আজাদ মনসুরঃ
সংবাদপত্র আজ পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। কেননা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বসহ সব জাতীয়-আন্তর্জাতিক কর্মকা- ও সামাজিক-মানবিক অধিকার অর্জন ও সংরক্ষণে সংবাদপত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সংবাদপত্রের তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জনগণ তথা পাঠককে চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রীক ভূমিকা নির্ধারণে সংবাদপত্র পথিকৃত হিসেবে কাজ করে। তাই সংবাদপত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে আমেরিকার দু’বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেফারসন এক সাংবাদিককে লিখেছিলেন, তাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র-এ দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেবেন।
সংবাদপত্রের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীনে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। মুঘল আমলে মুসলিম শাসনেও ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হতো না। রাজনৈতিক সংবাদ হাতে লেখা হতো এবং তা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারীর কাছে পাঠানো হতো। যা হোক, সংবাদপত্র আদিকাল থেকে বর্তমান সভ্যতায় যেভাবে স্বগৌরবে চলছে সংবাদপত্র এখন শিল্পে রূপ নিয়েছে। যা সংবাদপত্রের বিল্পব বলে মনে করি আমি। কক্সবাজারসহ সারাদেশে এই শিল্পের সাথে জড়িত তথা গণমাধ্যমগুলোতে নিয়োজিত জনবলগুলোর পদবী ও সম্মানি নিয়ে অনেক কথা বলেন। অনেক পাঠক ও এমনকি সাংবাদিকরাও জানতে চেয়েছেন সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় নিয়োজিত জনবলদের পদবী ও বেতন/অন্যান্য সুবিধাদি কি? কক্সবাজারের সাংবাদিকতার আজ ষোল পর্ব।
পাঠক, এ বিষয়ে আলোচনার আগে কিছু তথ্যগত বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। তাই সংশিল্প কিছু বিষয় নিয়ে বলি। গবেষণার পাঠোদ্ধারে জানলাম, উপমহাদেশে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত সত্যিকারের পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’। এটা একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক। জেমস আগস্টাস হিকি নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। হিকির গেজেট প্রকাশের ৩৮ বছর পর, ১৮১৮ সালে বাংলা সংবাদপত্রের অভ্যুদয় ঘটে। ‘দিকদর্শন’ নামের আদি বাংলা সাময়িক পত্রটির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন একজন ইংরেজ। তার নাম জন ক্লার্ক মার্শম্যান। তিনি বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম সম্পাদক। বাংলাভাষার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালের ২৩ মে। সমাচার দর্পণ বাংলা সাংবাদিকতার গোড়াপত্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। সমাচার দর্পণ প্রকাশের পক্ষকালের ব্যবধানেই প্রথম বাঙালি সম্পাদিত পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গালা গেজেট’ প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এবং প্রকাশক হরচন্দ্র রায়। পত্রপত্রিকার ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়, এই উপমহাদেশের ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষাতেই সংবাদপত্রের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। উপমহাদেশীয় সাংবাদিকতায় বাঙালিরাই পথিকৃত।
আপনারা অনেকই জানবেন, মাঝে মাঝে বিচারাধীন মামলা নিয়েও গণমাধ্যমের অতি উৎসাহ দেখা যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তির খবর, ছবি গণমাধ্যমে এমনভাবে দিনের পর দিন প্রকাশ করতে থাকে যে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ ও ‘দোষী প্রমাণিত ব্যক্তির’ মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলার রায়ে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন। সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়া বিচার চলাকালীন যেভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মিডিয়ায় উপস্থাপন করে, তাতে ঐ ব্যক্তির যে সম্মানহানি হয়, তা ফিরিয়ে দেবে কে? এখানে আরও বলতে চাই। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ আছে, তা আদালত নিয়ে। আদালতও বিচার চলার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি সুবিচার করতে পারে না। বিচারকার্য চলার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে কেন? কাঠগড়া একটা নেতিবাচক জায়গা। অভিযোগ প্রমাণ ও শাস্তি হওয়ার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে সম্মানের সঙ্গে বসানো উচিত। কারণ এখনো আইনের চোখে তিনি নির্দোষ। আদালতের এই আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি সাংবাদিকদেরও প্রভাবিত করেছে। বরাবরের মতোই আমি মনে করি, আদালতের এই নিয়ম পর্যালোচনা করা উচিত।
সংবাদমাধ্যমকে যৌক্তিক গতিতে চলা, সরকার, জনগণ ও দেশের স্বার্থে বাস্তবিক রাখতে দেশে বহাল আছে সরকারি আইন। সে আইনের মারফতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হচ্ছে। আজকের দিনে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের যে ট্রেন্ড আমাদের সংস্কৃতিতে চালু হয়েছে তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই পেশাকে এখন নির্ভরতা, আধুনিকতা ও পেশাদারিত্বের কাতারে দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে। আমরা একদিন আগের খবর কাগজে এবং পাশাপাশি তাৎক্ষণিক সংবাদ পাচ্ছি অনলাইন ভার্সনে। যে কোনো সময় মোবাইলের মাধ্যমেও জেনে নেওয়া যাচ্ছে সর্বশেষ সংবাদটি। এখানেই একজন সাংবাদিকের আসল মূল্যায়ন। বিষয়গুলো আলোচনা করলাম এজন্য যে, আবার হয়তো মনে নাও আসতে পারে।
গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্টদের কদর আগে যেমন ছিল এখন আরও বেশি। অনেকে আমার কথা একমত না ও হতে পারেন। তবে তাও সত্য, কিন্তু সংগত কারণেই আমার কথায় একমত হওয়া বাঞ্চনীয়। কারণ এখন সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে গণমাধ্যমের চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে গণমাধ্যমগুলোর সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর। এ নিয়ে সরকার এখন অচিরেই নবম সংবাদপত্র মজুরি বোর্ড ঘোষণার কথা দিয়েছেন। মানে সংবাদপত্রের নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করা হবে মর্মে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তবে ওয়েজ বোর্ড নিয়ে অনেক কথা থেকেই যায়। কারণ পূর্বের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ওয়েজ বোর্ড কেন্দ্রিক বেতন/ভাতাদি কয়টি পত্রিকা বা ক’য়জন সাংবাদিক এর আওতায়? এ নিয়ে একাধিক বিষয়ে দাবি এবং আপত্তি উঠলেও এর কোন সমাধান নেই কিন্তু লাফিয়ে চলছে সংবাদপত্র মজুরি বোর্ড। এ নিয়ে কয়েকটি পর্ব হবে আগামীতে। সাথে থাকবার জন্য প্রিয় পাঠকদের ধন্যবাদ। চলবে…

লেখকঃ আজাদ মনসুর (এম.এ, এলএল.বি) শেষবর্ষ
আইটি স্পেশালিষ্ট, প্রণেতা-কক্সবাজার সাংবাদিক কোষ, সভাপতি-কক্সবাজার সাংবাদিক সংসদ (সিএসএস)
azadcox90@gmail.com ০১৮৪৫-৬৯ ৫৯ ১৬