ডেস্ক নিউজ:
প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যাপক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলো এই বর্জ্য নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। নিজেদের ফেলে দেয়া বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য ছাড়াও উন্নত বিশ্বের প্লাস্টিক বর্জ্যের চাপও তাদের নিতে হচ্ছে। এখানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যেতে পারে।

মার্কিনীদের ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য জাহাজে করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র দেশগুলোতে পাঠানো হয়ে থাকে। সম্প্রতি ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

বিশ্বের ১১ টি দেশে গার্ডিয়ানের সাংবাদিকদের করা অনুসন্ধান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই নোংরা বাণিজ্যের বিভিন্ন গোপন খবর বেরিয়ে এসেছে।

গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতি বছর জাহাজে করে হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠানো হয়। এ দেশগুলোতে শ্রমের মূল্য অসম্ভব রকমের সস্তা হওয়ায় রিসাইক্লিং করার জন্য মার্কিনী প্লাস্টিকের গন্তব্যস্থল এই দেশগুলোতেই হয়ে থাকে। যার পরিণতিতে এসব দেশের জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

প্রথম দিকে প্লাস্টিক এক আশ্চর্য বস্তু হিসেবেই মানুষের কাছে এসেছিল। এটি দিয়ে সাধারণের ব্যবহার্য বস্তু টুথব্রাশ থেকে শুরু করে মহাকাশে ব্যবহৃত হেলমেটও তৈরি করা হয়ে থাকে। অথচ কালের পরিক্রমায় এই প্লাস্টিকই এখন মানুষ এবং পরিবেশের চরম সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু প্লাস্টিক পচনশীল বস্তু নয় তাই এটি পরিবেশের বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। বর্তমানে যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের বর্জ্য দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি সাগর মহাসাগরও প্লাস্টিকের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এই প্লাস্টিকের ভয়াবহতা এতই তীব্র যে সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, প্রতি সপ্তাহে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ কমপক্ষে এক ক্রেডিট কার্ডের সমপরিমাণ প্লাস্টিক গ্রহণ করে থাকে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করে গত মাসে ১৮৭ টি দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী, দূষিত প্লাস্টিক অথবা সহজেই রিসাইকেল করা যায় না অর্থাৎ পুনরায় ব্যবহার করা কঠিন এমন প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হয় দেশগুলোকে। অথচ কয়েকটি দেশ এই চুক্তি সই করেনি। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একটি।

গত বছর ৬৮ হাজার শিপিং কনটেইনারের সমপরিমাণ আমেরিকান প্লাস্টিক বর্জ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। এই দেশগুলো নিজেদের প্লাস্টিক বর্জ্য সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে।  তার ওপর বোঝা হিসেবে মার্কিনীদের প্লাস্টিক বর্জ্যও তাদের ঘাড়ের উপর চাপানো হচ্ছে।

যেসব দেশে আমেরিকার প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করা হয় :

প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যের গন্তব্য ছিল চীন। দেশটিতে মার্কিনী প্লাস্টিক বর্জ্য নিষিদ্ধ করা হলে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর নজর পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে এখন এসব বর্জ্যের নতুন ঠিকানা হিসেবে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকেই বেছে নিয়েছে মার্কিনীরা। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, লাওস, ইথিওপিয়া এবং সেনেগাল রয়েছে। উল্লেখিত দেশগুলোর সস্তা শ্রম এবং পরিবেশের সুরক্ষায় কঠোর নিয়ম কানুন না থাকায় সহজেই প্লাস্টিক বর্জ্য এসব দেশে পাঠানো হয়ে থাকে।

 

এছাড়া তুরস্কের মত কিছু দেশে বিপুল পরিমাণ বিদেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পাঠানো হয় অথচ এই দেশগুলো তাদের নিজেদের উৎপাদিত প্লাস্টিকের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতেই নাকানি চুবানি খাওয়ার মত অবস্থা হচ্ছে।  যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্যে এসব দেশ ইতিমধ্যেই ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে।

ব্যাপকভাবে ভোক্তাদের  ব্যবহারের জন্য ১৯৫০-এর দিকে প্লাস্টিকের প্রচলন শুরু হয়। অথচ বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এটি এতোটাই ব্যবহৃত হয় যে ধারণা করা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাসাগর প্রশান্ত মহাসাগরের প্লাংকটন (জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষুদ্র অথবা আণুবীক্ষণিক জীব) এর চেয়ে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্যের সংখ্যাই বেশি।

প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ৩৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে। এই পরিমাণ বর্জ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টন অ্যাস্ট্রোড্রাম স্টেডিয়ামটি ১ হাজার বার ভরে ফেলা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্লাস্টিক বর্জ্যের অর্ধেকের বেশি চীন এবং হংকং এ রিসাইকেল করা হতো। এসব বর্জ্য রিসাইকেল তথা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চীন এবং হংকং এ বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছিল। চীনারা মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল করে তা দিয়ে প্লাস্টিকের নতুন পণ্য তৈরি করতো। এসব পণ্য পশ্চিমা দেশে রপ্তানি করা হতো।  কিন্তু মার্কিনীদের ফেলা দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য বেশিরভাগ সময়ই দূষিত ছিল কিংবা তা রিসাইকেল করার মত ছিল না।  ফলে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে চীনের বেশিরভাগ অঞ্চলই আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য নিয়ে চীনাদের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে ২০১৭ সালে চীন সরকার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য ছাড়া  বেশিরভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যই দেশটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য চীনের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এসব বর্জ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এক দেশ থেকে অন্য দেশে পিংপং বলের মত ঘুরতে থাকে। শিপিং রেকর্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর রপ্তানি ডাটা বিশ্লেষণ করে গার্ডিয়ান জানতে পেরেছে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রতি বছর ১ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জাহাজে করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে থাকে।

এসব দেশের বেশিরভাগই খুব গরীব দেশ হিসেবে পরিচিত। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেনা জামবকের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্যের বৃহত্তম গ্রহীতা মালয়েশিয়া তাদের নিজেদের প্লাস্টিক বর্জ্যের শতকরা ৫৫ ভাগ ঠিকমত ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। এর অর্থ হলো এসব বর্জ্য ঠিকমত রিসাইকেল না করে গর্ত করে ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, চীনে মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্য নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বর্জ্য পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।  ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামও তাদের নিজেদের প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারছে না। এক্ষেত্রে দেশ দুটি যথাক্রমে শতকরা ৮১ এবং ৮৬ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যের ভুল ব্যবস্থাপনা করছে।

দ্য লাস্ট বিচ ক্লিনআপ নামক সংস্থার পরিচালক প্রকৌশলী জেন ডেল জানান, প্লাস্টিক বর্জ্যের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই সংস্থাটি পরিবেশবাদী গ্রুপ এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মিলে প্লাস্টিক দূষণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ডেল উল্লেখ করেন, প্লাস্টিক বর্জ্যবাহী জাহাজ একের পর এক নতুন ঠিকানা খুঁজে বের করছে যাতে সহজেই তাদের বর্জ্য খালাস করতে পারে।

এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের মিনহ খাই গ্রামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজধানী হ্যানয়ের কাছে নদীর বদ্বীপে অবস্থিত এই গ্রাম। এটি ভিয়েতনামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কুটির শিল্পের মূল কেন্দ্র। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য এসে এখানে জমা হয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ৮৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করার জন্য ভিয়েতনামে পাঠিয়েছে।

মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে বিপর্যস্ত এমন একজন ভিয়েতনামের নগুয়েন থি হং থাম। ৬০ বছর বয়সি ৭ সন্তানের জননী এই নারী রাজধানী হ্যানয়ের উপকন্ঠে এমন একটি স্থানে থাকেন যেটি নোংরা, অপরিচ্ছন্ন আমেরিকান প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিপূর্ণ। তার বাড়ির বাইরে মার্কিনী ব্র্যান্ড চিটোস চিপসের প্যাকেট, ওয়ালমার্টের প্লাস্টিক বর্জ্য, নিউজার্সির সুপার মার্কেট চেইন শপ রাইটের প্লাস্টিকের ব্যাগ পড়ে রয়েছে।

রিসাইকেল করার সুবিধার্থে প্লাস্টিক এসব বর্জ্যকে শ্রেণীভেদে সাজানোর জন্য নগুয়েন থি হংকে প্রতিদিন ৬.৫০ ডলার দেয়া হয়ে থাকে।

নগুয়েন থি হং থাম বলেন, ‘আমরা এসব প্লাস্টিকের ধোঁয়া নিয়ে সত্যিই খুব ভীত। এখানকার ভূগর্ভস্থ পানি পান করার সাহস আমাদের নেই। আমাদের পর্যাপ্ত অর্থ নেই সেজন্য এখানে কাজ করা ছাড়া আমাদের আর কোন গতি নেই।’

প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করার কাজে যেসব শ্রমিক নিয়োজিত আছেন তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। প্লাস্টিক বর্জ্যে হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সালফার ডিঅক্সাইড, ডাইঅক্সিনস এবং ভারী ধাতু থাকে। এসব পদার্থের সংস্পর্শে এলে বিভিন্ন ক্রনিক রোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

বিশ্ব বাণিজ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যের গুরুত্ব 

বিশ্ব বাণিজ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর প্লাস্টিক বর্জ্য চলে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে। একটি বাণিজ্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এসব বর্জ্য সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন মহাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এই বাণিজ্য নেটওয়ার্ক বেশ জটিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এতে নীতি নৈতিকতার কোন বালাই থাকে না।

মূলত প্লাস্টিক বর্জ্য একটি পণ্য। এটির রিসাইক্লিং দালালরা বিদেশে এমনসব ক্রেতার সন্ধান করে যারা প্লাস্টিক গলিয়ে, এগুলোকে টুকরো টুকরো করে নতুন কোন পণ্য তৈরি করতে পারে। হংকংভিত্তিক ব্যবসায়ী স্টিভ অং রিসাইক্লিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, যদি কেউ সঠিকভাবে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করে তাহলে সে পরিবেশ রক্ষা করে। কিন্তু যদি কেউ প্লাস্টিক বর্জ্যের রিসাইকেল সঠিকভাবে করতে পারে না সে পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলে। তবে এক্ষেত্রে মুনাফার দিকটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি কোন দেশ থেকে যদি প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করা যায় তাহলে এই শিল্পের মুনাফা আরো বেশি হবে। একারণেই তিনি ডমিনিকান রিপাবলিক কিংবা হাইতিতে এই শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন।

অং জানান, তিনি অত্যাধুনিক সুবিধাসহ এমন কারখানা তৈরি করতে চান যেখানে পরিবেশ দূষণের কোন কিছুই থাকবে না। পাশাপাশি উল্লেখ করেন তার এমন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন যারা সস্তায় কাজ করার খাতিরে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না।

এমনকি  যেসব দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেসব দেশেও চোরাচালানির মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এসব দেশেও প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহারের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকার কারণে তারা চোরাচালানির মাধ্যমে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে।  এমনকি এটা অবৈধ জানা সত্ত্বেও তারা প্লাস্টিক সংগ্রহের জন্য এখনো এই পথেই হাঁটছে।’

আগেই বলা হয়েছে চীন যখন সস্তা এবং দূষিত প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে তখন যুক্তরাষ্ট্রের এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয় মালয়েশিয়া। ২০১৮ সালের প্রথম ১০ মাস যুক্তরাষ্ট্র ১ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করার জন্য মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছিল।

ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন সুবিক বে’তে (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা ঘাঁটি) প্রতি মাসে ১২০টি শিপিং কন্টেইনারে করে প্লাস্টিক বর্জ্য পাঠানো হয়। রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে, এসব কন্টেইনারে করে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস, জর্জিয়া এবং পোর্ট অব নিউইয়র্ক-নিওয়ার্ক থেকে প্লাস্টিকের বর্জিতাংশ পাঠানো হয়েছে।

ম্যানিলা বন্দরের জাহাজের রেকর্ড এবং ফিলিপাইন কাস্টমসের নথি থেকে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা এসব প্লাস্টিক বর্জ্য ফিলিপাইনের ভ্যালেনজুয়েলা সিটিতেও পাঠানো হয়েছে। ম্যানিলার উপকন্ঠে অবস্থিত এই এলাকাটি ‘প্লাস্টিকের শহর’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এ এলাকায় প্লাস্টিক রিসাইক্লিং এর বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। প্লাস্টিকের দূষণে এলাকাবাসীর বেশ কষ্ট হলেও এই রিসাইক্লিং ব্যবসা এই এলাকার মানুষের উপার্জনের বড় উৎস।

চীনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হলে তুরস্কে প্লাস্টিক বর্জ্যের আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। দুই বছরের মধ্যে এই আমদানি ১ লাখ ৫৯ হাজার টন থেকে একলাফে বেড়ে ৪ লাখ ৩৯ হাজারে পৌঁছায়। প্রতি মাসে এসব সস্তা প্লাস্টিক বর্জ্য ১০ টি জাহাজে করে তুরস্কের ইস্তাম্বুল এবং আদানা বন্দরে আনা হয়।

তুরস্কের চেম্বার অব এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারস এর প্রধান বারান বোজোলু বলেন, ‘তুরস্কের বিভিন্ন রাস্তায় ৫ লাখের মত প্লাস্টিক সংগ্রাহক রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের জন্য তারা পিঁপড়ার মত কাজ করে যাচ্ছে।’

তবে বিদেশ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি এসব স্থানীয় প্লাস্টিক সংগ্রাহকদের জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  তারা স্থানীয় প্লাস্টিক বর্জ্য বিক্রির জন্য উপযুক্ত বাজার পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ৩৩ বছর বয়সি এসের ছালাইয়েনের কথা বলা যেতে পারে। আগে তিনি প্লাস্টিক বর্জ্য বিক্রি করে প্রতিমাসে ৮০০ ডলার আয় করতেন। কিন্তু বর্তমানে তার আয় অনেক কমে গেছে। আমদানি করা সস্তা দরের প্লাস্টিক বর্জ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারা টিকে থাকতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে বলতে চাচ্ছি, নিজেদের প্লাস্টিক বর্জ্য নিজের দেশেই রিসাইকেল করুন। আমাদের আয়-রোজগার কমাবেন না এবং আমাদের সবাইকে না খেয়ে থাকার বিপদে ফেলবেন না।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অ্যান্ড্রু স্পাইসার বলেন, ‘নিজেদের বর্জ্য নিয়ে কি হচ্ছে সে ব্যাপারে মানুষ কিছুই জানে না। আন্তর্জাতিক রিসাইক্লিং বাণিজ্য এটিকে অর্থ তৈরির একটি উপায় হিসেবেই দেখছে। এই ব্যাপারে বৈশ্বিক কোন নিয়ম নীতি নেই। কেবলমাত্র দীর্ঘ, নোংরা একটি মার্কেট রয়েছে।  আর এই মার্কেট কেবলমাত্র কিছু কোম্পানিকে নিয়ম নীতিহীন এই বাণিজ্যের ফায়দা নেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।’ প্রসঙ্গত, স্পাইসার বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে পড়ান এবং নিজ রাজ্য সাউথ ক্যারোলিনার রিসাইক্লিং উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য।

সম্প্রতি পরিবেশবাদী গ্রুপ গাইয়ার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লাস্টিক বাণিজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে স্থানান্তরের ফলে এসব দেশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা দূষিত হয়ে পড়েছে, ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে স্থানীয় জনগণ শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এসব দেশগুলো এবং তাদের জনগণ এই দূষণের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত মূল্য বহন করছে। সম্ভবত তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও তা করতে হবে।