বাংলা ট্রিবিউনঃ

মানবপাচার দমনে বাংলাদেশকে টানা তৃতীয়বারের মতো টায়ার টু ‘নজরদারির’ তালিকায় রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। জুন মাসে প্রকাশিত ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন ২০১৯’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করা হয়। এর আগে ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ টায়ার-টু তে। ২০১৭ সালে এক ধাপ নামিয়ে বাংলাদেশকে টায়ার টু’র ‘নজরদারিতে থাকা দেশের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই অবস্থার পরিবর্তন আজও হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, মানবপাচার অপরাধ দমনে ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা না করা এবং মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ের অভাব এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

আজ মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বিশ্ব মানবপাচার প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে দেওয়া স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার মানবপাচার প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসছে না। বড় ধরনের অভিযোগ থাকলেও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া অভিবাসন খরচ কমাতে না পারার অভিযোগও আনা হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিবাসন খাতে অবৈধ মধ্যসত্ত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাচারের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। ‘ট্রাফিকিং ভিক্টিম প্রোটেকশন অ্যাক্টের’ কারণে বাংলাদেশকে টায়ার-৩ এ নামিয়ে দেওয়া হয়নি। এজন্য টানা তৃতীয়বারের মতো টায়ার-২ নজরদারি তালিকায় রাখা হলো।

বাংলাদেশের সঙ্গে এই তালিকায় আরও রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানসহ ৩৮টি দেশ। এগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, কঙ্গো, গ্যাবন, হাঙ্গেরি, ইরাক, মালয়েশিয়া,  রোমানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভিয়েতনাম উল্লেখযোগ্য।

মানবপাচারের সঙ্গে সমুদ্রপথে অনিয়মিত অভিবাসন, মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, বিচারহীনতা, মানবপাচার অপরাধ দমনে স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল গঠনের ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রিতাকে দায়ী করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও শঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সরকারের গৃহীত প্ল্যান অব অ্যাকশন বাস্তবায়িত না হলে আরেক ধাপ নেমে টায়ার থ্রিতে চলে যাবে বাংলাদেশ।

মানবপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন করেছে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে এই আইনে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৬৮টি মামলা হয়েছে। কিন্তু মাত্র ২৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে  ৪ হাজার ১০৬টি।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেই কিন্তু বলা আছে আমরা ট্রাইবুন্যাল স্থাপন করতে পারিনি। এরকম নির্দিষ্ট কারণ বলা আছে এবং পরামর্শ দেওয়া আছে। তবে রোহিঙ্গাদের মুক্ত চলাচলের বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে দ্বিমত পোষণ করি। রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করলে মানবপাচার আরও বাড়বে। আমাদের আসলে এখনও অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। আমি মনে করি, আমাদের সেটা করা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘রিপোর্টে কিন্তু অভিবাসন খরচ, মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য নিয়েও বলা হয়েছে। রিক্রুটমেন্টের নামে যে প্রতারণাগুলো হয় এগুলো সবই ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। কাজেই আমার কাছে মনে হয়, আমাদের যে ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন আছে, আমরা যদি তা বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়ে যাবে।’

মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাব আছে উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বলেন, যখনই পাচারের বিষয় আসছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় মনে করে এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার অনেক সময় মনে করে এরা যেহেতু স্মার্ট কার্ড নিয়ে যায় তাই এটা প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের কাজ। আমাদের এই জায়গায় সমন্বয়ের অভাব আছে। আমরা যদি সমন্বিত হয়ে কাজ করতে পারি, এনপিএ বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।

মানবপাচার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উইনরক ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির প্রোগ্রাম অফিসার আকিব বিন আনোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলে, আমাদের যে কাঠামোটি তৈরি করার কথা ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে যে সমন্বয়ের কথা ছিল সেটা করা হয়নি। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে – আমাদের একটি আন্তঃ মন্ত্রণালয় বডি হওয়ার কথা ছিল। এই জায়গায় এখনও কাজ করার সুযোগ আছে। ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন করা হয়েছিল তাতে বলা হয়েছে শুধু মানবপাচারের বিচারকাজ করার জন্য একটি স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল করার কথা। এটাও আমরা এখন পর্যন্ত করতে পারিনি। প্রত্যেকটি জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কাউন্টার ট্রাফিকিং কমিটি (সিটিসি) হওয়ার কথা, সেটা ধীরে ধীরে হচ্ছে। কিন্তু এই সিটিসি’র কাজের ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় সীমাবদ্ধতা আছে। আবার যে পরিমাণ মামলা আছে সে তুলনায় নিষ্পত্তির হার খুবই কম।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, মানবপাচার রোধে যেসব দেশ ভূমিকা রাখতে পারে না, পরোক্ষভাবে মানবপাচারকে যারা উৎসাহিত করে, তাদেরকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই স্তরে রাখে। বাংলাদেশ সরকার অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এটাকে একটি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়ার কথা, অথচ তারা সিরিয়াসলি বিষয়টি নেয়নি। যার কারণে আমরা ভুমধ্যসাগরে দেখছি যত নৌকাডুবির ঘটনা আছে সেখানে অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি। বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে রোহিঙ্গা থেকে শুরু করে বাংলাদেশিরাও মালয়েশিয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের অভিবাসন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বিষয়ে পদক্ষেপ না নেওয়ায় বোঝা যায় তারা এটিকে উৎসাহিত করছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের একটি শক্তিশালী মানবপাচার প্রতিরোধ আইন আছে। কিন্তু সেই আইনের কোনও প্রয়োগ নাই। তার প্রশ্ন, এখন পর্যন্ত কোনও মানবপাচারকারীকে আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা কি হয়েছে?

তিনি বলেন, নারী এবং শিশু নির্যাতন দমনে বিচারকাজ করার জন্য আলাদা ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয়েছে। মানবপাচার আইনেও কিন্তু একটি ট্রাইবুন্যাল করার কথা আছে। সেই ট্রাইবুন্যাল আজও হয়নি। আমরা কিন্তু দৃশ্যমান কোনও কাজ কিন্তু দেখাতে পারছি না।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, মানবপাচারজনিত সমস্যা কমিয়ে আনাতে আইওএম’র সহযোগিতায় আমাদের আঞ্চলিক কর্মশালা করার পরিকল্পনা আছে। যেসব দেশে আমাদের ভিক্টিমের সংখ্যা বেশি সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা আলাপ আলোচনা করে দেখবো কীভাবে আমরা এগুলোকে আরও কমাতে পারি।

তিনি আরও বলেন, মানবপাচার আইনে ট্রাইবুন্যালের কথা বলা আছে। যতদিন এই ট্রাইব্যুনাল গঠন না হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বিচার কাজ চলবে। দেশের কোনও জেলায় পাচারসংক্রান্ত মামলা বেশি হয়, কোথাও কম। আমাদের আদালতে মামলার যে জট আর বিচারকের যে সংখ্যা সেদিকটাও সবার বিবেচনা করা দরকার। তারপরও আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। তবে ট্রাইবুন্যাল না হওয়া তেমন কোনও সমস্যা না। সমস্যা হলো মানবপাচারের অপরাধে মামলা দায়ের করার পর সাক্ষী আদালতে আসেন না। অভিযুক্তের সঙ্গে আপস করে টাকা নিয়ে নেন। টাকা পেয়ে গেলে আর মামলা এগোতে চায় না। এজন্য মামলাগুলো নিষ্পত্তিও হয় না।

মানবপাচার বন্ধে সরকারের চেষ্টা আছে উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, চেষ্টা থাকলেও সেখানে সমন্বয়ের অভাব আছে। সমন্বয়ের যে অভাব আছে, দীর্ঘ সরকারি চাকরিতে আমার এটা মনে হয়েছে।

এসব পরিবর্তনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করবে, সোমবার (২৯ জুলাই) ব্র্যাক আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে এমন আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।