ডেস্ক নিউজ:

দেশে ‘গুড গভর্নেন্স’ তথা সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকার তার কার্যক্রম এবং সব ধরনের সেবা অনলাইনে দিতে ইন্টারনেট গভর্নেন্স বা ই-গভর্নেন্সের পথে বেশ জোরেশোরেই এগোচ্ছে। জাতিসংঘের একটি সূচকও একই কথা বলছে। এরইমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরিও সম্পন্ন হয়েছে। বিগ ডাটা, রোবটিকস, অগমেন্টেড রিয়েলিটি ও ইন্টারনেট অব থিংসে (আইওটি) বাংলাদেশ বেশি মনোযোগী হলেও এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তির গবেষণা ও এর ব্যবহারে দেশ পিছিয়ে আছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এ খাতের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। ইউডিসি বা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, পোস্ট ই-সেন্টার তৈরি, জাতীয় তথ্য বাতায়ন, ৫০০ অ্যাপস, মোবাইল সিম নিবন্ধনে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ ইত্যাদি ই-গভর্নেন্সের পথে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহার, অপব্যবহারের কারণে এসব খাতে বিশৃঙ্খলা এড়াতে, অনলাইনে নিরাপত্তা দিতে আরও যা প্রয়োজন (নীতিমালা, গাইডলাইন ইত্যাদি) সেগুলো দ্রুত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে এআই প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে বলে মত দিয়েছেন তারা। দেশে কিছু প্রতিষ্ঠানের এআইভিত্তিক চ্যাটবট তৈরি, ব্যবহার এবং ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বল্প ব্যবহার কোনও সুখকর চিত্র দেয় না বলে তারা মনে করেন। এই খাতে এআই আরও স্বচ্ছতা দিতে পারে বলে উল্লেখ করেন তারা।

প্রসঙ্গত, সরকারের শিক্ষক বাতায়ন বলছে, ইলেক্ট্রনিক-গভর্নেন্সের সংক্ষিপ্ত রূপ ই-গভর্নেন্স। অনলাইন পরিসেবা, বিগ ডাটা, সামাজিক গণমাধ্যম, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি এর অংশ। ই-গভর্নেন্স অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে এবং সমাজের অক্ষম ও ঝুঁকিপূর্ণ বিভাগের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে উন্নীত করে। ই-গভর্নেন্স নতুন কর্মসংস্থান, ভালো স্বাস্থ্য, ভালো শিক্ষা, নলেজ শেয়ার, দক্ষতা উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য ক্ষমতা নির্মাণের সুবিধা দিতে পারে। দ্রুত ই-সেবার ফলে সময় এবং অর্থ উভয়ই কম লাগে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট জরিপে ১৫০তম স্থান থেকে ১১৫তম অবস্থান অর্জন করে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ (ইউএনডেসা) পরিচালিত ই-সরকার ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (ইজিডিআই) অনুযায়ী, ৩৫ ধাপ এগিয়ে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১১৫তম স্থান অর্জন করেছে। ২০১৬ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৪, ২০১৪ সালে ১৪৮ ও ২০১২ সালে অবস্থান ছিল ১৫০তম।

গত জুলাইয়ে (২০১৯) থাইল্যান্ডের পাতুমথানির এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) অনুষ্ঠিত এশিয়া প্যাসিফিক স্কুল অন ইন্টারনেট গভর্নেন্স-২০১৯ (এপিসিগ) সম্মেলনে জানানো হয়— যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নর্দান ইউরোপের দেশগুলোতে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ভিত্তিক ই-গভর্নেন্স চালু হয়েছে।

ওই সম্মেলনে এপিসিগের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান প্রফেসর কিনলাম চন বলেন, ‘আগামী দিন হবে এআই প্রযুক্তির। ফলে কোনও দেশের সামগ্রিক প্রযুক্তি খাতে সুশাসন আনতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করতেই হবে।’ তিনি এই প্রতিবেদককে বাংলাদেশ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল হওয়ার পথে হাঁটছে। একটা ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে ইতোমধ্যে। চমৎকার কাজ এটি। তবে এতে প্রাণ আনতে এইআই প্রযুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’ এইআই প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হলে বাংলাদেশ দ্রুত অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন এইআই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর কিনলাম চন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রেনিওর ল্যাবের প্রধান নির্বাহী আরিফ নিজামি বলেন, ‘দেশে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও বেসিক পর্যায়ে আছে। যা হচ্ছে তা খুব উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। তিনি জানান, ব্র্যাক কিছুদিন আগে মেশিন লার্নিং নিয়ে একটা উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশে ফেসরিকগনিশন নিয়ে স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু হয়েছে।’ তিনি মনে করেন, মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে এইআই। এরমধ্যে ট্রাফিক সিগন্যাল বড় একটি কাজের জায়গা হতে পারে। তিনি জানান, সরকার একটা ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। সবে একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) টেন্ডারের কাজ শেষ করেছে। এগুলো খুবই শুরুর কাজ বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় পরিসরের দিকে নজর দিতে হবে।’

বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে ইন্টারনেট বিষয়ক সুশাসনটা ঠিক মতো হচ্ছে না। আমরা প্রত্যন্ত এলাকায় কানেক্টিভিটি দিতে পারিনি। ফলে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটের বাইরে রয়ে গেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, শহরের মানুষ যে ডিজিটাল সুবিধা পায়, তা গ্রামের মানুষ খুব একটা পায় না। ফলে একটা বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। এই বৈষম্য কমাতে না পারলে ই-গভর্নেন্স পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তিনি জানান, দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট হয়েছে— কিন্তু এখনও ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট হয়নি। এটা খুবই জরুরি। এটা করা না হলে ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত ডাটা (তথ্য) নিয়ে এ দেশের মানুষকে ভুগতে হবে। তবে দেশে কিছু কিছু কাজ হচ্ছে উল্লেখ করে আবদুল হক বলেন, ‘ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা তৈরি হয়েছে। আরও যা বাকি রয়েছে তা দ্রুত করতে পারলে এদেশেরই মানুষই অনলাইনে নিরাপদ থেকে এর সুফল ভোগ করতে পারবে।