আজিম নিহাদ :

সরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারী হাসপাতালগুলোতেও নিয়মিত ডেঙ্গু রোগি সনাক্ত হচ্ছে এবং ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। কিন্তু জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ অর্থাৎ সিভিল সার্জন অফিসে সেই তথ্য নেই। বেসরকারী হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহের বিষয়েও বেশ উদাসীন। সঠিক তথ্য উঠে না আসায় কক্সবাজার থেকে ডেঙ্গু সনাক্তের বিষয়ে ‘গরমিল’ হিসাব পাঠানো হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।

চকরিয়ার সাংবাদিক মিজবাউল হক জানিয়েছেন, চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে এখানে অবস্থিত কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরীতে ৭ জন, মা ও শিশু হাসপাতালে ১ জন ও জমজম হাসপাতালে ৬ জন সনাক্ত হয়েছেন। অনেকে চিকিৎসাধীনও আছেন। আর বেশিরভাগই চকরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া রোগি।  তিনি এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বেসরকারী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে কথা বলেছেন।

জেলা সদরের বাইরে হঠাৎ চকরিয়ায় ডেঙ্গু রোগির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে রীতিমত আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। জ¦র দেখা দিলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে লোকজন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো ২০টি কিট মাত্র দুয়েকদিনেই শেষ হয়ে গেছে। এর বাইরে বেসরকারী হাসপাতালে পরীক্ষা করার তালিকা আরও দীর্ঘ চকরিয়াতে।

কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- চকরিয়ার তিনটি বেসরকারী হাসপাতালে আরও তিনদিন আগে সনাক্ত হওয়া ১৪ জন ডেঙ্গু রোগির কোন তথ্য কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে নেই। এসব তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বশীল কোন জবাবও দেননি সিভিল সার্জন।

সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, ‘চকরিয়ায় আমাদের হিসাবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগি সনাক্ত হয়েছে ৫ জন। সবাইকে সনাক্ত করা হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এর বাইরে আর কোন রোগি আছে কি না সেই বিষয়ে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই।’

চকরিয়ায় বেসরকারী হাসপাতালে সনাক্ত হওয়া রোগিদের বিষয়ে জানতে তিনি বলেন, ‘নিয়ম হচ্ছে প্রত্যেকটি সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন সকাল ৯টার আগে আমাদেরকে মুঠোফোন অথবা ই-মেইলের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগির তথ্য জানিয়েছে দেবেন। কিন্তু এখন কেউ যদি নিজ থেকে না জানায় তাহলে আমাদের কি করার আছে? চকরিয়ায় বেসরকারী হাসপাতালে যে ১৪ জন রোগি সনাক্ত হয়েছে সেই তথ্য আমাদেরকে পাঠানো হয়নি এবং এমন কোন তথ্য নেইও।’

কক্সবাজারের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কড়া নির্দেশনা আছে ডেঙ্গু রোগিদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংগ্রহ করে অধিদপ্তরে পাঠানোর বিষয়ে। বেসরকারী হাসপাতালের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিভিল সার্জন অফিসকে ডেঙ্গু রোগির তথ্য অবগত করবেন। অপরদিকে সিভিল সার্জন অফিসেরও দায়িত্ব হচ্ছে বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখা। এই সময়ে এসে সঠিক তথ্য না থাকা এবং তথ্য সংগ্রহে উদাসীনতা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার।

চকরিয়ার বিষয়ে এই চিকিৎসক বলেন, সেখানকার বেসরকারী হাসপাতালের তথ্যগুলো সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি হিসেবে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সংগ্রহ করা উচিত। কিন্তু কেন করেনি সেটা আসলে বোধগম্য নয়। এই দুঃসময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগিদের তথ্য সংগ্রহে গড়িমসি করলে ডেঙ্গু রোগির সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হবে না। ভুল তথ্য যাবে মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। যেটা কোনভাবেই কাম্য নয়।

সাংবাদিক মিজবাউল হক আরও জানান, হঠাৎ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগি বেড়ে যাওয়ায় মশক নিধনে বেশ তৎপরতা শুরু হয়েছে চকরিয়ায়। উপজেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্যবিভাগ এবং চকরিয়া পৌরসভার পাশাপাশি সেনাবাহিনীও মাঠে নেমেছে। যেসব স্থানে ডেঙ্গুর জীবানুবাহী লার্ভা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে সেসব স্থানে পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং সর্বত্র ডেঙ্গু নিধনের স্প্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে শহরের বেসরকারী ডিজিটাল হাসপাতালেও সদরের খরুলিয়ার আশরাফুল নামে ৯ মাস বয়সী এক শিশুর ডেঙ্গু সনাক্ত হয়। পরে তাকে সদর হাসপাতালে রেফার করা হয় বলে জানিয়েছেন ডিজিটাল হাসপাতালের পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিসেস) হাসনা হুরাইন।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (৬ আগষ্ট) সকাল ৯টা পর্যন্ত কক্সবাজারে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫ জনে। তৎমধ্যে সদর উপজেলার (পৌরসভাসহ) ২৬ জন, রামুতে ৯ জন, চকরিয়ায় ৫ জন, উখিয়ায় ৪ জন, মহেশখালীতে ২ জন, টেকনাফের ১ জন বাসিন্দা। এছাড়া কক্সবাজার জেলার বাইরে থেকে এসেছেন ৮ জন রোগী।

এ কার্যালয় থেকে আরও জানা গেছে, গত ৫ আগষ্ট সকাল ৯টা থেকে ৬ আগষ্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু সনাক্ত হয়েছে মাত্র ৩ জনের। এ তিনজনই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মঙ্গলবার সকাল ৯টার হিসাব অনুযায়ী সর্বমোট ডেঙ্গু সনাক্ত রোগির সংখ্যা ৫৫ জন হলেও বাস্তবে সনাক্ত রোগির সংখ্যা আরও বেশি। কারণ মঙ্গলবার সকাল ৯টার পর আরও দুইজন ডেঙ্গু সনাক্ত রোগি সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সেই হিসেবে বর্তমানে সরকারী হিসাবমতে ৫৭ জনের ডেঙ্গু রোগ সনাক্ত হয়েছে (চকরিয়ার বেসরকারী হাসপাতালে সনাক্ত হওয়া ১৪ জন রোগি বিহীন)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতে ডেঙ্গু টেস্ট কিট, ডেঙ্গু রিঅ্যাজেন্ট এবং প্লাটিলেট ও প্লাজমা কিট সহ ডেঙ্গু রোগ নির্ণয়ের অন্যান্য ল্যাব সরঞ্জামের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

তবে সেক্ষেত্রে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে কিটসহ যাবতীয় সবকিছু মজুদ রয়েছে। এমনকি ঈদের মৌসুমে ডেঙ্গু রোগি বাড়ার আশঙ্কা সামাল দিতেও সদর হাসপাতাল প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন তত্ত্ববধায়ক ডা. মো. মহিউদ্দিন।

ডেঙ্গু রোগ পরীক্ষার কিট ও অন্যান্য সরঞ্জামের অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে রোববার কক্সবাজার জেলার জন্য মাত্র ১২০ টি কিট পাওয়া গেছে। অথচ চাওয়া হয়েছিল ৫০০ কিট। ১২০ টি কিটের মধ্যে ৪০টি দেওয়া হয়েছে সদর হাসপাতালে। চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরবরাহ করা হয়েছে ২০টি কিট। মাত্র দুইদিনেই এই ২০ টি কিট তাদের শেষ হয়ে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যে চাহিদার বাকি কিটগুলো অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দ পেতে পারেন বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

তিনি আরও বলেন, রামু সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ভিডিশন থেকে বেশকিছু কিট সরবরাহ দেবে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কখন এবং কি পরিমাণ দেবেন সেই বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আরএমও ও ডেঙ্গু সেলের সদস্য সচিব ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া বলেন, সদর হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছে ১৯ জন রোগি। এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৫০ জন রোগি। তৎমধ্যে একজন চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে মারা গেছেন। আর চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। বাকিরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সংখ্যা বেশি। মানুষ যদি একটু সচেতন হয় তাহলে পুরোপুরি ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। এরজন্য তিনি আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও রাতে মশারী ব্যবহারের পরামর্শ দেন।