মোঃ নাজিম উদ্দিন, দক্ষিণ চট্টগ্রাম:
অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পটি। ৪৭ বছরেও কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম দক্ষিন জেলার একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া হানিফার চর ক্যাম্পটি যুদ্ধের ৪৭ বছর পরও কারো নজরে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি হিসেবে এখন শুধু রয়েছে একটি ভাঙ্গা মাটির ঘর। মুক্তিযোদ্ধাদের কদর বাড়লেও যে ক্যাম্পটি হতে মুক্তিযুদ্ধের সময় শত শত অপারেশন পরিচালিত হতো সেই ক্যাম্পটির কথা ভুলতে বসেছে এলাকাবাসী। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ক্যাম্পটির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কেউ
কোনদিন চেষ্টা তদবির করেনি। ফলে যুদ্ধের ৪৭ বছর পার হলেও অযন্ত অবহেলায় রয়েছে এই ক্যাম্পটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা দেওয়ার পর পরই লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদের হাজারবিঘা গ্রামের সফিউর রহমান সওদাগর এলাকার তরুনদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। বিষযটি জানতে পেরে স্থানীয় রাজাকারগন পাকবাহীনির সহায়তায় এই গ্রামের উপর হামলা করে। এতে অনেকেই হতাহত হয়। তারা যাবার সময় পাশর্^বর্তী গ্রাম মল্লিক ছোবহান এলাকার একমাত্র হিন্দুপাড়াটিতে আক্রমন করে। পাকবাহীনির গুলিতে ৩ জন নিহত ও প্রায় ১২ জন গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়াও ব্যাপক লুটপাট চালায়, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
হিন্দু পাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। ঘটনার পরদিনই সফিউর রহমান সওদাগর হিন্দুপাড়ার সকল লোকদের নিজের বাড়ীতে নিয়ে আসেন এবং নিজ বসতবাড়ীর উঠানে ছোট ছোট তাবু তৈরি করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। এলাকাবাসীদের সহায়তা নিয়ে তাদের খাবারের ও ব্যবস্থা করেন। বাড়ীতে মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুদের রেখে কয়েকদিন পর স্থানীয় শতাধিক যুবক ও তরুনদের নিয়ে সফিউর রহমান তার খামার বাড়ীর দিকে রওনা হন। পদুয়া এলাকার গভীর ঘন জঙ্গলের মধ্যে খামার বাড়ীটি অবস্থিত ছিল। তাছাড়া বান্দরবান পার্বত্য জেলার
সীমানাতেই এটির অবস্থান ছিল। যাবার সময় সফিউর রহমান সওদাগর তার স্ত্রী কন্যাদেরও সেখানে নিয়ে যান। তারা সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার রান্না করতেন। প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সেখানে নিয়মিত অবস্থান করতেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। বান্দরবান ও দক্ষিন চট্টগ্রামের এলাকাগুলাতে অপারেশন হতো এই ক্যাম্প হতেই। মরহুম শফিউর রহমান সওদাগর, তৎকালীন এমএনএ আবু ছালেহসহ শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এ’ঘাটিতে নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও ভারতীয় কমানন্ডারগনও হেলিকপ্টার নিয়ে এসে ক্যাম্পটি পরিদর্শন করতেন। ক্যাম্পের পূর্ব পার্শ্বে পাহাড়ের উপর মিত্র বাহিনীর যুদ্ধের হেলিকপ্টার অবতরণ করত এবং যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর কাছে সরবরাহ করত এবং মিত্রবাহিনীর সেনা কর্মকর্তারা খোঁজ-খবর নিয়ে দিক-নির্দেশনা দিতেন।

অপরদিকে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকেরা গোপনে-গোপনে খাদ্য ও রসদ সরবরাহ করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। যুদ্ধ শেষে সফিউর রহমান সওদাগর এলাকায় এসে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি মৃত্যুবরন করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে গিয়ে এক সময়কার চট্টগ্রামের খ্যাতিমান সফল ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে টাকার অভাবে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তিনি একই স্কুলে পড়তেন। যার কারনে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন। পদুয়ার হানিফার চরের তার খামার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত। বর্তমানে এ খামার বাড়ি
স্মৃতির বেদনায় শোকাহত হয়ে নীরবে ডুকরে-ডুকরে কাঁদছে। দক্ষিন চট্টগ্রামের সর্বকনিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের পুরো পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছি। আমার চাচা মরহুম সফিউর রহমান সওদাগর রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের ব্যবসা,জমি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন। কেউ খবর পর্যন্ত নেয়নি। এছাড়াও সম্প্রতি তার স্ত্রী আমর চাচীও বিনা চিকিৎসায় মারা যান। বর্তমানে তাদের বসত ঘরে বৃষ্টিতে পানি পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের কথাতো অনেকেই ভুলেই গেছেন।