হলো–

১. ভিআইপি আসলে কারা? উচ্চ আদালত স্পষ্ট বলেছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ভিআইপি নয়। তাহলে একজন যুগ্মসচিব ভিআইপি হন কী করে? এমনকী রাষ্ট্রীয় বিবেচনায়ও সচিব মর্যাদার নিচে আমলাতন্ত্রের আর কেউ ভিআইপি নন। আলোচিত সেই যুগ্মসচিব ভিআইপি হতেই পারেন না।

২. রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় যারা ভিআইপি মর্যাদা পান, তারা কি ফেরি আটকে রাখতে, রাস্তার উল্টোদিকে গাড়ি চালাতে, আগে যাওয়ার জন্য অন্য গাড়ি থামাতে, সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা ফাঁকা করার চেষ্টা করতে, ট্রেন আটকে রাখতে কিংবা বাস থামাতে পারেন? উত্তর হলো ‘না’ তারা তা পারেন না।

৩. ভিআইপি’রা, ভিআইপি হওয়ার সুবাদে আসলে কি বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন? প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা প্রোটোকল, নিরাপত্তা গার্ড, গানম্যান বাদে তারা রাস্তায় অন্তত আর কোনও বিশেষ সুবিধা পান না।

৪. সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘ভিআইপি সুবিধা চেয়ে কেউ ফেরি পারাপার হতে চাইলে তাকে অবশ্যই তার সরকারি ভ্রমণ বিবরণী আগেই ফেরি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হবে। তবে জরুরি প্রয়োজনে আগে যোগাযোগ সাপেক্ষে ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ম শিথিল করা যেতে পারে।’—কথাগুলোর মধ্যেই এক ধরনের অস্পষ্টতা আছে। ফেরি বা অন্য কোনও যানবাহনে নিরাপত্তা ছাড়া আর কোনও সুবিধাতো কোনও ভিআইপি পেতে পারেন না। আর যতটুকু জানি ভিআইপিরা তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা গার্ড নিয়েই চলাচল করেন। তাহলে আগে থেকে ভ্রমণ বিবরণী পাঠানোর প্রশ্ন উঠছে কেন?

ভবিষ্যতে কোনোদিন যদি এমন আইনের প্রস্তাব করা হয়, যেখানে ভিআইপিদের জন্য রাস্তায় আলাদা লেন নির্ধারণ করা থাকবে, তাদের দেরির কারণে গণপরিবহন যেমন ট্রেন বা ফেরি আটকে রাখা যাবে, এই রাষ্ট্রের জনগণের উচিত হবে, সেই রকম আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা। ঔপনিবেশিক শাসনের আপাত অবসান হলেও এই দেশে এখনও বহু মানুষের মন থেকে কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটেনি।

পত্রিকায় আসা তদন্ত রিপোর্টে ওই ঘটনায় জড়িত যুগ্ম সচিবের নাম আসবে না, এমনকী তথাকথিত ভিআইপি সুবিধার নামে ফেরি বন্ধ করে রাখার অপশন থাকবে। এগুলো প্রত্যাশিতই ছিল। ২০১৪ সালের পর ২০১৮ সাল—একের পর এক নির্বাচনে মানুষের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে এই সরকার সম্পূর্ণভাবে আমলানির্ভর হয়ে উঠেছে। খুব চাঁছাছোলা ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, প্রশাসনই এই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। তাই আমলাদের বিরুদ্ধে কোনও ন্যায্য অভিযোগের‌ও সুষ্ঠু তদন্ত হবে, সেই আমলা অভিযুক্ত হবে এমন প্রত্যাশা করার কোনও কারণ নেই।

বরং আমলারা এই দেশে যত উদ্ভট চাওয়াই চেয়ে থাকুক না কেন, সেগুলো পূর্ণ করতে সরকার বদ্ধপরিকর। পুলিশ ব্যাংক চেয়েছিল, তাদের ব্যাংক দেওয়া হয়েছে, সেটার কাজও শুরু হতে যাচ্ছে। পুলিশের ব্যাংক আছে কিন্তু প্রশাসনের নেই, এটা সম্ভবত তাদের কিছুটা লজ্জায় ফেলেছে। তাই, সম্প্রতি ডিসি সম্মেলনে ডিসিরাও ব্যাংক চেয়েছেন। তাদের প্রত্যাশামতো জনপ্রশাসন ব্যাংক আসছে হয়তো অচিরেই। ব্যাংক চালানো তো সরকারি এইসব প্রতিষ্ঠান কাজ না, তারা কেন ব্যাংক চাইবে এই প্রশ্ন করা হয়নি। এই প্রশ্ন‌ও করা হয়নি এই দেশে এর মধ্যেই প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ব্যাংক তৈরি হয়ে এই দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের প্রচণ্ড ঝুঁকি তৈরি করেছে, তারপরও কেন ব্যাংক দেওয়া হবে?

সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ বলছে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। জানি এই কথাটি এই মুহূর্তের বাংলাদেশে একটা স্রেফ কাগুজে কথায় পরিণত হয়েছে। এই কথাটি যত বেশি কাগুজে কথায় পরিণত হয়, তত বেশি লাভ হবে আমলাদের। তারা তখন আর সংবিধানে বর্ণিত ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ থাকেন না, হয়ে ওঠেন ‘প্রজাতন্ত্রের প্রভু’।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিমকোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য