মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম :

গত তের জুন মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হল ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরের সম্পূরক বাজেট ও ২০১৯- ২০ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর এটি প্রথম বাজেট হলেও চলমান আওয়ামী লীগ সরকারের ১১তম বাজেট এটি। ফলে এই বাজেটে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলের ধারাবাহিকতা এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন থাকাটাই প্রত্যাশিত ছিল। প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী জোরেশোরে নতুনত্বের আওয়াজ তুললেও বাজেটে ধারাবাহিকতার প্রতিফলনই বেশি হয়েছে।

কক্সবাজার কেন্দ্রিক বাজেট বিশ্লেষণেও ধারাবাহিকতা প্রতিদ্ধনিত রয়েছে। ২০১৯-২০২০ অর্থ বাজেটের দুইশত পঁয়ষট্টি (২৬৫) অনুচ্ছেদের প্রায় একশ আটাশ পৃষ্টার বাজেটে কক্সবাজার শব্দটি সরাসরি এসেছে তিনবার (৩)। তিনবারেই কক্সবাজারের চলমান চারটি মেগা প্রকল্পের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে পরোক্ষভাবে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে কক্সবাজার ও সমুদ্র্যের কথা এসেছে অনেকবার।

এবারের বাজেটে দুটি পূর্ণ অনুচ্ছেদে কক্সবাজারের সম্ভাবনার কথা এসেছে গুরুত্ব সহকারে।

একশত চুয়ান্ন (১৫৪) অনুচ্ছেদে “পরিবেশবান্ধব সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প” অংশে কক্সবাজারের পর্যটন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ পুরোটাই কক্সবাজার কেন্দ্রিক এবং এতে স্পষ্ট করা হয়েছে এভাবে- “বাাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম অবিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকত (Unbroken Sandy Sea Beach) কক্সবাজারসহ অনেক পর্যটন স্পট যা এখনো বিশ্বে পরিচিত করে তোলা সম্ভব হয়নি । কক্সবাজার সাবরাং -এ বিদেশি পর্যটকদের জন্য একটি এক্সলুসিভ পর্যটন এলাকা (Exclusive Tourist Zone) স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।“

একশত পঞ্চান্ন (১৫৫) অনুচ্ছেদে “সুনীল অর্থনীতি- সম্ভাবনার নবদিগন্ত” অংশে উল্লেখ করা হয়েছে সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ এক লক্ষ আঠার হাজার বর্গকিলোমিটার (১১৮০০০) সমুদ্র্যের একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়েছে যা আরেকটি বাংলাদেশের সমান প্রায়। এই সমুদ্রে রয়েছে তের (১৩) টির ও বেশি মূল্যবান খনিজ পদার্থ , ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, সামুদ্রিক শৈবাল ইত্যাদি। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জিডিপি দুই শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ষাট (৬০) অনুচ্ছেদে “মধ্যমেয়াদী নীতি কৌশল” অংশে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, মহেশখালীতে মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন কে তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের প্রত্যাশিত দু অংকের প্রবৃদ্ধি অর্জনে এই প্রকল্প দুটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

একশত তেষট্টি (১৬৩) অনুচ্ছেদে “বিমানবন্দর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ” অংশে কক্সবাজার বিমানব্দন্দরকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ সহ এর সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন আছে বলা হয়েছে।

সরাসরি “কক্সবাজার” কেন্দ্রিক চারটি মেগা-প্রকল্প এবারের বাজেটে অগ্রাধিকার পেয়েছে- রেললাইন, সাবরাং পর্যটন কেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকরণ।

কক্সবাজার সংশ্লিষ্ট তথা সমগ্র দেশের স্বার্থ সম্পর্কিত একশত তের (১১৩) অনুচ্ছেদে “তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম ও বিতরণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ” অংশে বলা হয়েছে – বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় তেলগ্যাস অনুসন্ধান চালানোর লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সাথে ৪টি অফশোর ব্লকের জন্য উৎপাদন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে প্রাকৃতিক খনিজ আহরণের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সেতু-টানেল অংশে কর্ণফুলির টানেলের কথা বিশেষভাবে এসেছে যাতে উপকৃত হবে কক্সবাজার জেলা সামগ্রিকভাবে।

বাজেটে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ যার উপকূলীয় অংশের পরিকল্পনায় কক্সবাজার গুরুত্ব পেয়েছে।

বন্যা -খরা –নদী ভাঙ্গন নিয়ন্ত্রণ ও ভুমি পুনরুদ্ধার “ অংশে নৌ, খাল ও জলাশয় খনন ও পুনরুদ্ধারের কথা এসেছে। এই অংশটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাকখালি দখল , ড্রেজিং সহ বিভিধ সমস্যা কক্সবাজারের স্বার্থ সংশ্লিষ্টা।

“মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ” অংশে সমুদ্র্যকে মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে এর পরিমাণ বৃদ্ধিতে সরকার চলতি বছর ৬৫ দিন সমুদ্রে মৎস্য আহরণ বন্ধ করেছে এবং এজন্য ৪ লাখ ১৫ হাজার জেলেকে ৬৫ কেজি করে চাল খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রদান করেছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়াও বাজেটে গুরুত্ব পাওয়া “জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮” কক্সবাজারর উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একশত বিরাশি (১৮২) অনুচ্ছেদে শিরোনাম করা হয়েছে –

“মায়ানমার হতে বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা” শিরোনামের অংশে এগার লক্ষ রোহিংগাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের নিজ বাসভূমিতে ফেরত পাঠানোর জন্য দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

“সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ – সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের” শিরোনামের এবারের বাজেটে কক্সবাজারের আগত সময় কিভাবে যাবে তা সময়ই বলে দিবে ।

সার্বিকভাবে কক্সবাজারের উন্নয়ন নিয়ে মেগা প্রকল্পের কথা গুলো গুরুত্ব পেলেও সমুদ্র নিরাপত্তা, সমুদ্রের দূষণ দূরীকরণ, মাদক নিরুপন ও রোহিঙ্গা সমাধানের বাস্তবিক কোন রুপকল্প অংকিত হয়নি। গুরুত্ব পায়নি লবণ শিল্প ও জেলেদের পেশাগত উন্নয়ন পরিকল্পনা। কক্সবাজারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি দীর্ঘদিনের- শিক্ষা অংশে এর প্রতিফলতা আসেনি।

কক্সবাজারের সমৃদ্ধতা এসব সমস্যার উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। প্রস্তাবিত বাজেটের বাস্তবায়ন সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা কতটা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করে, তার উত্তর সময়-ই বলে দিবে।