– ডাঃ মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ

বছর ঘুরে আবার এসেছে ঈদ-উল-আযহা। ঈদে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ) এর স্মৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে পশু কোরবানি দিবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। কোরবানিদাতাদের পশু-ক্রয়কালিন এবং কোরবানি আগে-পরে করণীয় কিছু বিষয় সম্পর্কে জানা একান্ত প্রয়োজন।

পশুর হাটে সুস্থ পশু নির্বাচনে করণীয় :

পশু কিনতে তাড়াহুড়ো না করে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে হাটে গমন করুন।
আপনার পছন্দের পশুকে কিছু ঘাস/খড় সম্মুখে ধরুন, সুস্থ থাকলে সে সামান্য কিছু হলেও খাবে।
সুস্থ পশুর নাকে বিন্দুবৎ ঘাম থাকবে, নাকের উপরের কালো অংশ ভেজা ভেজা এবং চকচকে হবে।
সুস্থ পশুর স্বাভাবিক চাঞ্চল্য থাকবে এবং মাঝে মাঝে জাবর কাটবে।
সুস্থ পশু সচেতন থাকবে, মাঝে মাঝে কান খাড়া করবে ও লেজ নাড়াবে।
কোথাও কোন শব্দ হলে সুস্থ পশু সেদিকে লক্ষ্য করবে।
সুস্থ পশুর শরীরের চামড়া টানটান, পশম মসৃণ ও উজ্জ্বল হবে।
চামড়া টান দিয়ে ছেড়ে দিলে দ্রুত পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।
অনেকক্ষণ খেয়াল করলে সুস্থ পশুকে পায়খানা ও/অথবা প্র¯্রাব করতে দেখবেন, গোবর স্বাভাবিক (পাতলা নয়) ও প্র¯্রাব থাকবে পরিষ্কার।
চলাফেরা স্বাভাবিক কিনা তার জন্য পশুকে হাঁটিয়ে দেখতে হবে।
অন্ধ, পঙ্গু, দাঁতহীন পশু কোরবানির অযোগ্য বলে গণ্য হবে।
কোরবানির জন্য গরুর বয়স দুই বছর বা তার অধিক, ছাগল বা ভেড়ার বয়স এক বছর বা তার অধিক এবং উটের বয়স পাঁচ বছর বা তার অধিক হতে হবে।
পশু ক্রয়ের পর করণীয় ঃ-

সুস্থ পশু ক্রয়ের পরে তাকে যতটা সম্ভব কম হাঁটিয়ে / গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে যাবেন।
বাড়ি নিয়ে প্রথমেই পশুকে পটাশ (পিপিএম) পানি দিয়ে গোসল করাবেন।
পশুহাট ফেরত সকলেই হাত-পা সাবান দিয়ে ধৌত করবেন, সম্ভব হলে গোসল করবেন।
প্রথমে পশুকে ৩-৫ লিটার স্যালাইন পানি পান করান, পেটফাঁপা বা বদহজম থাকলে ১ কেজি পানিতে ১০০ গ্রাম খাবার সোডা মিশিয়ে খাইয়ে দিন।
এরপরে কিছু কাঁচা ঘাস / শুকনো খড় খাওয়ান, ঘন্টা খানেক পরে দানাদার খাদ্য যেমন-কুঁড়া, ভূষি, খৈল প্রভৃতি খেতে দিতে পারেন।
কোরবানীর আগের দিন পর্যন্ত করণীয় ঃ-

পশুর থাকার জায়গা দাঁড়ানোর ও শোবার জন্য উপযুক্ত হতে হবে নতুবা তার মাংসের গুণগত মান হ্রাস পাবে।
প্রতিদিন কোরবানি পশুকে একই সময়ে গোসল করাবেন।
সকালে ও রাতে পশুকে খড় / ঘাস (দানাদার খাদ্য নয়) খেতে দিন।
দিনে কেবল দুইবার দানাদার খাদ্য দিবেন, তার মোট পরিমাণ পশুর শারীরিক ওজনের ১% এর বেশি হবে না।
পশুর সামনে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিশ্চিত করতে হবে।
সারাদিন পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস ও খড় খেতে দিবেন।
কোরবানির ১২ ঘন্টা পূর্ব হতে দানাদার খাদ্য বন্ধ করে শুধু খড় ও পানি খেতে দিবেন।
কোরবানির সময় করণীয় ঃ-

কোরবানির সকালে কেবল খাবার সোডা মিশ্রিত পানি পান করাবেন, অন্য কিছু নয়।
যত্রতত্র জবাই না করে যথাসম্ভব নির্ধারিত জায়গায় সকলে জবাই করুন। একাধিক অপশন থাকলে জায়গা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ইত্যাদি বিবেচনাপূর্বক একটি সার্বজনীন জায়গা নির্বাচন করুন।
জবাইয়ের পূর্বে নির্ধারিত স্থানে গর্ত খুঁডুন।
পশুকে ভালোভাবে বাঁধার জন্য পর্যাপ্ত পাটের নতুন/ পরিষ্কার দড়ি রাখুন।
জবাইয়ের জন্য বাঁধার পূর্বে পশুর গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে, হৈ হুল্লোড় এড়িয়ে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ নিশ্চিত করুন। উল্লেখ্য, যেকোন ধকল, ভীতি বা অপ্রয়োজনীয় ভোগান্তি পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা যা মাংসের গুণগত মান হ্রাস করবে।
অবশ্যই অবশ্যই পর্যাপ্ত ধারালো ছুরি ব্যবহার নিশ্চিত করুন।
শিশু, অতিবৃদ্ধ বা মানসিকভাবে সবল নয় এমন লোকজনকে জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা যথা সম্ভব নিরুৎসাহিত করুন।
পশুর চামড়া ছাড়ানো বিষয়ে করণীয় ঃ-

পশু জবাই করার পূর্বে ভালভাবে গোসল করাতে হবে এবং প্রচুর পানি খাওয়াতে হবে।
ধারালো ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে জবেহ করার স্থান থেকে গলা, সিনা ও পেটের উপর দিয়ে সোজা-সোজি দাগ কাটতে হবে।
সামনের দুপায়ের হাটু থেকে সিনা পর্যন্ত একটি দাগ কেটে প্রথম দাগের সাথে যোগ করতে হবে এবং অনুরুপভাবে পিছনের দু’পায়ের হাটুর নীচ থেকে দাগ কেটে প্রথম দাগ পর্যন্ত কাটতে হবে।
সর্বোচ্চ সর্তকতার সাথে চামড়া ছাড়িয়ে, তাতে দ্রুত পরিমাণমত (প্রতি কেজিতে ২০০ গ্রাম) লবণ ছড়িয়ে দিতে হবে।
ছাড়াইকৃত চামড়া যথাশীঘ্রই বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কোরবানির পর করণীয় ঃ-

ফ্রিজারে সংরক্ষণের প্রয়োজন হলে কাটার পরপর মাংস স্তুপ না করে যথাসম্ভব ছড়িয়ে ঠান্ডা হতে দিন, দ্রুততার সাথে ছোট ছোট প্যাকেট ফ্রিজে রেখে কয়েক ঘন্টা পরপর ওলটপালট করে সমভাবে শীতলিকরণ নিশ্চিত করুন; অন্যথায় মাঝখানে রাখা মাংস নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
ফ্রোজেন মাংস কোন কারণে একবার গলানো হলে / গলে গেলে দ্বিতীয়বার ফ্রিজিং করা যাবেনা, এতে মাংস নষ্ট হয়ে যাবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করণীয় ঃ

সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই করুন।
রক্ত, মল-মূত্র ও বর্জ্য একত্রে গর্ত করে পুঁতে ফেলুন।
পশু জবাইয়ের স্থান ডিটারজেন্ট ও ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে ভাল করে ধৌত করুন এবং আশেপাশে চুন ছিটিয়ে দিন।
পশু জবাই করার পর রক্ত যাতে চারদিকে ছড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি না করে সে ব্যাপারে সর্তকতা অবলম্বন করুন।
সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য ফেলুন।

 

লেখক: ভেটেরিনারি সার্জন,বিসিএস (প্রাণিসম্পদ) ,উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ,টেকনাফ, কক্সবাজার। মোবাইল-০১৮১১-৯৮৬৬০৫