– অধ্যাপক আকতার চৌধুরী

(৭ম পর্ব)

পবিত্র বায়তুল্লাহ  তাওয়াফে আমাদের ৭ চক্কর প্রদক্ষিণ শেষ। বের হয়ে যাব , এমন সময় ছোট বোনের জামাই জাবেদ ও ভাতিজা তাহের বলল ক্বা’বাকে পেছন দিয়ে বের হওয়া যায় না। তাই বায়তুল্লাহ শরীফকে সামনে রেখে পেছনের দিকে হেটে মাকামে ইব্রাহিমকে মাঝে রেখে ২ রাকাত নামাজ আদায় করলাম। তাওয়াফের পরে কিছুটা গরমের প্রভাব তখনও শরীরে। যেহেতু ইহরাম পড়া অবস্থায় মাথায় কিছু দেয়া নিষিদ্ধ, রোদ থেকে মাথা রক্ষাও সম্ভব ছিল না । যথেষ্ট পরিমান তৃষ্ণার্ত। তার উপর প্রচন্ড ভীড় । প্রতি রমজানের শেষ ১০ দিনে প্রচুর পরিমাণ মানুষের আগমন ঘটে। তাই আজ একটা পূর্নাঙ্গ হজ্বের ফ্লেভার । তাওয়াফ শেষ করে জমজমের পানি খেতে হয় । কিন্তু রোজা থাকায় জমজমের পানি দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে একটু পানি মাথায় দিলাম। এতেই ঔষধের কাজ হল। নিমেষে শরীর আরেকটা পর্বের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

আমাদের সাফা -মারওয়া পাহাড় সাঈ করতে হবে। তখনও কল্পনায় হযরত হাজেরা (আ) এর পানির খোঁজে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি চোখে ভাসছিল। মনে হচ্ছিল নির্জন এলাকায় একা একা পানির খোঁজে মরীচিকার পেছনে আমি নিজেই দৌড়াচ্ছি।

কিন্তু একি দেখছি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুরম্য সুড়ঙ্গ যেন। কোথাও মরীচিকা দেখার সুযোগ নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ , একাকিত্ব অনুভব করার সুযোগ নেই। নেই পাহাড়ে উঠে কাফেলা দেখার স্বকরুণ দৃষ্টি ! বিবি হাজেরা (আ) এর তীব্র গরম সহ্যের অনুভূতি কী আমি পাচ্ছি! পাওয়ার কথা নয় এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গ্যালারীতে।

তবু আমার অন্তরে হাজার হাজার বছর আগের অনুভূতি, সাফা থেকে মারুয়া – মারুয়া থেকে সাফা পাহাড়। আর প্রচন্ড ক্ষিধে , ধূ ধূ মরুভূমিতে তীব্র তাপদাহ । ওইতো পানি দেখা যায়- অথচ মরিচীকা! তৃষ্ণার্ত শিশু হযরত ইসমাইলের (রা:) ছটফটানি ।  পানি আর খাবার নিয়ে এলো বলে, মা হাজেরা! কখনও আমার মনে ইসমাইলের ছটফটানি আর পদাঘাত। কখনও বিবি হাজেরার দৌড়। সকল অনুভূতিতে এই আমি।

আমার কাছে মনে হচ্ছে, অন্তরে যদি এ অনুভূতি না জাগে  তবে সাফা-মারওয়ার পর্বটা অপূর্ণ থেকে যাবে। আল্লাহ পাক একটি পরিবারের একজন পিতা হযরত ইব্রাহিম(আ) , একজন মাতা হযরত হাজেরা (আ) ও একজন সন্তান হযরত ইসমাইল(আ) কে এতটাই পছন্দ করেছেন তাদের কার্যকলাপকে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত মুসলমানেরা স্মরণ করে যাবার বিধান করে দিয়েছেন।

আমরা বাবে সাফা’র দিক থেকে প্রবেশ করি। সাফা পর্বতটি এখন অনেকটা মসজিদুল হারাম শরীফের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। সাঈ শুরু করতে হলে প্রথমে সাফা পর্বত থেকে শুরু করতে হয় ।  এখানে সাফা এবং মারওয়ার ২টি পথ ছাড়াও মধ্যবর্তী আরো একটি পথ আছে। এটা দিয়ে শুধূমাত্র যারা শরীরিকভাবে পঙ্গু তাদের সাঈ করতে পারে।

অনেকে মনে করেন সাফা পর্বতে হযরত আদম (আ:) এবং মারওয়া পর্বতে হয়রত হাওয়া (আ) অবতরণ করেছিলেন। সাফা মানে পরিস্কার। হযরত আদম (আ:)কে সাফিউল্লাহও বলা হয় । সেখান থেকেই এই সাফা নামকরণ । আর মারওয়া একটি স্ত্রী বাচক শব্দ । যার মানে ধবধবে সাদা পাথর । আর সেখান থেকেই এই মারওয়া নামকরণ বলে মনে করা হয় । কথিত আছে , ইসলামের আবির্ভাবের আগে সাফা এবং মারওয়ার চুড়ায় ২টি মুর্তি স্থাপন করে পূজা করা হত  ।

তবে সাফা মারওয়া সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনাটি প্রণিধান যোগ্য –
“ ইবরাহিম (আ) আল্লাহর আদেশে তার স্ত্রী হাজেরা (আ) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) কে অল্প কিছু খাদ্যদ্রব্যসহ সাফা ও মারওয়ার কাছে মরুভূমিতে রেখে আসেন। তাদের খাবার ও পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর হাজেরা পানির জন্য এই দুই পাহাড়ের মাঝে সাতবার যাওয়াা আসা করেন। এসময় তিনি ইসমাইল (আ) কে রেখে যান।

প্রথমে তিনি আশেপাশের এলাকা দেখার জন্য সাফা পাহাড়ে উঠেন। তিনি কোনো কাফেলার সন্ধান পাওয়ার আশায় ছিলেন যাতে তাদের কাছ থেকে সামান্য পানি চেয়ে পিপাসা মেটানো যায়। কিছু না দেখার পর তিনি পার্শ্ববর্তী মারওয়া পাহাড়ে উঠেন। মূলত, মরুভুমিতে মরিচিকা দেখে পানির আশায় তিনি দৌড়ে যান। বারবার তার দৃষ্টিভ্রম হয় এবং সামান্য পানি পাওয়ার আশায় এভাবে সাতবার চলাচলের পর ফিরে এসে তিনি দেখতে পান যে ক্রন্দনরত শিশু ইসমাইল (আ) এর পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে পানির ধারা বের হচ্ছে। মূলত, ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আ) এর আঘাতে এই পানির ধারাটি সৃষ্টি হয়। বিবি হাজেরা এই ঝর্ণা পাথর দিয়ে বেধে দেন। এরপর থেকে এটি জমজম কুয়া নামে পরিচিত হয়।

কাবা মসজিদুল হারামে অবস্থিত। সাফা পাহাড় এর থেকে প্রায় ৩৩০ ফুট দূরে অবস্থিত। মারওয়া কাবা থেকে ১১৫০ ফুট দূরে অবস্থিত। সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী দূরত্ব ৯৮০ ফুট। সাতবার আসা যাওয়া করার পর মোটামুটি ২.১ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। পাহাড়দ্বয়ের ও মধ্যবর্তী পথ বর্তমানে দীর্ঘ গ্যালারির মধ্যে অবস্থিত এবং মসজিদের অংশ।”-(উইকিপিডিয়া)

সাফা পাহাড়ে আরোহন কালে এ আয়াত পাঠ করতে হয় –
“ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিং শাআয়িরিল্লাহি ফামান হাজ্জাল বাইতা আয়ি’তামারা ফালা ঝুনাহা আলাইহি আঁইয়্যাতত্বাওয়াফা বিহিমা ওয়া মাং তাত্বাওওয়াআ খাইরান ফাইন্নাল্লাহা শাকেরুন আলিম।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৮)

সাফা পর্বতের এ জায়গা থেকে বায়তুল্লাহ শরীফ বা কেবলা দেখা যায়। কেবলামুখী হয়ে আলহামদুলিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে।

এ দোয়াটি ৩ বার পড়ে সাফা পাহাড় থেকে মারওয়ার দিকে সাঈ বা প্রদক্ষিণ শুরু করতে হবে-
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হাম্দু ইউহয়ি ওয়া ইউমিতু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু আনজাযা ওয়াহদাহু ওয়া নাসারা আবদাহু হাযাামাল আহযাবা ওয়াহদাহু।”

সাফা থেকে মারওয়ার দিকে সাঈ’ বা প্রদক্ষিণ শুরু করলে একটি সবুজ লাইট চিহ্নিত স্থান পড়বে , সেখানে পুরুষরা একটু দৌড়ে অতিক্রম করবে আর নারীরা স্বাভাবিকভাবে হেটে তা অতিক্রম করবে। এটার কারণ হচ্ছে, হযরত হাজেরা (আ) যখন এই জায়গায় আসতেন তখন এই জায়গা থেকে সন্তান ইসমাইল (আ)কে দেখতে পেতেন না । যার কারণে তিনি অস্থির হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেন।

পুরুষদের এই দৌড়ের কারণে অনেকসময় সাথে থাকা মহিলারা পিছিয়ে পড়েন। প্রচন্ড ভিড়ে অনেকসময় হারিয়ে যান। তাই পুরুষদের উচিত সবুজ বাতি যেখানে শেষ সেখানে মহিলাদের জন্য অপেক্ষা করা । এরপর আবার একসাথে সাঈ শুরু করা । অনেকে আছেন সাফা থেকে মারুয়া আবার মারুয়া থেকে সাফায় এসে শেষ হলে এক সাঈ মনে করেন। এভাবে হিসেব করলে ১৪ চক্কর হয়ে যায়। এটা ভুল। সাফা থেকে মারুয়া গেলেই এক চক্কর বা প্রদক্ষিণ গননা করে।

সবুজ চিহ্নিত স্থানে এ দোয়া পড়তে হয়-
‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতাল আআযযুল আকরাম।’

সবুজ চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করার পর পুরুষ-নারী সবাই স্বাভাবিক গতিতে হেটে সাঈ করবে। সাঈ’র সময় স্বাভাবিকভাবে এ দোয়া বেশি বেশি পড়বেন-
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদু। আল্লাহুম্মা হাব্বিব ইলাইনাল ইমানা ওয়া কাররিহ ইলাইনাল কুফরা ওয়াল ফুসুক্বা ওয়াল ইসয়ানা ওয়াঝআলনা মিন ইবাদিকাস সালিহিন।’

মারওয়া পাহাড়ে আরোহন করে দোয়া করা। মারওয়া থেকে সাফার দিকে যাওয়ার সময় আবার এ দোয়া পড়া-
“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদু। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু সাদাক্বা ওয়াদাহু ওয়া নাসারা আবদাহু ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহু; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া লা নাবুদু ইল্লা ইয়্যাহু মুখলিসিনা লাহুদদ্বীন ওয়া লাও কারিহাল কাফিরুন। রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতাল আআযযুল আকরাম। ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিং শাআয়িরিল্লাহি ফামান হাজ্জাল বাইতা আয়ি’তামারা ফালা ঝুনাহা আলাইহি আঁইয়্যাতত্বাওয়াফা বিহিমা ওয়া মাং তাত্বাওওয়াআ খাইরান ফাইন্নাল্লাহা শাকেরুন আলিম।”

মারওয়া থেকে সাফা পাহাড়ে আসার সময়ও সবুজ চিহ্নিত স্থানে পূর্বোল্লিখিত দোয়া পড়া-

‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতাল আআযযুল আকরাম।’

এভাবে সাফা-মারওয়ায় সাঈ শেষ হওয়ার পর এ দোয়া পড়তে হয় –

‘রাব্বানা তাক্বাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাছ্ ছামিউল আলিম। ওয়াতুব্ আলাইনা ইন্নাকা আংতাত্ তাওয়্যাবুর্ রাহিম। ওয়া সাল্লাল্লাহু তাআলা আলা খাইরি খালক্বিহি মুহাম্মাদিউ ওয়া আলিহি ওয়া আসহাবিহি আজমাইন ওয়ারহামনা মাআহুম বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।’-(ছবি ও তথ্য সুত্র: উইকিপিডিয়া ও ইসলামী অনলাইন)

 

চলবে….

 

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (১ম পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (২য় পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৩য় পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৪র্থ পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৫ম পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৬ষ্ঠ পর্ব)