হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

কোমলমতি নিষ্পাপ শিশু তুবা। বয়স সবেমাত্র চার বছর পূর্ণ হলো। মাকে ছেড়ে বাবা অন্যত্র সংসার পেতেছেন। তাই বাবার অকৃত্রিম আদর- স্নেহের পরশ থেকে বঞ্চিত কোমলমতি এই মেয়েটি। তারপরও মমতাময়ী মায়ের স্নেহের বাঁধনে বেড়ে উঠছিল তুবা। মা তসলিমা বেগম রেনুরও স্বপ্ন ছিল দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে হলেও মেয়েটাকে শিক্ষা- দীক্ষায় বড় করবেন। তাই-তো মেয়েটির বয়স চার পূর্ণ হওয়ার পরপরই ভর্তি বিষয়ে জানতে মা ছুটে গিয়েছিলেন রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মেয়েটাকে রেখে গিয়েছিলেন ঘরে স্বজনদের কাছে। আর আদরের কন্যা তুবাকে বলেছিলেন আমি তোমাকে স্কুলে পাঠানোর জন্য ড্রেস আনতে যাচ্ছি। তুবা অপেক্ষায় ছিলো মা ড্রেস নিয়ে আসবেন আর সে তা পরিধান করে উচ্ছসিত হবে। হাস্যোজ্জল চেহারায় নতুন ড্রেস পরে সহপাঠী ও খেলার সাথীদের সাথে মিলিত হবে। কিন্তু পৃথিবীতে নিষ্পাপ শিশুটির সবচেয়ে বড় আশ্রয় মমতাময়ী মা বাড়ি ফিরে এসেছেন; তবে লাশ হয়ে। মা এসেছেন সত্যিই, তবে স্কুল ড্রেস নিয়ে নয়; কাফনের কাপড় পরিধান করে। মায়ের আগমনে যে ছোট্টমণির আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা সেই মায়ের নিথর,নিস্তব্ধ লাশ দেখে শিশু তুবার অঝোরধারা কান্নায় আকাশ-বাতাসও ভারি হয়ে উঠে। গগনবিদারী এ কান্না মানবিক চেতনাসম্পন্ন সকল মানুষকেই কাঁদিয়েছে। প্রথমদিকে মায়ের আগমন প্রতীক্ষায় তুবার আশান্বিত চাহনি, অবশেষে মায়ের মৃত দেহ দেখে তার কান্নার ভিডিওটি একনজর দেখে আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমিও চার বছর বয়সী একজন মেয়ের বাবা হিসেবে তুবার কান্নায় অশ্রুসিক্ত হয়েছি, মর্মাহত হয়েছি। কি দোষ ছিল তুবার মায়ের? তিনি তো গিয়েছিলেন স্কুলে মেয়ের ভর্তি বিষয়ে জানতে। কিন্তু মানুষের ছদ্মেবেশী কিছু অমানুষ ছেলেধরা সন্দেহ ও গুজব ছড়িয়ে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে দিবালোকে গণপিটুনি দিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনি বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবী করে বাঁচার আকুতি জানালেও, এমনকি চার বছর বয়সী একটি মেয়ে শিশু ঘরে রেখে আসার কথা জানালেও পাষাণদের হৃদয় গলেনি। আজ কাঁদছে তুবা,কাঁদছে মানবতা।
এরকম একটি নয়; একের পর এক ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যাকান্ড ঘটছে। সিদ্ধিরগঞ্জের বাক প্রতিবন্ধী সিরাজ তার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে সাদিয়াকে দেখতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়ে ফিরলেন লাশ হয়ে। “গত দুই সপ্তাহে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে অন্তত ২২ টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৮ জন,আহত হয়েছেন আরও ৫০ জন।” ( দৈনিক ইনকিলাব-২৩ জুলাই’২০১৯ইং)।
কেবলমাত্র “ছেলেধরা” সন্দেহপ্রবণ হয়েই আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে এভাবে দিবালোকে মেরে ফেলার মত বর্বরতা কোন সভ্য ও মানবিক সমাজ মেনে নিতে পারেননা। সাম্প্রতিক সময়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় অতিবাহিত হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। মা হারা কোমল শিশু সন্তান, সন্তান হারা মমতাময়ী মা, স্বামী হারা বিধবা স্ত্রীর বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছ। একটি নির্মম হত্যাকান্ডের শোকের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটছে আরেকটি নৃশংসতম, বর্বর হত্যাযজ্ঞ। এভাবে শিশু, কিশোর, আবাল, বৃদ্ধ -বণিতা শিকার হচ্ছে নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের। খবরের কাগজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নজর দিতেই চোখে পড়ে কোন না জায়গায় মানবপাচারকারী, দুষ্কৃতিকারী কিছু পাপিষ্ঠ, বখাটে মানুষের হাতে সংঘটিত খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণসহ লোমহর্ষক ঘটনার বেদনাদায়ক খবর। এ অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন, জনসচেতনতা তৈরী করা, প্রকৃত অপরাধীদের খোঁজে বের করে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সময়ের প্রধান দাবী। তবে এক্ষেত্রে বিচার নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে কাউকে নিহত ও আহত করার আইনসঙ্গত কোন অধিকার জনগণের নেই।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো তৎপরতার অভাবে এমন মর্মান্তিক ও জঘন্য ঘটনা ঘটতে পারে।” দৈনিক ইনকিলাব-২৩ জুলাই’২০১৯ইং)।
এভাবে নিরপরাধ মানুষকে শুধু নয়; অপরাধীকেও আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিবেকবোধ সব দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুতর অপরাধ, নিষ্ঠুরতম অমানবিক আচরণ। তাই শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার পবিত্র বন্ধন এবং নির্মল পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে ইসলাম বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে (বিচারবহির্ভূত) হত্যা করা ও জমিনে ফিৎনা- ফাসাদ ( ত্রাস সৃষ্টি করা, অনৈতিক ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন, গুজব, সন্দেহপ্রবণতা, অপবাদ ও মিথ্যাচার ছড়িয়ে দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরী ) করা পুরো মানবতাকে হত্যার শামিল বলে ঘোষণা করেছে ইসলাম। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদে ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলো বা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করলো সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করলো। আর যে একজন মানুষকে বাচিয়ে দিলো সে যেন সকল মানুষকেই বাচিয়ে দিলো।” ( সূরা -মায়িদাহ, আয়াত- ৩২)
সন্দেহপ্রবণতা ও গুজব যেহেতু শান্তি, শৃঙ্খলা, মানবতা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেয় তাই ইসলাম এ থেকেও বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি ( অনির্ভরযোগ্য সূত্র) তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তা পরীক্ষা করে দেখবে; যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।” ( সূরা হুজুরাত- আয়াত- ০৬)
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ হলো যে কোন সংবাদ পাওয়া মাত্রই বিশ্বাস না করা; বরং সত্য-মিথ্যা যাচাই করা। অন্যথায় নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি সাধন হবে। তথাপি সন্দেহপ্রবণতা ও খারাপ ধারণা থেকে বিরত থাকতেও নির্দেশ করেছে ইসলাম। মহান আল্লাহ বলেন, “মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ।” ( সূরা – হুজুরাত, আয়াত-১২)।