ডেস্ক নিউজ:

রেকর্ড গতিতে প্রতিদিন পুড়ছে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত অ্যামাজন জঙ্গল। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্স (আইএনপিই) বলছে,এ বছর জুন পর্যন্ত ব্রাজিলে ৭২ হাজার ৮৪৩টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আগুনের ঘটনা অ্যামাজন জঙ্গলে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। এসব অগ্নিকাণ্ডের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দায়ী করা হচ্ছে পশুপালক ও কৃষকদের। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন, এনজিও সংগঠনের পক্ষ থেকে লাগানো হচ্ছে এসব আগুন। পরিবেশবাদীরা বলছেন, অ্যামাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারি নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মহোৎসব শুরু হয়েছে। তবে অ্যামাজনকে ঘিরে করা কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জন্য কৃষির বিস্তৃতি, বৈধ ও অবৈধ খনি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য ঘটছে অরণ্য বিনাশ। গড়ে উঠছে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত প্রকল্প। গত কয়েক দিনের এসব আগুন উন্নয়নের জন্য অরণ্য বিনাশের গতিকেই জোরদার করছে।

উন্নয়ন, মুনাফা ও প্রবৃদ্ধির বলি হচ্ছে অ্যামাজন

বনাঞ্চলে দাবানল সৃষ্টিতে খরা একটি কারণ হলেও আইএনপিই গবেষকরা বলছেন, এ বছর অ্যামাজনের জলবায়ু বা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নিয়ে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। গবেষক আলবার্তো সেটজার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, শুষ্ক মওসুম দাবানল সৃষ্টি ও ছড়িয়ে পড়ার জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু আগুন লাগানো মানুষের কাজ, হতে পারে পরিকল্পিত অথবা দুর্ঘটনা।

গবেষকরা বলছেন, কৃষি, খনন ও অনুসন্ধানের কারণে এখন পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। গত অর্ধশতকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সমান বনাঞ্চল হারিয়ে গেছে। কাঠুরে, পশুপালক ও খনি শ্রমিকরা বাস্তুসংস্থানের বিনাশ অব্যাহত রাখায় ক্রমাগত তা বাড়ছে। গত মাসে বনাঞ্চল হারিয়ে যাওয়ার হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতি মিনিটে তিনটি ফুটবল মাঠের সমান এলাকার বন হারিয়ে যাচ্ছে।

কাঠুরে ও পশুপালকরা আগুন লাগিয়ে পরিষ্কার করে জঙ্গল

পরিবেশবাদী সংগঠন ও গবেষকরা বলছেন, ব্রাজিলের চিরহরিত অরণ্যে দাবানলের কারণ পশু পালক ও কাঠুরেরা। জমি ব্যবহার করতে তারা বনাঞ্চল পরিষ্কার করতে এসব দাবানল তৈরি করছে। আর এতে সমর্থন দিচ্ছেন দেশটির বাণিজ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অ্যামাজনে কৃষি ও খনি তৎপরতা বাড়ানো এবং তা বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার। জলবায়ু পরিবর্তন ও অরণ্য বিনাশ নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ অগ্রাহ্য করে তিনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। আইএনপিই’র তথ্য অনুসারে, জানুয়ারিতে তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর অরণ্য বিনাশের ঘটনা বেড়েছে।

ব্রাজিলে গো-চারণের জন্য পশুপালকরা পরিকল্পিতভাবেই আগুন লাগিয়ে থাকে। সব সময় তা অবৈধও নয়। মাটো গ্রসো ও পারা এলাকায় ব্রাজিলের কৃষি এলাকার বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে এবং তা বনাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এই এলাকায় অরণ্য বিনাশ এবং দাবানলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত সপ্তাহে অ্যামাজন ওয়াচের এক বিবৃতিতে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বিস্তৃত একটি খবরের দিকে আলোকপাত করা হয়। ওই খবরে বলা হয়েছে, বলসোনারোর নীতিতে উৎসাহিত হয়ে কৃষি জমির জন্য বনাঞ্চল পোড়াতে সমন্বিতভাবে আগুন দিবস পালন করেছে সেখানকার কৃষকেরা। সংস্থাটির পরিচালক ক্রিস্টিয়ান পইরিয়ার বলেন, এসব আগুনের বিপুল বড় অংশ মানুষের জ্বালানো। ক্যালিফোর্নিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার শুকনো ঝোপের মতো দ্রুত আগুন আর্দ্র অ্যামাজনে শুষ্ক মওসুমেও জ্বলে ওঠে না। দীর্ঘদিন থেকেই জঙ্গল পরিষ্কার করতে কৃষক ও কাঠুরেরা আগুন ব্যবহার করছে আর আজকের অস্বাভাবিক দাবানলের নেপথ্যেও তাদের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

অ্যামাজনে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার অবৈধ খনি

অ্যামাজনের অরণ্য বিনাশে বৈধ ও অবৈধ খনি বাণিজ্যেরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। ছয়টি দেশে বিস্তৃত অ্যামাজনের ২৪৫টি এলাকায় ২ হাজার ৩১২টি অবৈধ খনি রয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামাজন সোশিও-এনভায়রনমেন্টাল। বোলসোনারো দায়িত্ব নেওয়ার পরই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তিনি নিজেই ১৯৮০-র দশকে একটি অবৈধ সোনার খনিতে কাজ করেছেন এবং অবৈধ খনি ব্যবসায়ীদের সমর্থন পেয়েছেন। তিনি তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সম্মান ও নিরাপত্তার। এছাড়া সংরক্ষিত আদিবাসীদের এলাকায় খনন কাজকে বৈধ করার কথাও জানিয়েছিলেন।

ক্লার্ক ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যামাজন খনি ও তেল, গ্যাস উত্তোলনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এছাড়া আগামী দুই দশকে এখানে বড় ধরনের অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যামাজন সংশ্লিষ্ট দেশগুলো জাতীয় ও আন্তঃসীমান্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার নীতিগত ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির এই কৌশল নেওয়া হয়েছে।

অ্যামাজন যেনও আধুনিক কোনও শহর

গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, সরকার ও বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের আঞ্চলিক প্রকল্প গ্রহণ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রাস্তা নির্মাণ, রেলপথ স্থাপন, বন্দর ও নৌপথ নির্মাণ। এসব প্রকল্পের লক্ষ্য হলো গভীর জঙ্গল এলাকায় মূল্যবান খনিজ, তেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসসহ অন্যান্য সম্পদ উত্তোলন করা।

গবেষকরা বলছেন, অতীতের গবেষণায় দেখা গিয়েছে অবকাঠামোর বিস্তৃতি অরণ্য বিনাশ ঘটিয়েছে। তারা বলছেন, ধনীদের এই শ্রেণি অরণ্য বিনাশে কাজ করছে এবং তারা কৃষি ও বনায়নের চেয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বা বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য গড়ে উঠছে রাস্তা

ক্লার্ক ইউনিভার্সিটির পিএইচডি প্রার্থী লরা সোলস বলেন, বৈধ খনি ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত প্রকল্প বনাঞ্চলের জন্য হুমকি। এগুলো গভীর বনে মানুষের যাতায়াত ও কৃষির সম্প্রসারণ করছে। আর যেখানে বড় ধরনের বৈধ খনি রয়েছে সেখানেই অবৈধ খনি থাকবে সেটা তো স্বাভাবিক।

জলবায়ু পরিবর্তনে অ্যামাজনের অরণ্যবিনাশের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করা পরিবেশবিদ আদ্রিয়ান মুয়েলবার্ট বলেন, অতীতে দাবানল বৃষ্টিহীনতার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এই বছর আর্দ্রতা যথেষ্ট রয়েছে। এর কারণে আমরা মনে করছি এই আগুন অরণ্য বিনাশ করার জন্যই।

মুয়েলবার্ট আরও বলেন, এটা সত্যি দুঃখজনক। এই দাবানলের নেপথ্যে অরণ্য বিনাশ। এটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে অপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।