মুহাম্মদ ফেরদাউস:
আমার এই লেখা হয়ত কেউ পড়বেন কেউ পড়বেন না। কতলেখা কতকথা আজকাল লেখালখি হয়। এতে কি সরকার বা নীতিনির্ধারক শ্রেণির মানুষের টনক নড়ে? ৩ আগষ্ট বিকাল ৩.৪০ মিনিটে একটা ফোন পেয়ে আমার ছেলে আমাকে বল্লো তার বন্ধু হাসপাতালে ভর্তি অবস্থা ভালো না। সম্ভব হলে এখনি হাসপাতালে একবার যাওয়া দরকার । আমি ছেলেকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ বাইকে রওয়ানা দিলাম হাসপাতালে উদ্দেশ্য। আমার ছেলে ঢাকার বারিধারা এলাকার একটি বেসরকারি কলেজের ছাত্র। মালিবাগ খিলগাঁও চৌরাস্তা পার হয়ে ঢাকার জ্যাম ঠেলে আমাদের হাসপাতালে পৌঁছাতে ৫০-৫৫ মিনিট লাগে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি রোগী’র বাবা মা কান্না করছে। রোগী’র স্কুলের স্যার তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত গামছা দিয়ে মুছে দিচ্ছে রোগীর আরেক বন্ধু স্যারকে সাহায্য করছে। রোগীর ভাইগুলো ঢাকা শহর জুড়ে সব সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে একটি সিটের জন্য পাগলের মতো হন্য হয়ে খোঁজে বেড়াচ্ছে। কোন হাসপাতালে আইসিইউতে সিট খালি পাওয়া যাচ্ছে না। মুগদা এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে একটি সিটের আশা করেছে তাও ৪ আগষ্ট সকালে রোগী রিলিজ হলে তাদের দেয়া হবে। কি ভয়ংকর একটি মুহূর্তে আমি ছেলের অসুস্থ বন্ধুর মা বাবা বন্ধু আর শিক্ষকের মাঝে আসহায় বসে আছি। ৫ মিনিট ধরে আমি কোন চিন্তাই করতে পারছিলাম না। বাসায় যখন দুপুরে খাবার খেতে বসি তখন টিভিতে প্রচারিত খবরে দেখছিলাম। ডেঙ্গু নিয়ে সরকারের তথ্যমন্ত্রী সাথে কিছু লোকজনের পরিস্কার রাস্তায় ফটোসেশান, উত্তরে মেয়রের ঝাড়ুসেশন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হাসপাতাল পরিদর্শন পরবর্তী সাংবাদিক কথন আর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেবের পরামর্শ। কিছুটা আস্থা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় বার্ণ ইউনিটে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন করে নেয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার খবরে। ওখানেও খবর নেয়া হলো, তাতে আইসিইউর কোন সুবিধা পাওয়া গেলো না। শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্ত হলো কাল মানে ৪ আগষ্টের ১০ টা পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার। মনটা স্বাভাবিক ভাবেই খুব খারাপ হয়ে গেলো। ঢাকা শহরে এত এত হাসপাতাল। কোন হাসপাতালে একটি আইসিইউতে সিট নাই? অথচ সরকারের এত্তো সব আয়োজন আর সব প্রচারণা। গত মাসের ১৬-২২ তারিখ আমার ছেলেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ ওর তেমন সমস্যা হয়নি। সে যাত্রায় মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতে সেরে উঠেছে। তার রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা ছিলো ১ লাখ বিশ হাজার। তা পরে ১ লাখ ৮০ হয়ে স্বাভাবিক হয়েছিলো। আর ছেলের বন্ধু’র রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা ভর্তি’র সময় ৮০ হাজার থাকলেও কমতে কমতে গতকাল সকালে মাত্র ২৭ হাজারে নেমে আসে আর তখনই ডাক্তার তাকে অন্য কোন হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি’র পরামর্শ দেন। শুরু হয় মা বাবার দুশ্চিন্তা কান্না আর আইসিইউতে সিট খুঁজাখুঁজি। এই সংকট মুহূর্তে আমি আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে কল দিলাম। তিনি পিজি হাসপাতালের ডাক্তার। জরুরি সাহায্যের প্রয়োজনে আমি সবসময়ই তার সাহায্য চেয়ে পাই। আমার ফোন পেয়ে তিনি ১০ মিনিট সময় নেন। ২০ মিনিট পর আমি আবার কল দিলে ওনি জানাচ্ছি বলে সময় নেন। এদিকে আমরা ভর্তি হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বসে আছি। কেউ জানি না কি হয় আল্লাহ ভরসা দেখা যাক। ৩০ মিনিটের চেষ্টায় আল্লাহ রহমতে মগবাজারে ইনসাফ বারাকা নামের হাসপাতালের আইসিইউতে একটা সিট খালি পাওয়া গেলো। এরপরে এম্বুলেন্সে তাকে নিয়ে মালিবাগ মৌচাকের জ্যাম ঠেলে আমরা ৫ মিনিটের পথ ৫০ মিনিটে পৌঁছালাম। জরুরি বিভাগে জরুরি কাজ সেরে রোগী এখন আইসিইউতে। গত ২ দিনে আগের হাসপাতালে ১৯ হাজার টাকা বিল মিটিয়ে নতুন আইসিইউতে সিট ভাড়া দিন প্রতি বেসিক ১৭ হাজার টাকায় চিকিৎসা শুরু হলো। রোগী’র মা বাবা ভাই বন্ধুদের সান্ত্বনা দিয়ে আমি ছেলে তার আরেক বন্ধু আর তাদের শিক্ষক যিনি বাবার চেয়েও বেশি সেবা আর টেনশনে ছিলেন। আমার আর রোগীর মা-বাবার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ। যিনি রোগীর সেবায় মা বাবাকেও ছাঁড়িয়ে গেছেন যা এই যুগে বিরল। আমরা রাত ৯ টার দিকে বাসা ফিরছিলাম। হাসপাতালে এত রোগী দেখে মনে হয়নি এগুলো কোন হাসপাতাল। ঢাকা শহরে একটানা ৭ বছরের প্রবাস জীবনে কতশত রুগীর চেহেরা দেখা আর সেবা পরামর্শ দেয়ার সুযোগ আল্লাহ পাক আমাকে দিয়েছেন। আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত অনেক মানুষ রোগী হিসাবে পেয়েছি। আমি গতরাতে ঘুমাতে পারেনি। এই ছেলেটা আমার ছেলেও হতে পারতো। আমার দেখা রোগীর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী যে কয়জন দেখেছি তার মধ্যে এই ছেলেটা খুবই কষ্টে আছে। আল্লাহর বিশেষ রহমতে সে এই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যাক এই দোয়া করছি। মানুষের আহাজারি দেখালাম হাসপাতালে ভর্তি বা ভর্তি করাতে এসে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটাছুটি। সরকার বা মিডিয়া অনেক কথাই বলছে। সরকার, মেয়র, মন্ত্রী কারো জীবন রক্ষা করতে পারবে না। কারো কথায় কিছু আসবে যাবে না। কক্সবাজারের মেয়ে নুশাং জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসে মারা গেলো। সে আর ফিরে আসবে না। কত নাম জানা না জানা মানুষগুলো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আর একটা রোগি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি মানেই দৈনিক ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ।
আমাদের কারো উপর ভরসা করে লাভ নেই একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। সরকারের মন্ত্রী, মেয়র ফটোসেশান করে করুক। আমরা আমাদের আশপাশ পরিস্কার রাখি। ডেঙ্গু মশা উৎপাদন করে এমন জায়গা পরিস্কার রাখি। রাতে দিনে বাসায় মশারী টাংঙ্গিয়ে ঘুমাই। অবহেলা করার দিন শেষ। সাবধানে থাকুন আল্লাহ না করুন সামনে আরো খারাপ সময় আসতে পারে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর পরিবেশবিদরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। সামনে আরো প্রকোপ বাড়তে পারে। ঈদে মানুষ গ্রামে বেড়াতে গেলে সমস্যা আরো বাড়ার সম্ভাবনা। সব কিছু মিলিয়ে সাবধানে প্রিয় বাংলাদেশ। নাটক সিনেমা দেখা আর দেখানোর সময় শেষ। আমাদের এই দেশেই থাকতে হবে। গরীবের সেকেন্ড হোম নাই। আমাদের আমেরিকা, সিংগাপুর, মালেশিয়ায় বাড়ি নাই। আমাদের প্রাণের বাংলাদেশই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল।