আনিস আলমগীর

এবার যে হুজুরটি আমার কোরবানির গরু জবাই করলেন, তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষক। তাকে কাজের সম্মানী দেওয়ার পর গরুর চামড়াটিও তিনি মাদ্রাসার জন্য চাইলেন। আমি বেচা বিক্রির ঝামেলা এড়াতে বললাম, ঠিক আছে। প্রতি বছরের মতো এবার কোনও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীকেও দেখলাম না। আমার পাশের বাসার ভদ্রলোক বললেন, তিনি অর্ধেক দিয়েছেন। আমিও ইচ্ছে করলে তাই দিতে পারি। বাকিটা ফকির মিসকিনদের দেওয়া যাবে। আমি তাই করলাম। রসিদে অর্ধেক দান লিখে দিলাম।
রাতে বাসায় এসে জানলাম মাদ্রাসার হুজুর চামড়ার ভাগের দুই শ’ টাকা দিয়ে গেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম—এতবড় চামড়া মাত্র চারশ টাকা বিক্রি হয়েছে! পরে জানতে পারলাম, ঠিকই আছে। কাঁচা চামড়াই নাকি বিক্রি হচ্ছিল না বাজারে!
সবাই বলছে এবারের মতো দেশে কখনও চামড়ার ব্যবসার এত বিপর্যয় হয়নি। চামড়া ব্যবসাটা এদেশে প্রাচীন একটি ব্যবসা। পোস্তার আড়তদারি আর হাজারিবাগের ট্যানারি শিল্প প্রায় ব্রিটিশ আমল থেকেই ছিল। ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারি শিল্পকে হাজারিবাগে আনা হয়। পাকিস্তান আমলে ট্যানারি শিল্প ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম আর ঢাকায়। তখন অধিকাংশ ট্যানারিতে ওয়েট-ব্লু (লোম ছাড়ানো চামড়া) তৈরির ব্যবস্থা ছিল শুধু। ছোটখাটো ব্যবস্থায় দুইটি ড্রাম বসিয়ে ওয়েট-ব্লু লেদার বা আংশিক প্রক্রিয়াজাত চামড়া তৈরি করা যেতো। ঈদের সময় চামড়া সংগ্রহ করতো আর তা ওয়েট ব্লু পর্যন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিদেশে রফতানি করে দিতো। এই জন্যই কোনও ব্যাপক অনিয়ম কখনো দেখা যায়নি।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের ওয়েট-ব্লু চামড়া কিনে ছিল এবং এ সম্পর্কে একটা চুক্তিও দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল। সরকারের পরামর্শ মতো সব ট্যানারি চামড়া কিনে ওয়েট-ব্লু পর্যন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রেখেছিল। আফগানিস্তানের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার একরোখা ভূমিকার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পরে অর্ডারটা বাতিল করে দিয়েছিল। আর আমাদের ট্যানারিশিল্প একটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল তখন।

এ যাবৎকালে সে দুর্ঘটনা ছাড়া আমাদের ট্যানারি শিল্প অন্য কোনও বিপদে পড়েছে বলে জানা যায় না। ১৯৭২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত নিয়ম মোতাবেক এভাবে চলে আসছে। প্রত্যেক কোরবানির ঈদের আগে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহক ট্যানারিগুলোকে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ ঋণে দিতো। আর ট্যানারিগুলো ঈদের দিন থেকে চামড়া কেনার জন্য মাঠে নেমে যেতো। ঈদের পরে তিন মাসের মধ্যে ওয়েট ব্লু তৈরি করে রফতানি করে দিতো। তখন একচেটিয়াভাবে ওয়েট ব্লু যেতো চিনে আর দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা ছিল বাটা। তাদের জন্য মালামাল যেতো লন্ডনে।

এক সময়ে এসে সরকার ওয়েট ব্লু রফতানি বন্ধ করে দেয়। ফলে ওয়েট ব্লু তৈরির ট্যানারিগুলো তাদের মালামাল বিক্রি করতো আমাদের দেশের ফিনিশড প্রোডাক্ট তৈরির ফ্যাক্টরিগুলোয়। মানে পুরো চামড়াই দেশে থেকে যেতো। লোকাল এলসির মাধ্যমে বেচা বিক্রি হয় বিধায় লেনদেনের বিষয়ে কোনও বিঘ্নও ঘটতো না।

এবার মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, দাম এতটাই কমেছে যে কাঁচা চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানিদাতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে চামড়া মাটিতেও পুঁতে দিয়েছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ী অনেকে দাম না পেয়ে কাঁচা চামড়া রাস্তায়ও ফেলে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়ে ‘চামড়া সিন্ডিকেট’কে দায়ী করে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকে সরকারি দলের লোকরা এর নেপথ্যে আছে ইঙ্গিত করে পোস্ট দিয়েছেন। এমনকী বিএনপির পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছে, কাঁচা চামড়ার দাম কমানোর পেছনে ‘ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার সিন্ডিকেট’ কাজ করেছে।

চামড়ার এই বিপর্যয়ের পূর্বাভাস বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তারা চামড়ার একটা দাম নির্ধারণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। তবে শেষ বেলায় এসে ঘোষণা দিয়েছেন এবার কাঁচা চামড়া রফতানি করা যাবে। আড়তদাররা অভিযোগ করেছে তাদের চার শত কোটি টাকা ট্যানারি মালিকদের হাতে আটকে থাকায় তারা বাজার থেকে চামড়া কিনতে পারছে না। আবার কেনার পরে দেখলাম বকেয়া টাকার অন্তত অর্ধেক পরিশোধ না করলে নতুন করে ট্যানারিগুলোতে মালও দিতে রাজি নয় তারা। তবে ১৮ আগস্টের বৈঠকে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া নগদ মূল্যে বিক্রিতে আপত্তি নেই বলছেন তারা।

ট্যানারি মালিকরা শুরুতে বলে আসছিলেন তাদের কাছে পর্যাপ্ত পুরনো মাল রয়ে গেছে। নতুন করে কেনার জন্য ব্যাংক থেকেও পর্যাপ্ত টাকা পাননি। আবার সরকার যখন কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত দিয়েছে এরা সংবাদ সম্মেলন করে বলছে, এই সিদ্ধান্ত দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করবে। এক মুখে দুই কথা।

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা যায় আড়তদারেরা যদি লোকাল এলসির মাধ্যমে ট্যানারিগুলোর কাছে তাদের মালামাল বিক্রি করতো তাহলে তো টাকা নিয়ে এই সংকটে পড়তো না। আবার অর্থমন্ত্রী বলছেন প্রত্যেকটা ট্যানারিকে আগের মতোই যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে, যার পরিমাণ সাত শত কোটি টাকা।

অনেকে বলছেন যে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের মধ্যে সিন্ডিকেট হয়েছে। তারাই এবার চামড়া রাজারে ধস নামিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুই গ্রুপ মিলে ‘সিন্ডিকেট’ করে কিছু করছে এটা বিশ্বাস করছি না। কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে নৈরাজ্যেরর জন্য বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা ও আড়তদাররা পরস্পরকে দায়ী করলেও এই দুই সংগঠনের নেতাদের একটি বক্তব্য অভিন্ন। উভয়পক্ষই বলছেন, এ বছর টাকা না পাওয়াটাই কাঁচা চামড়ার দাম কমার অন্যতম প্রধান কারণ। আড়তদাররা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের থেকে টাকা পাননি। আর ট্যানারি মালিকরা বলছেন, ব্যাংক থেকে টাকা পাননি।

তাহলে অর্থমন্ত্রী যে বললেন চামড়া কেনার জন্য সাত শ’ কোটি টাকা দিয়েছেন সেটা কি মিথ্যা। মোটেও তাই নয়। কারণ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহর কথাতে তা ফুটে উঠেছে। তারা এই টাকা নিয়ে অতীতের দেনা ঠিকঠাক করেছেন। সাভারে ফ্যাক্টরি হস্তান্তরে ব্যয় হয়েছে বলেছেন।

মূলত আমাদের সিংহভাগ ট্যানারি মালিকের কাছে কোনও নিজস্ব মূলধন নেই। ঈদের সময় ব্যাংক থেকে যে টাকা পান সেটা দিয়েই তারা ব্যবসা করেন এবং ওই টাকায় বাড়ি গাড়ি নানা বিলাসিতায় ব্যয় করেন। এবার ব্যাংকগুলো থেকে যে টাকা তারা নিয়েছেন অনেককে সেটি রিসিডিউলিং করার সময় পূর্বের দেনা পরিশোধ করেছেন। ব্যাংকঋণ তারা আগে পরিশোধ করেননি কেন! করনেনি কারণ সবাই ব্যাংক লুটের ধান্দায় আছেন বলে। এদেশে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে টাকা নিলে ফেরত না দিলেও চলে– এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে সে কারণে তারা এই আস্কারা পেয়েছেন।

আগে আমরা দেখেছি ব্যাংকগুলো খুব কার্যকরভাবে ট্যানারি ব্যবসাকে মনিটরিং করতে। যে কারণে ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত টাকাটা যথাসময়ে উঠে আসতো। নয়-ছয় হওয়ার সুযোগ ছিল না। ব্যাংকগুলো এখন সেই তদারকি করছে না বলেই ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিচ্ছে। তারা চামড়ার টাকাটা পর্যন্ত অন্যত্র সরিয়ে ফেলছে। আর গরিবের হক নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

আরও সত্য হচ্ছে, পোস্তার আড়তদারেরা এক একজন এ রকম ২০/২৫টি ট্যানারি চালানোর মতো ক্ষমতা রাখে। তাদের আর্থিক মজবুতি এতই শক্ত। কিন্তু এবার তারা সম্ভবত ট্যানারিওয়ালাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে মাল কেনেননি আর তার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে সাধারণ মানুষের। তার পরিণতিতে চামড়া শিল্পে এই বিপর্যয় এসেছে।

কোরবানির চামড়া কোরবানিদাতার নয়। এটা বিক্রি করে লিল্লা হিসাবে মিসকিন এতিমদের টাকাটা দিয়ে দেন কোরবানিদাতা। এটা অত্যন্ত বেদনার কথা যে লিল্লার টাকাটা আড়তদার আর ট্যানারির মালিকদের রেষারেষি ও ষড়যন্ত্রে তাদের হাতে যায়নি। তারা কত বড় অপরাধী যারা গরিব এতিমের টাকার হেফাজত করে না। তাদের চেয়ে বদনসিব আর কারও হতে পারে না। এই টাকার ওপর নির্ভর করে চলে অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।

সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মানুষের পাপ-পুণ্য জ্ঞান রহিত হয়ে যায়। যে সমাজে টাকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, মানবতাবোধ সেই সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যারা ষড়যন্ত্র করে মজলুম মানুষের ভিক্ষার থালা কেড়ে নেয় তারা পাষান। খালি ভিক্ষার থালা খুবই ভারী জিনিস। মজলুমেরা তখন এই থালার ভার বইতে অপারগ হয়। সমাজের অবস্থা যখন অনুরূপ হয় তখন সমাজ বিপ্লবের পটভূমি তৈরি হয়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মানুষগুলো এই পাপিষ্ঠদের মুণ্ডপাতে প্রস্তুত হয়।

সবকিছু মিলে এবারের কোরবানির ঈদ মাদ্রাসার লিল্লার টাকা, এতিমের টাকা, গরিবের টাকা মেরে খাওয়া ব্যবসায়ীদের এক লজ্জাহীন সম্মেলন। সরকার যদি তাদের ধরে সাজা না দিতে পারে, সরকারও এই পাপের অংশীদার হলো। কেউ কেউ বলছেন, যদি এটা ১/১১ কাল হতো ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের বহু কর্তাদের হয়তো এই ঘটনার জন্য জেলের ভাত খেতে হতো। আড়তদাররাও রেহাই পেতেন না।

পরিশেষে বলবো, দেশে কাঁচা চামড়ার বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। একটা সাধারণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে এই বছর এক কোটি ১৮ লাখ কোরবানির পশু জবেহ হয়েছে। এরই মধ্যে নাকি পাঁচ শ’ কোটি টাকার চামড়া বিনষ্ট হয়েছে। লবণ বিক্রেতারাও নাকি সিন্ডিকেট করে ৬ শ’ টাকার লবণের বস্তা এক লাফে বার শ ২০ টাকা করে ফেলেছিল। সরকারের উচিত এ বছর কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত বহাল রাখা।

চামড়া শিল্প নিয়ে সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের জরুরি বৈঠক ডাকা উচিত। পত্রিকায় দেখলাম সরকার ২০০৩ থেকে ১৬ বছর ব্যয় করেও সরকার সাভারে ২০০ একর জমির চামড়া শিল্প নগরের সব কাজ শেষ করতে পারেনি। চামড়া শিল্পনগর পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় বিদেশি বড় বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশি চামড়ার পণ্য কেনে না। দেশের ফুটওয়্যারগুলোর পণ্য নিচ্ছে না অনেক বিদেশি গ্রাহক। গত বছর একটি বিদেশি এনজিও বাংলাদেশি পণ্যের অনেক গ্রাহকদের কাছে চিঠি দিয়ে তা করতে সক্ষম হয়েছে।

একদিকে দেশের মানুষ দাম না পেয়ে কাঁচা চামড়া মাটিতে পুতে ফেলছে আর গত অর্থ বছরে বাংলাদেশে বিদেশি চামড়া আমদানি হয়েছে ৯৪৫ কোটি টাকার। ভাবা যায়! এইসব ঘটনা তো প্রমাণ করে না—এসব দেখার কেউ সরকারে আছে!

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com