মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

“আমি যখন টিআরসি (ট্রইনি রিক্রুট কনস্টেবল) পদে চাকুরীতে নিয়োগ পাওয়ায় জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর কুতুবদিয়া উপজেলায় আমার গ্রামের বাড়িতে যাই, রাস্তায় হাঁটি, তখন আমার কাছে সবাই জানতে চায়, তোমার নাকি পুলিশে চাকুরী হয়েছে? আমি বলি-হ্যাঁ। কিভাবে চাকুরী পেয়েছ, জানতে চাইলে আমি বলি, সরকারি চালান ফরমের মাধ্যমে ১০০ টাকা ব্যাংকে জমা এবং ৩ টাকায় একটি আবেদন ফরম ক্রয় করে, সর্বসাকুল্যে মোট ১০৩ টাকা ব্যয় করে পরীক্ষা দিয়ে অন্য কোন খরচ ছাড়া পুলিশের চাকুরীটা পেয়েছি। যারা আমার কাছে জানতে চায়, তারা আমাকে সাথে সাথে বলে ‘মিথ্যা বলোনা, পুলিশে আবার ৪/৫ লাখ টাকার নীচে ঘুষ নাদিলে চাকুরী হয় নাকি? তারা আমার কথা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে চায়না। তারা বার বার বলে আমি মিথ্যা বলছি। একইভাবে আমি যখন আমার সাবেক কর্মস্থল গার্মেন্টসে যায়, তারাও জানতে চায়-কোথায় গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে-তখন আমি টিআরসি নিয়োগ পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম বললে, তারাও জানতে চায়, সেখানে রেজাল্ট কি হয়েছে, আমি বললাম মাত্র ১০৩ টাকার বিনিময়ে পুলিশের চাকুরীটা পেয়েছি। তারা আমাকে ধমক ও গালি দিয়ে বলেন, পুলিশে কিভাবে ১০৩ টাকায় চাকুরী হয়। আমি বললাম, শুধু আমি না, আমাদের কক্সবাজার জেলায় যে ৩৮৬ জন টিআরসি’র চাকুরী হয়েছে, তারা প্রত্যেকে মাত্র ১০৩ টাকা করে খরচ করেছে। বিশ্বাস করুন, এর বাইরে একটি টাকাও আমাদের খরচ হয়নি।” গত বৃহস্পতিবার ৮ জুলাই সকালে কক্সবাজার জেলা পুলিশের সদ্য নিয়োগকৃত ৩৮৬ জন টিআরসি-কে কক্সবাজার পুলিশ লাইনে দেয়া এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে নিজের নিয়োগ সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কুতুবদিয়া উপজেলার তারেক আজিজ এ অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন। এসময় তারেক আজিজের আনন্দের অশ্রু আর অডিয়েন্স ও মন্ঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিদের মুর্হুমুহু করতালিতে পুরো সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান আবেগময়তায় প্রাণের উচ্ছাসে ভরে উঠে। তারেক আজিজ বলেন-“আমি একটি গার্মেন্টসে নামমাত্র বেতনে চাকুরী করতাম। সেখানে সকাল সাড়ে ৭ টা থেকে রাত ১০/১১ টা পর্যন্ত কলুরবলদের মতো কাজ করতে হতো। কোন ছুটি নেই। আমি টিআরসি পরীক্ষা দিতে আসায় আমাকে উক্ত গার্মেন্টেসে ১০ দিন কাজে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। আমি একটি মেচে থাকতাম। আমি গার্মেন্টস থেকে রাত্রে আসতে আসতে মেচের অন্যান্যরা সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। আমি প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে আসতাম। তাই রান্নাবান্না নাকরে অল্প নাস্তা খেয়ে শুতে যেতাম। সবাই তখন ঘুমাতো, আর আমি কান্না করে করে নির্ঘুম রাত কাটাতাম। আমি যে কিরকম অভাবের সংসারে জন্মগ্রহণ করেছি, সেটি আমি আপনাদের বুঝাতে পারবোনা। আমি একজন খুবই গরীব, অসহায় কৃষকের ঘরের সন্তান, সংসারে সবসময় অভাব লেগেই থাকতো। আমার বাবা-মা আমার পড়াশোনার খরচ যোগাতে পারতেন না। তাই গার্মেন্টেসের চাকুরীটা দুর্বিসহ কষ্ট করে হলেও ধরে রাখা আমার জন্য অপরিহার্য ছিল। গার্মেন্টসে থেকে আমি রাঙ্গামাটি কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে প্রথম বর্ষ অনার্সে ভর্তি ছিলাম।” টগবগে তরুণ তারেক আজিজ তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আরো বলেন, “আমার মাকে আমি কিছুদিন আগে বলি, মা আমি একটা সাদা শার্ট সেলাই করবো। আমাকে ১ হাজার টাকা দাও। মা বললো, কিছুদিন পরে নিও। আমি তখন মাকে বললাম আমার পুলিশে চাকুরী নেয়ার সময় যদি তোমাদের ৪/৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো, তখন তোমরা কি করতে। তখন আমার মা একদম নীরব হয়ে যায়। আগে আমি নিজেও শুনতাম ৪/৫ লাখ টাকার নীচে পুলিশের কোন চাকুরী হয়না। এখন মাত্র ১০৩ টাকা খরচ করে একটা সরকারি চাকুরী পাওয়ায় আমি যে কি খুশী, আমার মা-বাবা কতই যে আনন্দিত-সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এখন আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা আপনাদের কাছে ঋনী ও চিরকৃতজ্ঞ। বিশেষ করে, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম ও আমার কুতুবদিয়া-মহেশখালী এলাকার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক মহোদয়কে আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
তারেক আজিজ যখন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করছিলেন, সবাই তখন অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারেক আজিজের ৪ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের প্রাণের স্পন্দন আর জবানের অভিব্যক্তিতে সবাই ছিলো মন্তরমুগ্ধ মতো স্তদ্ধ। আর এই তারেক আজিজ হলো-কুতুবদিয়া উপজেলার লেমশীখালী ইউনিয়নের আনুর বাপের পাড়ার সিরাজুল ইসলাম ও হোসনে আরা বেগমের পুত্র। ৩ ভাই, ২ বোনের মধ্যে সে সবার বড়। সে টিআরসি নিয়োগ পরীক্ষায় সাধারণ পুরুষ কোটায় ৫৫ নম্বর ক্রমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে।
একইভাবে টিআরসি পদে প্রাথমিকভাবে নিয়োগ পাওয়া তোফাজ্জল হোসেন সাগর তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন-আমার বাবা একজন রাজমিস্ত্রী। সংসারে নুন আনতে পান্থা পুরায়। পুলিশ বাহিনীতে ১০৩ টাকায় এই চাকরি না পেলে আমার রাজমিস্ত্রী বাবার পক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে আমার চাকরির ব্যবস্থা করা কখনো সম্ভব হতোনা।

১০৩ টাকায় পুলিশের চাকুরী পাওয়া তারেক আজিজ।

রুপসী দেবী নামের টিআরসি নিয়োগ পাওয়া আর এক তরুণী বলেন, আমার ভ্যানগাড়ি চালক বাবা আজ অনেক বেশী খুশি। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার বাবা কত যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন-সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা।
উর্মি দে একজন দিন মজুর বাবার কন্যা। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো-তার ৭ ভাই বোনের মধ্যে ২ বোন ও ১ ভাই প্রতিবন্ধী। চরম অভাব অনটনের সংসারে পুলিশে আমার চাকরি হওয়ায় আমার পরিবার নিশ্চিত সামাজিক বিপর্যয়ের হাত থেকে সুরক্ষা পেলো। আর লাখ লাখ টাকা দিয়ে পুলিশের চাকুরী নেয়া, সেটা আমার পরিবার কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা।
টিআরসি রীনা আকতারের মা রেহেনা বেগম বলেন, আমার স্বামী নেই। এমন অসহায় অবস্থায় আমার কন্যার চাকুরী আমার জন্য একটা সোনার হরিণ। মাত্র ১০৩ টাকায় খরচে এ বিশাল প্রাপ্তিতে আমারা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে টিআরসি ও তাদের অভিবাবকদের মুখে এমন আবেগঘন অনুভূতি শুনে মন্ঞ্চে উপস্থিত অতিথিরাও বেশ পুলকিত হন এবং সবার চোখেমুখে নৈতিকতার এক বিশাল দর্পন ভেসে উঠছিলো। টিআরসি ও অভিভাবকদের কথায় মনে হচ্ছিল, তারা যেন নৈতিকতা, শিষ্টাচার, সাহসিকতা, আর্দশ, দেশপ্রেম, একাগ্রতা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের চেহারটা পাল্টে দেবে। গড়ে তুলতে প্রস্তুত ঘুষ, দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত প্রিয় মাতৃভূমিকে। যেন তাদেরকে প্রিয় মাতৃভূমি হাতছানি দিয়ে বার বার ডাকছে, তোমরা আসো, তোমাদের বড় বেশী প্রয়োজন। তোমরাই পারবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর হৃত গৌরব পূণরুদ্ধার করতে। তোমরাই পারবে, নতুন প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে। শুধু তারেক আজিজ কিংবা রূপসী দেবী নয়, ৩৮৬ জনের প্রত্যেকের চেহারা বলে দিচ্ছিলো, তোমারাই অপ্রতিরোধ্য, তোমরাই পারবে, তোমরাই বাংলাদেশ, আর থেমে থেকোনা, অদম্য অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাও।
সম্পূর্ণ দুর্নীতি মুক্ত, মাত্র ১০৩ টাকায় টিআরসি নিয়োগের সফল কারিগর কক্সবাজারের স্বনামধন্য পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব জাফর আলম, কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আদিবুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) নিহাদ আদনান তাইয়ান, সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) বাবুল বনিক, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (চকরিয়া সার্কেল) কাজী মতিউল হক, সহকারী পুলিশ সুপার (ডিবি), কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক ও দৈনিক কালেরকন্ঠের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের চৌধুরী, কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি ফরিদ উদ্দিন খন্দকার পিপিএম বক্তব্য রাখেন।
সম্বর্ধিত সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত টিআরসি’দের পক্ষে কুতুবদিয়ার তারেক আজিজ, তোফাজ্জল হোসেন সাগর, উর্মি দে, রূপসী দেবী তাদের অনুভূতি প্রকাশ এবং নিয়োগপ্রাপ্ত টিআরসি’র মা’দের পক্ষে অনুভূতি প্রকাশ করেন রেহানা বেগম ও পলি বড়ুয়া। সম্বর্ধনা সভায় নিয়োগপ্রাপ্ত সকল টিআরসি কে ফুল দিয়ে উঞ্চ সম্বর্ধনা জানানো হয়।
(লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা।)