ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন

বর্ষা মওসুম শুরু হতে আর খুব দেরী নেই।  ইতিমধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কর্তৃপক্ষের নেয়া বেশ কিছু পদক্ষেপ দৃশমান হলেও কাজের তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ছেনা।তাই এখন থেকেই চট্টগ্রাম নগরীর জনগন জলবন্দী হবার আতঙ্কে উদ্বিগ্ন। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন শহরেও ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই জলাবদ্ধতাএখানকার মত দীর্ঘস্থায়ী হয়না। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীর সমস্যা হচ্ছে অল্প বৃষ্টিপাতেই জলমগ্ন হয়ে যায় শহর। দিনের পর দিন পানিতে ডুবে থাকে রাস্তা-ঘাট সহ বিভিন্ন আবাসিকএলাকা।

চট্টগ্রাম শহরে বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের পরিমান ২১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৮০০ মিলিমিটারের মধ্যে ওঠানাম করে। এই ধরনের বিপুল পরিমান বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজননিয়ন্ত্রিত এবং কার্যকর নিষ্কাষণ ব্যবস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য,  বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে নেই ভ’গর্ভস্থ পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা বা স্টর্মওয়াটার ড্রেইনেজ সিস্টেম, নেই বাড়ী-ঘরের টয়লেট থেকে নির্গত ময়লা পানি নিষ্কাশনের জন্য সুয়ারেজ সিষ্টেম। বৃষ্টি এবং ময়লা পানি নিষ্কাষণের জন্য ড্রেন, নদী-নালা, খাল-বিলের মতো উন্মুক্ত ডেইনেজব্যবস্থার উপর পুরোপরি নির্ভর করতে হয়। কিছু কিছু বাড়ী বা স্থাপনায় সেপ্টিক ট্যাংক থাকলেও ময়লা পানি সরাসরি ড্রেন, খাল হয়ে সরাসরি কর্নফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। একগবেষণায় দেখা গেছে, ড্রেন, নদী-নালা, খাল-বিলের সীমিত ধারণ ক্ষমতার কারণে মাত্র ১০ মিলিমিটারের বেশী বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা, পাইপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ করে থাকে। বৈজ্ঞানিক জরীপে দেখা গেছে, বিভিন্ন কারণে পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কে সাধারনতঃ ৫-১০% লিকেজ থাকে এবং বড় শহরে এটা ৩৫% পর্যন্ত হতে পারে। বর্জ্য, মল-মূত্র ও ময়লা পানি নদী-নালা, খাল এবং ভূগর্ভস্থ্য পানিকে দূষিত করছে। পাইপ নেটওয়ার্কের লিকেজেরকারণে তাই সুপেয় পানিও দূষিত হতে পারে। এটা পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরণের হুমকি।

মাছ এবং জলজ প্রানী পানিতে দ্রবিভ’ত অক্সিজেন গ্রহন করেই বেঁচে থাকে। পানিতে দ্রবিভ’ত অক্সিজেনের পরিমান লিটারে ৫ মিলিগ্রামের নীচে নেমে গেলে জলজ প্রানীহুমকির মুখে পড়ে। অক্সিজেনের পরিমান ১-২ মিলিগ্রামের নীচে নেমে গলে মাছ আর বাঁচতে পারেনা। চট্টগ্রামের বড় বড় খালে পানি স্থবির হয়ে আছে, নেই কোনো স্রোত প্রবাহ।  দূষণের জন্য পানি রং কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। বিভিন্ন পয়েন্টে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, চাক্তাই ও মহেষখালের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা শুন্যে নেমে এসেছে। এদিকে কর্ণফুলীনদীর পানির দূষণও চরম আকার ধারন করেছে। সহসা ব্যবস্থা না নিলে চট্টগ্রাম নগরীর প্রান, সুপেয় পানির উৎস কর্ণফুলী মৃত নদীতে পারিণত হবে।

জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় তড়িৎ ও স্বল্পমেয়াদী প্রচেষ্টা হিসাবে রাস্তা-ঘাট উঁচু করা হচ্ছে। ফলে কিছুদনের জন্য রাস্তায় পানি না উঠলেও, রাস্তার দু’পাশের দোকান-পাট ও ঘরবাড়ী প্লাবিত হচ্ছে। শহরের সড়কগুলো উঁচু করার কোনো প্রযুক্তিগত ভিত্তি বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। রাস্তা উঁচু করলে কিজলাবব্ধতার অবসান হবে? রাস্তার উচ্চতা বাড়ালে আশেপাশের এলাকায় কি প্রভাব পড়তে পারে সে নিয়ে কি যথাযথ অনুসন্ধান করা হয়েছে? শুধু কি তাই? নতুন বাড়ী-ঘরেরভিত্তিও রাস্তার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমান্বয়ে উঁচু করে তৈরী করা হচ্ছে। রাস্তার উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে হয়তো দু’এক বছর রাস্তায় পানি উঠবেনা। কিন্তু পরবর্তীতে রাস্তা আবারও উঁচুকরতে হবে। এভাবে বার বার রাস্তা উঁচু করা হলে পুরো শহরটা ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের মত আকাশে নির্মান করতে হবে।  রাস্তার উচ্চতা বৃদ্ধি সমাধানের বদলে সমস্যাকে আরোঘনিভ’ত করছে।

রোড ডিজাইনের নিয়মানুযায়ী রাস্তার উচ্চতা সাধারনতঃ দুপাশের জমি থেকে নিম্নস্তরে নির্ধারণ করা হয় যাতে বৃষ্টির পানি রাস্তায় নির্গমন করতে পারে। আর যথাযত ফ্লাডমডেলিংয়ের মাধ্যমে বন্যার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিটি এলাকার বাড়ীঘর ও অন্যান্য স্থাপনার প্লিন্থ লেভেল নির্দিষ্ট করে দেন । কিন্তু এখানে হচ্ছেঠিক তার উল্টো।

আগ্রাবাদ এবং ডবলমুরিং এলাকায় শেখমুজিব এবং পোর্ট কানেক্টিং সড়কের সংযোগকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হচ্ছে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড । এই সড়কের আশে-পাশে গড়েউঠেছে অসংখ্য ব্যবসা-বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট ও বাড়ী-ঘর। সম্প্রতি এই রোডকে উঁচু করা হচ্ছে। ওই এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নতুন নির্মিতফুটপাতের সমতল থেকে রাস্তা সংলগ্ন স্থাপনাগুলো এক থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত নীচে পড়ে গেছে। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই সেগুলো জলমগ্ন হবে এবং রাস্তার দু’পাশের সবস্থাপনার নীচতলা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে ওই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তর করা ছাড়া মানুষের আর কোনো গত্যন্তর থাকবেনা। দীর্ঘদীন ধরে চলা সড়কনির্মান কাজের জন্য দোকান-পাটের বেচাকেনা এবং পুরো এলাকার ব্যবসা-বানিজ্য স্থবির হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় জনগন ও ব্যসায়ীরা যে আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছেন সেইকথা কি কেউ ভেবেছেন?

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সম্প্রতি ৫,৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় খালখনন, নতুন খাল নির্মান, রিটইেনং দেয়ার নির্মান সহঅন্যান্য বেশ কিছু কাজ সেনাবহিনীর তত্ত্বাবধানে হবার কথা। এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে আমরা যাই করিনা কেনো, সমস্যার শেকড়ে না গিয়ে সমাধানের চেষ্টাকরলে জলাবদ্ধতা থেকে কখনো মুক্তি পাওয়া যাবেনা। শহরের বিভিন্ন এলাকার রাস্তা উঁচুকরণের যে কাজ চলছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।  এ ধরনের পরিকল্পনা ও বৈজ্ঞানিকভিত্তিহীন কাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুফল দিচ্ছে মনে হলেও পরবর্তীতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

(লেখকঃ কাতার সরকারের উচ্চ নগর পকিল্পনাবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ার কৃতি সন্তান।