আব্দুল কুদ্দুস রানা:
শরীরে প্রচন্ড জ্বর, হাড়ে ও গাঁটে গাঁটে ব্যথা, শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্ত পড়া, দুর্বল বোধ করা, খেতে না পারা, বমি হওয়া এবং লিভার ব্যথা করার লক্ষণই ডেঙ্গু । ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশা থেকে। বৃষ্টির পানি কোনো স্থানে টানা চার-পাঁচদিন জমে থাকলে এডিস মশা জন্ম নিতে পারে। তাহলে একটু ভাবুন-আমরা, আমাদের সন্তানেরা কতটুকু নিরাপদে আছি ?

টানা আধাঘন্টা বৃষ্টি হলেই পুরো শহরটা ডুবে যায়। দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। নালা-নর্দমা ড্রেন ময়লা আবর্জনায় ভরপুর। প্রধানসড়ক, হোটেল মোটেল জোনের সৈকত সড়ক, শহরের বিভিন্ন অলিগলির অবস্থা আরও ভয়াবহ। দৈনিক ৬০-৭০ জন কর্মী দিয়েও শহরটা পরিচ্ছন্ন রাখতে পারছে না পৌরকর্তৃপক্ষ। নালা-ড্রেন ও জলাশয় থেকে জন্ম নিচ্ছে লাখ লাখ মশা। উপকূলের যেসব এলাকায় লবণ জমি আছে-সেখানে মশার জন্ম হয় বেশি। দিনে অন্তত একবার মশার কামড় খাননি-এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন।

শুধুই কি নালা–নর্দশা-জলাশয় ? আপনার আমার ঘরবাড়ির চারপাশে পড়ে থাকা ক্যান, টিনের কৌটা, মাটির পাত্র, নারকেলের মালা, রাস্তার গর্ত, গোসলখানার বালতি, ড্রাম, ফুলের টব, ফ্রিজ-এসির নিচে কয়েক দিনের জমানো পানিতে ডেঙ্গুর জীবাণু বেশি জন্মায়। তবে মশা রাতে কামড়ায় না। কামড়ায় দিনের বেলায়। পুরুষ মশা কামড়াতে জানে না। নারী মশারাই শুধু কামড়াতে চায়। বিশেষ করে শিশুদের পেলে কথা নাই।

ঘরেঘরে এখন বড় আতঙ্ক ‘ডেঙ্গু জ্বর’। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে

ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বর্ষার এই ভরা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে।

বিশেষ করে রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সারাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। কারণ, সেখানে বাইরের জেলার ছেলেপেলেরা পড়াশোনা করে। চাকরি-বাকরিও করছে অনেকে।

গত ৪ মাসে রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৩ জন। এর মধ্যে জুলাই মাসেই ৫ হাজার ৬৩৭ জন। কক্সবাজারে প্রতিমাসে গড়ে ২০০ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে নারী-শিশু অনেক।

গত ২১ জুলাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মারা গেলেন ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি হবিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ছিলেন। ডেঙ্গু থেকে চিকিৎসক যখন রক্ষা পাচ্ছেন না, তাহলে অন্যপেশার লোকজনের কী অবস্থা, সহজে আন্দাজ করা যায়।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারতে যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে-তা নাকি অকাযকর। এ ওষুধে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশা মরে না। একই কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা।

তাহলে কক্সবাজারসহ অন্যান্য জেলার অবস্থা কি ? সেখানে মশা মারার জন্য বছরে এক দুইবার যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে-তার কার্যকারীতা আছে তো ? কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বললেন, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।

আজ বৃহস্পতিবার থেকেই সারাদেশে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী ( ২৫ থেকে ৩১ জুলাই) ‘মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান’। এবারের শ্লোগান-‘পরিবেশ রাখি পরিস্কার, বন্ধ করি মশার বিস্তার’।

আশা করছি, সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজারের সকল ড্রেন, নালা, খাল, জলাশয়, মজাপুকুর পরিস্কার হবে। পরিচ্ছন্ন থাকবে শহর, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসমূহ।

যে জিনিসটা এখন সবচেয়ে বেশি দরকার-সেটি হচ্ছে ‘জনসচেতনতা’। এখন এডিস মশা মেরেই আমাদের ডেঙ্গু তাড়ানোর কাজে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। কারণ ডেঙ্গু ভাইরাসের স্বীকৃত কোনো ভ্যাকসিন কিংবা চিকিৎসা নেই। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ করা এবং মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা।

এক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্যও অনেক। বসতবাড়ি ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্টানের ফুলের টব, ফুলদানী, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, কমোড, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার টিউবে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিস্কার রাখতে পারি।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী ডেঙ্গুর ভয়াবহতা তুলে ধরলেন। তাঁর ভাষ্য-সারা বছরজুড়েই ডেঙ্গু হয়। তবে বর্ষাকালে ডেঙ্গু হয় বেশি। এই হাসপাতালেও প্রতিদিন চার-পাঁচজন করে ডেঙ্গু রোগী আসছেন। চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে তাঁদের । এ পর্যন্ত কারো মৃত্যু হয়নি। এটা কক্সবাজারবাসীর জন্য সুখবর।

চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ্বর দুটোই এডিস মশার কারণে হয়। এই দুটি রোগের লক্ষণে যেমন মিল রয়েছে, তেমনি আবার ভিন্নতাও আছে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। আবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে।

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ্বরে সাধারণত ঠান্ডা-কাশি হয় না; নাক দিয়ে পানি ঝরে না। তবে ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে কাঁপুনি, ঘাম ও তীব্র অবস্থায় রক্তক্ষরণ হয়। চিকুনগুনিয়া জ্বরে সাধারণত এগুলো হয় না। একই মশা দিয়ে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর হলেও ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। চিকুনগুনিয়া হলে কারও মৃত্যু হয় না। যেহেতু এটি মশাবাহিত রোগ, তাই মশার বংশ ধ্বংস এবং বংশবৃদ্ধি রোধ করতে হবে।

মশা দিনের বেলায় কামড়ায়। দিনের বেলায় যারা ঘুমান-তাঁরা মশারি ব্যবহার করতে পারেন। বাচ্চাদের হাফ জামা ও প্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট-জামা পরাতে পারেন। আক্রান্ত রোগীকে পৃথক বিছানায় মশারির ভেতর রাখতে পারেন। ঘরের দরজা, জানালা ও ভেন্টিলেটরে মশানিরোধক জাল ব্যবহার করুণ।

মশা এক প্রকারের ছোট মাছি প্রজাতির প্রতঙ্গ। অধিকাংশ প্রজাতির নারী মশা স্তণ্যপায়ী প্রাণীর রক্ত পান করে থাকে। কিন্তু কিছু মশা রোগজীবাণু সংক্রামক। মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। নারী মশা রক্ত শোষে এবং মারাত্মক সংক্রামক রোগ বিস্তার করে। নারী মশা বদ্ধ পানি বা জলাশয়ে ডিম পাড়ে; বাকিরা জলজ উদ্ভিদ, হৃদ, ডোবা, জলাভূমিতে ডিম ছাড়ে। আবার কিছু লবণাক্ত জলাভূমিতে ডিম ছাড়ে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গু হলে আতঙ্কিত না হয়ে যথেষ্ট বিশ্রাম নিন। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল খান। প্রচুর পরিমাণ পানি, ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন, ফলের রস ইত্যাদি গ্রহণ করুন। তবে নিজে নিজে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক খাওয়া একেবারেই নিষেধ।

লেখক : দেশের শীর্ষ দৈনিক ‘ প্রথম আলো’র স্টাফরিপোর্টার ও প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক-কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়ন।