॥ বিশ্বজিত সেন ॥

আধুনিক বিশ্ব এখন জ্ঞান বিজ্ঞান উন্নত চিন্তার বিশ্ব হিসাবে স্বীকৃত। বিশ্ব প্রতিযোগিতায় এখন পৃথিবীর প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক দেশকে লড়তে হচ্ছে। সৈন্য, যুদ্ধাস্ত্রের চাইতে কলম ও মেধার শক্তি অনেক শক্তিশালী। অস্ত্র মানব বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, অস্ত্র দিয়ে কেউ মানুষের মূল্যবোধ, মানব মননকে দখল করতে পারেনা। আবার প্রকারান্তরে যে কোন শক্তিকে গড়ে তুলে শিক্ষা। এজন্য যুগে যুগে কালে কালে শিক্ষা সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছে। তবে একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হতে পারে যখন সে প্রচুর জ্ঞানার্জন করে।

একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞানার্জন করতে হলে বই পড়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। আর শিক্ষার্থীরা এখন শুধুমাত্র ক্লাসের পড়া পড়ে তাঁর পক্ষে প্রকৃত জ্ঞানার্জন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া দেখা যাচ্ছে, উচ্চতর শিক্ষা সহ বিভিন্ন কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতায় শুধুমাত্র পঠিত বই এর সাহায্যে কোন ভালো ফলাফল করা যাচ্ছেনা। জ্ঞানার্জন এখন শুধু দেশে নয় বিদেশেও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রধান বিষয়। বর্তমান পৃথিবী হচ্ছে তথ্য সমৃদ্ধের, তথ্য বিনিময়, তথ্য জানার যুগ। বিভিন্ন তথ্য জানতে গিয়ে অবশ্যই ক্লাসের বই এর বাইরে সবাইকে পড়তে হয়, জানতে হয়। এজন্য বই পড়ার এখন কোন বিকল্প নেই।

বর্তমান আধুনিক যুগে সার্বিক উন্নতির মাঝে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নৈতিক অবক্ষয় সারাদেশে শেকড় ছড়িয়েছে। আমাদের দেশের তরুণ এবং যুব সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ চরম অবক্ষয়ের মধ্যে চলে গেছে, যা আমাদের আগামী ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত। আজকের নৈতিক অবক্ষয় এতই ছড়িয়েছে যে স্কুলের ছেলেদের মধ্যেও নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। অথচ এসব কিশোর তরুণ যুবকরা আগামী দিনের বাংলাদেশের পরিচালন শক্তি, এ শক্তি যদি নৈতিক অবক্ষয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে জাতির ধ্বংস হয়ে যেতে বেশি দিন সময় লাগবেনা।

বিভিন্ন উন্নত দেশের শিক্ষা পাঠ পদ্ধতি, শিক্ষাঙ্গন বিশ্লেষন করে দেখা গেছে সেসব দেশে নিজেদের নতুন প্রজম্মকে উন্নততর মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে তারা একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে স্কুল পাঠক্রমের বাইরে জ্ঞানার্জনের জন্য জীবনমুখী বই পড়ায়। তাছাড়া স্কুলের গন্ডীবদ্ধ শিক্ষার বাইরে ব্যবহারিক শিক্ষার দিকে ছাত্রদের মনোযোগ বাড়ায়। এসব ভিন্নধর্মী জ্ঞানার্জনের কার্যক্রম সেসব দেশের বিভিন্ন অবক্ষয়ের মধ্যে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো, জাতিকে বিকশিত করার মতো প্রাণস্পন্দন ধরে রাখে। যার জন্য জ্ঞানার্জনধর্মী বিভিন্ন কার্যক্রম ঐসব দেশে খুবই জনপ্রিয়।

জ্ঞানার্জন ধর্মী বই পড়া একজন মানুষকে প্রকৃত অর্থে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। মানুষের চিন্তা, বিবেক, মননশীলতা বিকশিত হবার জন্য বই পড়া সর্বোত্তম। মহৎ সাহিত্য, জীবনধর্মী সাহিত্য একজন মানুষের মনের জানালা খুলে দেয়। নির্ভরযোগ্য মানসিক শক্তি গড়ে তুলতে বই পড়া অদ্বিতীয়। আর বই পড়া বিভিন্ন অবক্ষয়জনিত কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখতে পারে। প্রকৃত বই প্রেমিক প্রকৃত শুদ্ধাচারী মানুষ দেশ ও জাতির জন্য অনন্য সম্পদ। আমরা এমন একটি যুগের সামনে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে প্রকৃত মননের শুদ্ধতম আলোকধারা কম বিকশিত হয়। এসবের মূল কারণ হচ্ছে আমাদের প্রচলিত পাঠ্যক্রমের বাইরে জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়তে শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহিত করা হয়না। যার জন্য জ্ঞান বিজ্ঞান মননশীলতার বিশাল ভান্ডার থেকে শিক্ষার্থীরা অনেক দূরে থাকছে। এটা আমাদের জাতিগেত ক্ষতি, এ ক্ষতির জন্য আমাদের প্রচলিত সামাজিক শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী।পাঠক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের বই পড়াকে শিক্ষার্থীদের প্রায়ই অভিভাবকরা গুরুত্ব দেননা। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে উৎসাহ পায়না, অথচ কিশোর বয়স থেকে তারা জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠ্যক্রমের বাইরে বই পড়তে পারতো-এটা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতো।

প্রচলিত পাঠক্রমের বাইরে জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়া আদতেই শিক্ষাঙ্গনের লেখাপড়াকে মোটেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না। বরঞ্চ পাঠক্রমে এটা অত্যন্ত সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। অথচ দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে শিক্ষার্থীদের প্রচুর জ্ঞানার্জনের পথটি এ সমাজ খুলে দেয়না। যার জন্য আমরা একটি উচ্চায়ত সমাজ গড়তে বারবার পিছিয়ে পড়ছি।শিক্ষার্থীদের প্রচলিত পিছনে পড়ার অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে। এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষদের। একটি সুন্দর প্রতিশ্রুতিশীল জ্ঞান বিকাশের আলোকধারা গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতির আগামী ভবিষ্যত প্রজম্ম উচ্চ মেধার মননশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসা এখন জরুরি। লেখক : সাংবাদিক, গবেষক, পরিবেশবিদ।