‘টুডে-টুমরো’

প্রকাশ: ৩ জুলাই, ২০১৯ ০৮:৪৪ , আপডেট: ৩ জুলাই, ২০১৯ ১০:০৬

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


এম.এ মাসুদঃ
ক্ষমতা ও শক্তি কারও জন্যে অভিশাপ, আবার কারও জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।
ক্ষমতার দাপট পুরো বিশ্বে দৃশ্যমান। পৃথিবীতে ক্ষমতা কারও জন্যে চিরস্থায়ী হয়না। একটা পর্যায়ে ক্ষমতা ও শক্তি দু’টোই হারিয়ে যায়। হয় নিজের ব্যর্থতার কারণে না হয় কারও হস্তক্ষেপে অথবা সৃষ্টিকর্তার অভিশাপে। এটাই ক্ষমতা ও শক্তির ইতিহাস।

ক্ষমতা, শক্তি ও সাহসের ঠেলায় রিফাতকে জনসমক্ষে কুপিয়ে হত্যা করলো রিফাতের স্ত্রীর সাবেক প্রেমিক নয়ন বন্ড। তার স্ত্রী প্রাণপণ চেষ্টা করেও স্বামীকে বাঁচাতে পারলো না। ১ সপ্তাহের ব্যবধানে খুনি নয়ন বন্ড ক্রস ফায়ারে চির বিদায় নিলো। নিথর দেহ পড়ে রইল মাটিতে। নিজ এলাকায় তার লাশ দাফনও করতে দেয়নি বিক্ষুব্ধ জনতা। লাভ কার হলো?

কেউ কাউকে খুন করলে ‘টুডে-টুমরো’ ঐ খুনিও কারও না কারও হাতে নিহত হয়। এটাই স্বাভাবিক।

কেউ কাউকে ঠকালে তাকে আরেকজন ঠকাবে। এটাই আল্লাহর চিরাচরিত নিয়ম। ছোটকাল থেকে শুনে আসছি কাউকে ঠকালে ঠকতে হয় নিজকে।

নয়ন বন্ড রিফাতকে বিনা অপরাধে হত্যা করায় শেষ পর্যন্ত ‘জিরো’ হয়ে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলো। সে পৃথিবীতে একজন জঘন্য খুনি হিসেবে ঘৃণাসহ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর পরকালে খুনের দায়ে চিরকাল জাহান্নামী হয়ে শাস্তি ভোগ করতে হবে। পৃথিবীতে সে যত কিছুই করুক ফলাফল কিন্তু শূন্য।

নয়ন বন্ড না পারলো পৃথিবীতে একজন ভালো মানুষ হতে, না পারলো পরকালে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে। বলতে গেলে তার পুরো জীবনটাই ব্যর্থ।

ইসলামের দৃষ্টিতে- নরহত্যা, গুপ্তহত্যা, অপহরণ, গুম প্রভৃতি চরমপন্থা অবলম্বনকে নিষিদ্ধ করে হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। পূর্ববর্তী অধিকাংশ জাতিসমূহ এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। সাময়িক উত্তেজনা বা সস্তা আবেগের বশবর্তীতে মানুষকে অপহরণ, গুম, খুন, গুপ্তহত্যা চরমপন্থা গ্রহণ বা বাড়াবাড়ির অবকাশ ইসলামে নেই। কাউকে প্রাণনাশ বা হত্যা করা সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিশোধ গ্রহণের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা নিরপরাধ মানুষ হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তারা মানবতাবর্জিত ও সভ্য জগতের শত্রু। তাদের কোনো ধর্ম নেই। নরহত্যা যে কত বড় মহাপাপ, তা তারা উপলব্ধি করে না। নিরপরাধ মানুষ হত্যার মতো ঘোরতর অন্যায় করতে এরা দ্বিধাবোধ করে না। পবিত্র কোরআনে নরহত্যাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩৩)

বিশ্বের সকল ধর্ম নরহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। নিরীহ মানুষকে বিনা বিচারে মেরে ফেলার চেয়ে ভয়াবহ পাপ সমাজে আর নেই। মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কারণে মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্বে পরিণত হওয়ার কারণে পৃথিবীতে আল্লাহর গজব নেমে আসে। অথচ ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী হলো ‘নরহত্যা মহাপাপ।’ নরহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বন্ধে ইসলামি শরিয়তের দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলা উচিত এবং অন্যকেও ধর্মীয় জীবনযাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।

মানুষ যত বেশি নৈতিক শিক্ষা অর্জন ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবে, তাদের জীবন থেকে তত বেশি অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে। হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে করলে হয় প্রকাশ্য হত্যা, আর গোপনে করলে হয় গুপ্তহত্যা। উভয় হত্যাকাণ্ডের শাস্তি ইসলামে একই—মৃত্যুদণ্ড। প্রকাশ্যে বা গোপনে যেভাবেই হোক, হত্যাকারীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। যদি সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে দুনিয়ার আদালতে এর ন্যায়বিচার করতে হবে। নতুবা তাকে আখেরাতের আদালতে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। পবিত্র কোরআনে হত্যাকাণ্ডকে মহাপাপ সাব্যস্ত করেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, জাহান্নামে শাস্তির কঠোর বিধান সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
‘কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে, সে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে, অবশ্য ভুলবশত করে ফেললে অন্য কথা। …আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’
(সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৯২-৯৩)

ক্ষমতা ও শরীরের শক্তি দিয়ে সব কিছু করা যায় এটাও ঠিক না। সেই ক্ষমতা কতটুকু স্থায়ী হবে সেটি বিবেচ্য বিষয়। ক্ষমতা ও শক্তি কারও জন্য পৃথিবীতে স্থায়ী নয়।

যারা মনে করেন, ক্ষমতা ও শক্তি সারা জীবন থাকবে, তারা আসলে মস্ত বড় ভুল করছেন। শেষ বেলায় এসে জিরো হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এটাই ইতিহাস।

ইতিহাস বলে, ক্ষমতা চির স্থায়ী কোন জিনিস নয়। ক্ষমতা ও শক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া হয় মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। আল্লাহ দেখতে চান- মানুষ ক্ষমতা পেলে কোন ধরনের আচরণ করে। ক্ষমতা পেয়ে আল্লাহর স্মরণ বাড়ে, নাকি একেবারে আল্লাহ বিমুখ হয়। সেটি আল্লাহ দেখার জন্য মানুষকে সাময়িকভাবে ক্ষমতা ও শক্তি দান করেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউন ও নমরুদকে অনেক বেশি ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী করেছিলেন। ক্ষমতার ঠেলায় ফেরাউন নিজেকে সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত দাবী করেছিল। একই আচরণ করে নমরুদ। কিন্তু একটা সময় এসে সেই ক্ষমতা ও শক্তি কোন কাজে আসেনি। শূন্য হাতে অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। অভিশপ্ত মানুষের উদাহরণ দিতে গেলে ফেরাউন ও নমরুদের নাম স্মরণ হয়।

আল্লাহর নিদর্শন সমুহকে যারা অস্বীকার করে, যারা ক্ষমতা পেয়ে আল্লাহকে ভুলে যায়, পৃথিবীতে যেমন ইচ্ছে তেমন করে চলে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, আল্লাহর নাফরমানি করলে কি পরিণতি হতে পারে তা মানবজাতিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মিসরে অভিশপ্ত ফেরাউনের লাশকে আল্লাহ তায়ালা নিদর্শন হিসেবে রেখে দিয়েছেন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন-
“আর আমি বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করে নিয়ে গেলাম৷ তারপর ফেরাউন ও তার সেনাদল জুলূম নির্যতন ও সীমালংঘন করার উদ্দেশ্য তাদের পেছনে চললো৷ অবশেষে যখন ফেরাউন ডুবতে থাকলো তখন বলে উঠলো, আমি মেনে নিলাম, নবী ইসরাঈল যার উপর ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া আর কোন প্রকৃত ইলাহ নেই, এবং আমিও আনুগত্যের শির নতকারীদের অন্তরভুক্ত৷

আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হলো- এখন ঈমান আনছো! অথচ এর আগে পর্যন্ত তুমি নাফরমানী চালিয়ে এসেছো এবং তুমি বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের একজন ছিলে৷

এখন তো আমি কেবল তোমার লাশটাকেই রক্ষা করবো যাতে তুমি পরবর্তীদের জন্য শিক্ষনীয় নিদর্শন হয়ে থাকো৷ যদিও অনেক মানুষ এমন আছে যারা আমার নিদর্শনসমূহ থেকে উদাসীন৷ (সূরাঃ ইউনুস- ৯০-৯৩)

কুরআনের আয়াত এটাই প্রমাণ করে যে, ক্ষমতা ও শক্তি চির স্থায়ী কোন জিনিস নয়। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য দেয়া হয়। অাপনি যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন? মনে রাখবেন, আপনার উপরেও কেউ একজন আছেন। ক্ষমতা ও শক্তির অপব্যবহার মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

নয়ন বন্ডর কথাই বলছিলাম।
নয়ন বন্ডর মতো পৃথিবীতে শতশত ‘ভন্ড মানুষ’ রয়েছে। তাদের জীবন ষোল আনাই মিছা। তারা হয় সু-শিক্ষা পায়নি মা-বাবা অথবা গুরুজনদের কাছ থেকে। আর না হয় ক্ষমতা ও শক্তির দাপটে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে অমানুষে পরিণত হয়েছে।
এক ধরনের স্বার্থান্বেষী মহল তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়ন বন্ডের মতো ছেলেদেরকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে। তাদের দিয়ে বাহিনী গড়ে তোলে। সে বাহিনীকে তাদের কাজে লাগায়। সকল প্রকার সার্পোট দেয় রাজনৈতিক নেতা অথবা পর্দার অাড়ালে থাকা গডফাদাররা।

কিছুদিন পর ঐ নয়ন বন্ডরা ভয়ানক হয়ে উঠে।
তারা মানুষকে আর মানুষ মনে করে না। তাদের স্বার্থের জন্য তাদের গড ফাদার অথবা গুরুজনকেও হত্যা করতে পরওয়া করে না। ভয়ানক রূপ ধারণ করে।
যেকোন অপরাধমূলক কাজ তারা কোনো বিষয় বলে মনে করে না।

অবশেষে কোন একটা অপরাধ সংগঠিত করতে গিয়ে ঠিকই তাদের ভয়ানক চরিত্র আল্লাহ তায়ালা মানুষের সামনে উন্মোচন করে দেন। এটাই নয়ন বন্ডদের মতো ক্ষমতাধর সন্ত্রাসীদের ইতিহাস।
সবশেষে ফলাফল হয় “জিরো”

আমরা আর কোন নয়ন বন্ড দেখতে চাই না দেশে। নয়ন বন্ডদের জন্য আর কোনো তাজা প্রাণ ঝড়ে যাক সেটা আমরা চাই না। আর কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয় নয়ন বন্ডদের জন্য।
এটাই এখন যুব সমাজের সময়ের দাবী।

এসো হে যুবক!
এভাবে নিজের জীবনকে ধ্বংস করো না। নিজেকে জানার চেষ্টা করো।
নিজেকে আবিস্কার করো সত্যের মানদন্ডে। নিজের মেধাকে কাজে লাগাও। একদিন তুমিই হবে ‘জিরো থেকে হিরো’।

তুমি চাইলে পার- পৃথিবীটা গড়তে।
তুমি চাইলে পার- পৃথিবীর রঙ বদলিয়ে দিতে।
তুমি চাইলে পার- মহাকাশ জয় করতে।
তুমি চাইলে পার- এভারেস্ট জয় করতে।
তুমি চাইলে পার- মহাসমুদ্র জয় করতে।
তুমি চাইলে পার- পুরো পৃথিবীটাকে জয় করতে।

তুমিই আগামীর বাংলাদেশ, তুমিই ভবিষ্যৎ।
তোমার দিকে তাকিয়ে আছে পুরো জাতি।

-এম.এ মাসুদ
ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার ও
ম্যানেজিং ডিরেক্টর-
আইডিয়াল প্রিন্টার্স
কক্সবাজার।
E-mail: idealprinters.cox@gmail.com