অভিষেক দত্ত

পাঠ্য বইয়ের ভূগোলে পড়েছি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন। তাই চীনকে সবাই গণচীন বলে। জীবনে কখনো কল্পনাও করিনি চীনে পড়তে আসবো। স্বপ্ন ছিল এইচ এস সি পাস করার পর চুয়েট কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদের ভর্তি হবো। আজ দীর্ঘ আট মাস হতে চলল এখন আমি চীনের হেবেই কলেজ অব ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড টেকনোলজিতে অধ্যয়নরত। যেটি চীনের হেবেই শহরে অবস্থিত।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে বিদেশে লেখাপড়ার করা আমার জন্য যেন হাতে চাঁদ পাবার মতো। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও বাবা আমাদের লেখাপড়ার জন্য দৈন্যতা করেননি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ। তবে আমার পথটা ছিল কণ্টকাকীর্ণ। আমার ছোট ভাই দীপ দত্ত তখন ক্লাস সেভেন পড়ছে। দীর্ঘ এক বছর যাবত দীবের হাঁটু ব্যথার জন্য কখনো এই ডাক্তার কখন সেই ডাক্তার করতে করতে পরবর্তীতে ধরা পরলো হাটুতে Bone Cancer । তখন আমি বাংলাদেশ নৌ বাহিনী স্কুল এন্ড কলেজের ২০১৭ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। চিকিৎসার জন্য দীপকে নিয়ে আমার মা ও বাবা দুজনেই আমার পরীক্ষার দুই সপ্তাহ আগেই ভারতের চেন্নাইয়ে চলে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হাটুতে ক্যান্সারের মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে আমার ছোট ভাইয়ের একটি পা অপারেশন করে হারাতে হলো এবং তার সাথে আমার মা-বাবাকে দীর্ঘ প্রায় এক বছর ভারতে অবস্থান করতে হয়েছিল। ঘরে মা বাবা অনুপস্থিত এবং ছোট ভাইয়ের অসুস্থতায় আমি পরীক্ষায় ভালো ভাবে মনোনিবেশ করতে পারিনি। যার ফলশ্রুতিতে আমি পরীক্ষায় ৪.০০ পয়েন্ট পাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা অনুষদে এসেছিলাম কিন্তু ভর্তি হয়নি। আমার কাকা, জেঠা, মামা, মাসি সহ সকল আত্মীয় স্বজন সবাই আমার ছোট ভাই দীপের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। তবে আমি পড়াশোনায় হাল ছাড়িনি। অবশেষে ভর্তি হলাম কাপ্তাই বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখানে চতুর্থ সেমিস্টারে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমি চীনের শিক্ষা বৃত্তি লাভ করি।

ঢাকা শহর, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বাংলাদেশ বিমান সব কিছুই আমার জন্য প্রথম অভিজ্ঞতা। ঢাকায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আমাদের চীনের শিক্ষা বৃত্তির সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে আমাদেরকে বিদায় সংবর্ধনা দেন।২০১৮ সালের ২১ শে অক্টোবর ঢাকা শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চীনের সিজিয়াজুয়াং এর উদ্দেশ্যে আমরা ২০ জন ছাত্র রওনা হয়। তারপর দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা পর ভোর পাঁচটায় গোয়াংজো বিমানবন্দরে ১২ ঘন্টা যাত্রা বিরতি। তারপর রাত ৯টায় সিজিয়াজুয়াং বিমানবন্দরে পৌঁছি। বিমানবন্দরে কলেজের চাইনিজ শিক্ষার্থী, ভলেন্টিয়ার ও শিক্ষকরা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানায় যা আমাদের জন্য খুবই মজার ও স্মরণীয় মুহূর্ত।

কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে অনেক নিয়ম ঘেরা এই দেশ। চীনের মানুষ গুলো খুবই বন্ধুসুলভ এবং তাদের খাদ্য তালিকা বৈচিত্র্যময়। চীনে রাস্তাঘাট বিপদে পড়লে চীনা মানুষ সহায়তা করে। কলেজটা এত বিশাল এবং ছাত্রাবাস এতো বড় ছিল যে প্রথম প্রথম সপ্তাহ খানেক আমার রুম খুঁজে পেতে কষ্ট হতো। তারপর ভাষা নিয়ে খুবই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। কিন্তু গুগল ট্রান্সলেট অ্যাপ এর মাধ্যমে সমস্যাটা কেটে গেল। আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে রান্নার সমস্যা হয় না এখানে রয়েছে ইলেকট্রিক চুলা, ওভেন রেফ্রিজারেটর সহ নানা রকমের সুবিধা। বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, মিশর, কাজাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ও আরো অর্ধশতাধিক দেশের শিক্ষার্থী আমাদের কলেজে অধ্যয়ন করে। গত ২৫ শে মে চীনের শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত উহানের সেন্ট্রাল চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটিতে হয়ে গেল আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসব। দুদিনব্যাপী এ উৎসবে প্রায় ৭০ টি দেশের শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে আমরা (বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা) তাঁদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারি, যা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। এখানে বছরের ৮ মাস থাকে ঠান্ডা এবং বাকি ২-৪ মাস হয় গ্রীষ্মকাল, বৃষ্টি হয় মাঝে মধ্যে তাও কম। কলেজের ছাত্রাবাস প্রতি রুমে চারজন করে থাকি। এখানে খাওয়া ও গোসলের পানি কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। তাই পানি ব্যবহারে সর্তকতা অবলম্বন করতে হয়। আমি এখানে আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি জায়গাগুলো খুবই সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর এবং চীনের মানুষরা বন্ধুপ্রিয়। চীনের ছেলেদের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা খুব ভোরে উঠে শরীরচর্চা, ফুটবল, ভলিবল, দৌড়াদৌড়ি, কারাত ও ব্যায়াম করে থাকে। ছয় মাস পর দেশে যাওয়ার ছুটি ছিল কিন্তু আর্থিক কারণে যেতে পারিনি। তবে আমার পরিবার ও দেশের জন্য আমার মন সবসময় কাঁদে। আমি যে উদ্দেশ্যে এখানে শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে এসেছি সে কাজ যেন সফলভাবে সম্পন্ন করে আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারি সৃষ্টিকর্তার নিকট এই প্রার্থনা।