ওমর ফারুক
২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জাতীয় জীবনে একটা কালো দিন। ২০১৭ সালের এই দিনে ARSA (Arakan Rohingya Salvation Army) কর্তৃক কতিপয় পুলিশ চৌকিতে হামলার জের ধরে রাজ্যের সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। যথারীতি প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। তবে এবারের রোহিঙ্গা ঢল ১৯৭৮, ১৯৯২ ও ২০১২ এর রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযাযী, বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে ১১ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা বাস করছে।
সঙ্গত কারণে ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং মধুর ছড়ায় (৪ নং ক্যাম্প) গণ জমায়েত ও বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে দুই বছর আগে সংঘটিত গণহত্যার বিচার ও স্বদেশে প্রত্যাবাসনে সুনির্দিষ্ট ৫ দফার দাবী জানাতেই তারা এই পরিকল্পিত গণ জমায়েতের ডাক দেয়।
কিন্তু কক্সবাজারের অধিকাংশ গণমাধ্যম, উখিয়া-টেকনাফের জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সমাবেশকে নিয়ে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। এসব প্রতিক্রিয়ার মোদ্দা কথা হলো এই, এরকম বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা তাদের আস্ফালন জানান দিয়েছে, তারা কক্সবাজারকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! কাজেই তারা কক্সবাজারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মোটাদাগে এই ধরনের একটা রোহিঙ্গাফোবিয়া বিরাজ করছে স্থানীয় সমাজে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা ডাকাত দলের ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে নিহত হয় টেকনাফের জাদিমুরার যুবক ওমর ফারুক। এই ঘটনায় স্থানীয় লোকজন ব্যাপক ক্ষুদ্ধ হয়, বিক্ষোব্ধ লোকজন সড়ক অবরোধ ও বিচারের দাবিতে মিছিল বের করে। তাই রোহিঙ্গা ডাকাত দলের সাথে সাধারণ রোহিঙ্গাদের কোন যোগসাজশ আছে কিনা এটা খতিয়ে দেখা দরকার।
২. ২৫ আগস্টের সমাবেশ নিয়ে আমাদের জানা দরকার, এই বিক্ষোভ সমাবেশ কি তারা বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্যে আহবান করেছে? তারা কি সমাবেশে বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে কোন দাবি-দাওয়া পেশ করেছে? না, এরকম কোন কিছুই ঘটেনি। বরং মঞ্চের রোহিঙ্গা নেতাদের কন্ঠে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দানের জন্য বাংলাদেশের সরকার ও মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শোনা যায়।
আমাদের বরং এই সমাবেশকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। রোহিঙ্গা সমস্যার দুইটা বছর পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসনে কার্যকর কোন উদ্যোগ মিয়ানমার কিংবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিতে পারে নাই। দুই বছর পরে হলেও গত রোববারের সমাবেশে ঐক্যবদ্ধ রোহিঙ্গারা একই সুরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট ভাষায় বলতে পেরেছে, নাগরিক অধিকার, লুট হওয়া জায়গা-জমি, পুণরুদ্ধারসহ ৫ দফা দাবি নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের পুণর্বাসন করতে হবে। ১১ লাখ মানুষের এই ঐক্যবদ্ধ দাবি চীনসহ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্রিয়াশীল পক্ষগুলোকে নতুন করে এটা ভাবতে বাধ্য করবে যে, যেনতেন উপায়ে লোক দেখানো পুণর্বাসন যে রাখাইন রাজ্যের উদ্ভূত সমস্যার টেকসই সমাধান আনবে না এটা নিশ্চিত।
৩. ২৫ আগস্টের সমাবেশে নেতৃত্ব দেন নবগঠিত ‘সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস’ নামক সংগঠনের সভাপতি মুহিব উল্লাহ। ইতিপূর্বে মুহিব উল্লাহকে হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে এক সাক্ষাতে মিলিত হতে দেখা যায়। এই সাক্ষাৎ থেকে কিছু প্রশ্ন সামনে আসে, মুহিব উল্লাহ কোন দেশের পাসপোর্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছে? নাকি কোন বিশেষ ব্যবস্থায় মার্কিন মুলুক ঘুরে এসেছে মুহিব উল্লাহ। সেই বিশেষ ব্যবস্থাটা কী? ইত্যকার সব প্রশ্ন থেকে এটা স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা কমিউনিটির মাঝে মুহিব উল্লাহকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সামজিকীকরণের চেষ্টা করছে। ২৫ আগস্টের সুশৃঙ্খল গণ জমায়েত থেকে এর কিছুটা আঁছ লক্ষ্য করা যায়।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অবহেলা, বঞ্চনা, শোষণ-নিপীড়নের কারণ বুঝতে হলে মুসলিম রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্য নিয়ে মিয়ানমারের State Discourse টা কী তা জানা প্রয়োজন।মিয়ানমারের জান্তা সরকার দাবি করে, রোহিঙারা চট্টগ্রাম থেকে রাখাইনে (তদানিন্তন আরাকান) এসেছে। তাই ছলে-বলে কলা-কৌশলে তাদেরকে এথনিক ক্লিনজিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এই রাজ্যের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমনভাবে রাখতে হবে মৌলিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যেন রোহিঙ্গারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবেই পড়ে থাকে। এরকম সুদীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৮২ সালে জান্তা সরকার নাগরিক আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। মাদ্রাসা, মক্তব ছাড়া এখানে অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত দেয়া হয় নি। নাই কোন হাসপাতাল। ফলে রোহিঙ্গারা আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকেছে। ছিল না তাদের কোন পরিবার পরিকল্পনা। অধিক জনসংখ্যার ভারে দারিদ্র্য হয় তাদের নিত্য সঙ্গী। ধর্মীয় গোঁড়ামি তাদেরকে স্বাধিকার চেতনাবোধ থেকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে রাখে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গা কমিউনিটির মাঝে political socialization এর দীক্ষা টানেলের শেষ প্রান্তে জ্বলে উঠা ক্ষীণ আলোর মতো এই ভাগ্যাহত কওমকে পথ দেখাতে পারে। তবে ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর অভাব নাই’ এই আপ্ত বাক্যটাও আমাদের থিংক ট্যাংকারদের সব সময় মাথায় রাখতে হবে।
faruqueomarcu@gmail.com
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।