আরিফুল্লাহ নূরী

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগজ্ঞ মহাকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জম্ম গ্রহন করেন। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মাৎ সাহারা খাতুন দম্পতির তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। ঐ দম্পতির চার মেয়ে দুই ছেলে। শেখ মুজিবের ডাক নাম ছিল খোকা। তার দাদার নাম ছিল শেখ আবদুল হামিদ।শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা এবং চাচা দুই জন এন্ট্রাস পাশ ছিলেন।

শেখ মুজবের ছোট দাদা শেখ আবদুর রশিদ ঐ এলাকায় প্রথম ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেটি হাই স্কুল পর্যন্ত উন্নিত হয় । স্কুলটি আজও আছে। টুঙ্গিপাড়া ছিল মধুমতি নদীর পাড়ে। অন্য পাড়ে খুলনা। ফরিদপুর, গোপালগজ্ঞ এলাকায় “শেখ” বংশ সুপরিচিত ছিল। শেখ বোরহানউদ্দিন এ বংশের গোড়া পত্তন করেন। শেখ বংশ এক সময় বিত্তশালী থাকলেও পরে আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়। এসব ঘটনা নিয়ে ঐ অঞ্চলের চারণ কবিরা তখন গান বাধতো, গান গাইতো।শেখ বোরহান উদ্দিনের দুই ছেলে ছিল। শেখ কুদরতউল্লাহ এবং শেখ একরামউল্লাহ। জমিদারির সাথে সাথে এরা ব্যাবসাও করতো। কুদরতউল্লাহ ব্যাবসা এবং সংসার দেখাশুনা করতেন। ছোট ভাই একরামউল্লাহ জমিদারির আচার বিচার করতেন।
১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ।

১৯২৯ সালে গোপালগজ্ঞ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে স্থানীয় মিশনারী স্কুলে ভর্তি হন।
১৯৩৪ সালে ১৪ বছর বয়সে, সপ্তম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে তার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। কলকাতার তৎকালীন স্বনামধন্য ডা. শিবপদ ভট্টাচার্য, এ.কে. রায়ের কাছে চিকিৎসা নেন। এভাবে প্রায় দু’বছর চিকিৎসা চলে।
১৯৩৬ সালে তিনি চোখের রোগে আক্রন্ত চক্ষু চিকিৎসার জন্য আবার কলকাতা যান। কলকাতায় তিনি ড. টি. আহমেদকে দেখান। পরে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই তার দুচোখের আপরেশন হয় এবং তখন থেকেই চশমা ব্যাবহার শুরু করেন।

১৯৩৭ সালে তিনি আবার পড়া লেখা শুরু করেন। মাঝখানে প্রায় চার বছর তার পড়া লেখা এক ধরনের বন্ধই ছিল। তাকে গোপালগজ্ঞ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে পড়ালেখার সাথে সাথে “মুসলিম সেবা সমিতি”তে কাজ করতেন। প্রতি রবিবার দল বল নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল চাইতেন থলি নিয়ে । এ চাল বিক্রির টাকায় দ্ররিদ্র শিক্ষার্থিদের বই এবং পরীক্ষার খরচ দেওয়া হতো।
১৯৩৮ সালে গোপালগজ্ঞে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং শ্্রম মন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসেন। এ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সেচ্ছাসেবক বাহিনী ঘটন করেন এবং তার নেতৃত্ব দেন।
হিন্দু –মুসলমান কোন্দলে হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেফতার হয়ে প্রথমবার জেলে যান।

১৯৩৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় বেড়াতে যান। সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তার আলাপ আলোচনা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগ ঘটনের। সেখানেই মুজিব ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৪১ সালে মেট্রিক পরীক্ষার আগের দিন তিনি জ্বর এবং মামসে আক্রান্ত হন। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে সিক বেডে শুয়ে তিনি পরীক্ষা দেন।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু মাদারীপুর যান এবং সেখানে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন।
ফরিদপুরে ছাত্রলীগের কনফারেন্স উপলক্ষে কবি গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এদের ভিতর ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হূমায়ূন কবীর, ইব্রাহীম খাঁ । কিন্তু পুলিশ সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরে কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় হুমায়ূন কবির সাহেবের বাড়ীতে। সেখানে নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন।

১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু এন্ট্রাস (প্রবেশিকা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই বছরেই কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজের বেকার হোষ্টেলের ২৪নম্বর কক্ষে তিনি থাকতে শুরু করেন।
জিন্নাহ প্রাদেশিক মুসলিমলীগের সম্মেলনে যোগ দিতে পাবনা জেলার সিরাজগজ্ঞ মহাকুমায় আসেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্টতা আরও গাড় হয়।
ঐ বছর বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক ফুলশয্যা হয়। যদিও তার বিয়ে হয় বার/তের বছর বয়সে। আর কনের বয়স ছিল তিন বা চার।

১৯৪৩ সালে শেখ মুজিব প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন। খাজা নাজিমুদ্দীন সে বছর প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দীনকে শিল্পমন্ত্রী করেন। বঙ্গবন্ধু তার দলবল নিয়ে এর প্রতিবাদ করেন। ঐ বছর শুরু হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তিনি কলকাতায় লঙ্গরখানায় কাজ শুরু করেন। পরে গোপালগজ্ঞ আসেন রিলিফের কাজ করার জন্য।
এ বছর চট্টগ্রাম জেলার মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের সাখে তার বন্ধুত্ব হয়। এদের ভিতর ছিলেন এম. এ. আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, ডা. সুলতান আহমেদ প্রমূখ।

১৯৪৪ ছাত্রলীগের বাৎসরিক সম্মেলনের প্রস্তুতি নেন। এ বছর শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর কিছুটা মনোমালিন্য হয় এবং তাৎক্ষনিক তা মিটেও যায়। কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদান করেন। এই বছরই ফরিদপুর ডিষ্টিক্ট এসোসিয়েশনের সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৪৫ সালের প্রথম থেকে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য ভারত ভাগের নির্বাচনে জড়িয়ে পড়েন। এ বছর বাধ্য হয়ে বিনা প্রতীদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালের বেশির ভাগ সময় বঙ্গবন্ধুর কেটেছে “পাকিস্তান দাবী” নিয়ে। এ সময়ে তাদের আলোচনা, আড্ডার জায়গা ছিল “মিল্লাত” পত্রিকার অফিস। কখনও কখনও তারা রাতেও সেখানে থেকে যেতেন। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হন।

১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ঠ্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। এ বছর ৪ জানুয়ারীতে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত ভাগের কারণে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গা প্রতিরোধে তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন।
ঐ বছর উর্দুর সাথে সাথে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে । ২৩ ফেব্রয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নজিমুদ্দিন আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগন উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নেবে বলে বক্তব্য দিলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। গঠিত হয় সর্বদলীয় “ রাষ্ট্র বাংলা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয় । ১১ মার্চ কে ঘোষনা করা হয় মাতৃ ভাষা দিবস । মাতৃভাষার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য তিনি বিভিন্ন জেলায় ছাত্র সভা করেন। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থকরা এ দাবীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সভা স্থলে মারামারি করে।
১১ মার্চ ঢাকা হয়ে উঠে উত্তাল । বঙ্গবন্ধুকে সিটি এসপি তার জীপ নিয়ে তাড়া করে গ্রেফতারের জন্য। পরে সন্ধ্যার দিকে প্রায় ৭০/৭৫ জন সহ তিনি গ্রেফতার হন। তাকে রাখা হয় ৪ নং ওয়ার্ডে। ১৫ তারিখ তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ঐ বছরের ১১ ফরিদপুরের কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বঙ্গবন্ধু আবার গ্রেফতার হন।
১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট ঘোষণা করলে এ ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান। কর্মচারীরা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিক ভাবে জরিমানা করে। তিনি এ অন্যায় নির্দেশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন ।২০ এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার সময় গ্রেফতার হন ।

২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং জেলে থাকা অবস্থায় এ দলের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তিপান। মুক্তি পেয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে না গিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন।। দেশে বিরাজমান প্রকট খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেফতার হন এবং পরে মুক্তি পান। অক্টেবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভায় নূরুল আমিনের পদত্যাগ দাবী করেন। এর অব্যবহিত পরে অক্টোবরের শেষ দিকে লিয়াকত আলী খানের কাছে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাসানীর সঙ্গে পুনরায় গ্রেফতার হন।

১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে আওয়মী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেবার সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১ জানুয়ারী গ্রেফতার হওয়ার পর বিপ্লবী মুজিবুর রহমান প্রায় আড়াই বছর জেল খাটেন।
১৯৫১ সালে কারাগারে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে ঢাকা জেল হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তার চোখের চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপটেন লস্কর। আর হার্টের চিকিৎসক ছিল ডা. শামসুদ্দিন।

১৯৫২ সালের প্রথম থেকেই ভাষা আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্ধী থাকা অবস্থায় মুজিবুর রহমান রাতে গোপনে ভাষা আন্দোলন নিয়ে মিটিং করতেন। এমন এক মিটিং এ সিধান্ত হয় ২১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র ভাষা দিবস পালন করা হবে। সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের এ সব গোপন রাজনৈতিক কর্মকান্ড টের পেয়ে তাকে আবার জেলে ফেরত পাঠায়। কারাগর থেকে ১ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছে মুক্তির জন্য চিঠি পাঠান। তিনি চিঠিতে জানান তাকে মুক্তি দেওয়া না হলে তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারী থেকে অণশনে যাবেন। জেল কতৃপক্ষ তাকে অনশন না করার অনুরোধ করলে তিনি উত্তর দেন : ছাব্বিশ/সাতাশ মাস বিনা বিচারে বন্দি রেখেছেন। কোন অন্যায়ও করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাবো, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় যাবো না হয় মৃত অবস্থায় যাবো।
তিনি টানা অনশন করেন। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী তিনি দীর্ঘ কারাবাসের পর জেল থেকে ছাড়া পান। তিনি এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে তাকে স্ট্রেচচারে করে বের করা হয়।

১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষে মওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক ও শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মধ্যে ঐক্যের চেষ্টা হয়। এইলক্ষে দলের বিশেষ কাউন্সিল ডাকা হয় এবং এতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব গৃহিত হয়।

১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে । শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের আসনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। ১৫ মে প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করে দেয়। ৩০ মে করাচী থেকে ঢাকায় ফিরে গ্রেফতার হন। ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন।

১৯৫৫ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধৃ গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নামকরনের বিরোদ্ধে তিনি সোচ্চার হন। ২১ অক্টোব আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু আবারও পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়।
১৯৫৬ সালের ১৪ জুলাই আওয়ামীলীগের সভায় সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধীতা কারে বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব আনেন। ৪ সেপ্টেম্বর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভূখা মিছিল বের হয়। চক বাজার এলাকায় মিছিলে গুলি চালালে তিন জন মারা যান। ১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নিতী দমন এবং ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রী হন।

১৯৫৭ সংগঠনকে সুসংগঠিত করতে দলীয় সিধান্ত অণুযায়ী বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করেন ৩০ মে। ২৪ জুন ধেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত তিনি চীণ সফর করেন।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তান সরকার সকল ধরনের রাজনিতী নিষিদ্ধ করে। ১১ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস জেল খেটে ছাড়া পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আবার জেল গেটেই গ্রেফতার হন।
১৯৬০ সালে ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করের মুজিব জেল থেকে মুক্তি পান।
১৯৬১ সালে ছাত্র নেতৃবৃন্দ সাথে নিয়ে “স্বাধীণ বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ও গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস গঠন করেন।

১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন।
জুন মাসের দুই তারিখে চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান হলে শেখ মুজিব ১৮ জুন জেল থেকে মুক্তি পান। ৫ জুলাই পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের কঠোর সমলোচনা করে বক্তৃতা দেন। ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি লাহোর যান । সেখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধী দলীয় মোর্চা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্র্রন্ট গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান।
১৯৬৩ সালে লন্ডনে চিকিৎসাধীন সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরামর্শ করার জন্য শেখ মুজিব লন্ডন যান।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারীতে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এ সময় থেকে ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবী উঠতে থাকে। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দাঙ্গা পতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ঐ বছর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে আগে মুজিব গ্রেফতার হন।

১৯৬৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় এক বছরের দন্ড প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী লাহোরে বিরোধী দল সমুহের জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী পেশ করেন। ১ মার্চ শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৬ দফার পক্ষে বাংলাদেশেরে আনাচে কানোচে জনসংযোগ শুরু করেন। ১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে বঙ্গবন্ধু আটবার গ্রেফতার হন। ৮ মে নারায়নগজ্ঞ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক অন্যান্য নেতাকর্মীর মুক্তির দাবীতে সারাদেশে ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে ঢাকা, নারায়নগজ্ঞ, টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক নিহত হন।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারী মাসের তিন তারিখে বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ জানুয়ারী শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান এবং গেটেই আবার গ্রেফতার হন।১৯ জুন কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়।
১৯৬৯ আগর তলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরোদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাপী বিক্ষোভের কারণে ১ ফেব্রুয়ারী গোল টেবিল বৈঠকের ঘোষনা দেয় এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার ঘোষনা দেয় । বঙ্গবন্ধু ঘৃণার সাথে এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন । ২২ ফেব্রুয়ারী গণ অভ্যুথানের কারণে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল আসামীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবধর্ণার আয়োজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিক ভাবে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোল টেবিল বৈঠকে অংশ গ্রহন করে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা উপস্থাপন করেন।১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু গোল বিল বৈক ত্যাগ করেন তার দাবী না মানার কারণে। তিনি ১৪ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন।৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ ডাকার ঘোষনা দেন।

১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু আবারও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বচিত হয়। ৭ জুন রেসকোর্স জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার আদায়ের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার জন্য জনগনের প্রতি আহ্ববান জানান । ১৭ অক্টোবর আওয়মী লীগের প্রতীক হিসাবে নৌকা প্রতীক নির্ধারিত হয়। ১২ নভেম্বর গোর্কিতে ঝড়ে ১০ লক্ষ্যাধিক মানুষ মারা গেলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি প্রচারণা বাদ দিয়ে দুর্গত এলাকায় চলে যান। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯ টি আসনের ভিতর ১৬৭ আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ টি আসনের ভিতর ২৮৮ টি আসনে জয় লাভ করে।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ করান।এরপর শুরু হয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের টালবাহানা।৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশে হরতাল পালিত হয়।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষনা দেন “ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।
২৬ মার্চ ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে এবং বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী হিসাবে আখ্যা দেয়। এ দিন চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ.হান্নাস বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনা পত্রটি জাতিকে জানান। যা বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার ঠিক আগে আগে লিখেছিলেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদে (লায়ালপুর) জেলে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার গোপন বিচারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদন্ড রায় দেওয়া হয়।
১৯৭২ সালে জানুয়ারী মাসের ৮ তারিখে আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। সে দিনই ঢাকার উদ্দেশ্যে তাকে লন্ডন পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারী লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধামন্ত্রী এডওয়ার্ড হীতের সাথে বঙ্গবন্ধু বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লীতে যাত্রা বিরতির সময় বিমান বন্দরে ভারতে রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম পা রাখেন। তিনি বাংলাদেশে এসে পৌছান। বিমান বন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দোনের গণ সংবর্ধনায় যোগ দেন।
১২ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন। ৬ ফেব্রুয়ারী ভারত সরকারের আমন্ত্রনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ভারত যান । ২৮ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি রাশিয়া যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরাদর্শী সিধান্তের কারণে ভারত সরকারকে অনুরোধের ফলে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
৩০ জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রপ্রচার করা হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি সেখান থেকে জেনেভা যান। ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে “জুলিও কুরী” পুরুস্কার দেয়। ৪ নভেম্বর তারিখ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।
১৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে সাক্ষর করে।১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হয়।
১৯৭৩ সালে ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের ভিতর আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসনে জয় লাভ করে।৬ সেপ্টেম্বর জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ অক্টোবর জাপান যান রাষ্ট্রীয় সফরে।
১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতী দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান যান ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য। ১৭ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতি সংঘের সদস্য পদ আদায় করে নেন। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনি প্রথম বারের মতো বাংলায় ভাষন দেন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যাবস্থা প্রবর্তিত হলে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারী দেশের বিভিন্ন রাজণৈতিক দলের সম্বন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। এ দলে বিভিন্ন পেশাজিবীও যোগ দিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু এ দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৫ আগস্ট ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির চির স্বজন , জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে স্বাধীনতা বিরোধীরা নৃশংস ভাবে হত্যা করে।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- এ দুটি নাম, দুটি শব্দ একে অপরের পরিপূরক, যা আজ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। একটি ছাড়া অন্যটি যেন মূল্যহীন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে মহানায়ক, তিনি বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির জনক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তার দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের পথ ধরেই বাঙালি তাদের নিজ আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করে। তার নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ তথা পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে আমাদের স্বদেশভূমিকে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনি হিসেবে বিবেচনা করত পাকিস্তানি শাসকরা। সেই থেকে এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে সাহসী মহামানব দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে এসেছেন, যৌবনের একটা দীর্ঘ সময় জেলে কাটিয়েছেন, তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি। অধিকার আদায়ে প্রতিটি সংগ্রামে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছেন, সফল হয়েছেন। তিনি তার রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহযোদ্ধা হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের মতো মহৎ, সৎ, মহান দেশপ্রেমিকদের পেয়েছিলেন।
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক চক্রের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিমাতাসুলভ মনোভাব বুঝতে পেরে তিনি ৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্ন সামনে রেখে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে অগ্রসর হন তিনি। ১৯৬৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করেন। এই ৬ দফাই ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ এবং বাঁচার দাবি। বাংলার মানুষ তাকে ভূষিত করেছিল বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। এই অসাধারণ ভাষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এবারের সংগ্রাম এ কথাটি উচ্চারণ করে তিনি বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন বাঙালি, তেমনি ছিলেন একজন ধার্মিক। ইসলামের সুমহান শিক্ষার প্রতি তিনি তার সুদৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সুদৃঢ় প্রচেষ্টা। কিন্তু পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠী এবং ইসলামের তথাকথিত লেবাসধারী চক্র সব সময় বঙ্গবন্ধুকে ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও ইসলামের লেবাসধারী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং তার নিজ হাতে গড়া দলকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার- প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মকে কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাননি বঙ্গবন্ধু। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মানুষের নিজ নিজ ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সে অধিবেশনে তিনি ঘোষণা করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার নিজ নিজ অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মচর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। বঙ্গবন্ধু তার স্বল্পকালীন শাসনামলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত বিরল। তিনি ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন সরকারি অর্থে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ সংস্থা হিসেবে নন্দিত।
ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম পাকিস্তান আমলে ছিল রেসকোর্স ময়দান। এখানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নামে চলত জুয়া, হাউজি ও বাজিধরা প্রতিযোগিতা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করেন এবং রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষরাজি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বহন করে চলেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন।
সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়তে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দিন-রাত কাজ করেছেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে শূন্য কোষাগার নিয়ে সচল করেন। উন্নত দেশগুলোর প্রথমদিকের অসহযোগিতাসহ নানা সংকটের মধ্যে দেশকে এগিয়ে নেন। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার হাতে গড়ে ওঠে একটি আধুনিক সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী। পুলিশ ও আনসারকে একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। দেশ গড়তে দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিকভাবে নানা দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল একদল পাষণ্ড, যারা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল সুবিধাভোগীদের কাছে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা দীর্ঘ ৩৫ বছর ওই পাষণ্ডদের আগলে রাখলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের অনেক উঁচু মানের একজন নেতা। বিশ্ব ইতিহাসে যে কজন নেতার নাম সগর্বে উচ্চারিত হয় বঙ্গবন্ধু তাদের অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, আলজেরিয়ার আহমেদ বেন বেল্লা আর কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো রাজনীতিক হিসেবে নিজ নিজ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যেমন সফল, তেমনি বঙ্গবন্ধুও নিজ নেতৃত্বগুণে বাঙালি জাতির জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছেন। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে নানা কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডটি ছিল বিশ্বে আলোচিত। এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা এবং সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিক। তাদের এই ষড়যন্ত্রে দেশী-বিদেশী নানা চক্রও সম্পৃক্ত ছিল। এর প্রমাণ মেলে হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের বিদেশে আশ্রয় লাভের ঘটনায়।
বিশ্বের যে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান হত্যাকাণ্ডের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি ছিল নজিরবিহীন। আমরা যদি আব্রাহাম লিংকনের হত্যাকাণ্ড দেখি- বিল বুথ নামে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছিল। কেনেডিকে হত্যা করেছিল হারবে ওসওয়াল্ড নামের এক সন্ত্রাসী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করেছিল আকবর নামে এক আফগান যুবক। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল নাথুরাম গডসে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের সঙ্গে তুলনা করলে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যাকাণ্ডটি নানা কারণেই নজিরবিহীন। এর ব্যাখ্যা দেয়া যায় এভাবে : বিল বুথ লিংকনকে হত্যা করে পালিয়ে যায়, পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। গান্ধীর হত্যাকারীকে অল্পদিনের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। কেনেডির হত্যাকারী ওসওয়াল্ডকে আরেক ঘাতক জ্যাক খুন করে। অথচ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তি পেতে ৩৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এজন্য ১৩ বছর আইনি লড়াই করতে হয়েছে। মোট ১২ জনের মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, বাকিরা এখনও পলাতক। খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে কলংকের দায়মুক্তি আপাতত ঘটলেও তাদের দীর্ঘদিনের সহায়তাকারী, পৃষ্ঠপোষক এবং চেতনার ধারক যারা, তাদের চিহ্নিত ও বিচার না করা পর্যন্ত একে চূড়ান্ত দায়মুক্তি বলা যাবে না। আমি মনে করি, হাতেগোনা কয়েকজন খুনিকে শাস্তির মধ্য দিয়েই এই কলংকজনক অধ্যায়ের শেষ হয়নি। খুনিদের পৃষ্ঠপোষকরা এখনও সক্রিয়, তাই চূড়ান্ত দায়মুক্তি এখনও হয়নি। আমরা ইতিহাসের দায়মুক্তি পেয়েছি; কিন্তু এই দায়মুক্তির প্রকৃত সুফল আসবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে।
মহামানবের মৃত্যু নেই। তারা বেঁচে থাকেন কর্মের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জনগণের প্রতি ভালোবাসা আর একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। যতদিন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর বুকে পরিচিত থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর বুকে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কবির ভাষায় বলতে হয়-
যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

আরিফুল্লাহ নূরী, সম্পাদক, কক্সবাজার মেসেজ ডট কম- সিবিএম নিউজ