মানব পাচারের শিকার নুরুল করিম

ছৈয়দ আলম :

কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ১৭ নং ক্যাম্পে থাকেন নুর কবির। তার স্বপ্ন ছিল বিদেশে পাড়ি দিয়ে টাকা উপার্জন করে পরিবারকে সচ্ছল করা। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হল না আর। সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নিল সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে। মাঝপথে বঙ্গোপসাগর থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে তাকে।

ক্যাম্প-১৭ এ মানবপাচার প্রতিরোধ কল্পে কর্মরত মুসলিম এইড-ইউকে এর সহযোগি সংগঠন জাতীয় মানব কল্যাণ মিশন টীমের কাছে এমন লোহমর্ষক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তিনি। মিয়ানমারের বুচিডং উলাপর এলাকার মৃত মফিজ উল্লাহ’র ছেলে নুর কবির (২৪) ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আসেন। নুর কবিরের রয়েছে স্ত্রী নুর কায়েদা, তিন সন্তান মোহাম্মদ উমর, মিনারা ও হোছনে আরা। বর্তমানে থাকেন কুতুপালং ক্যাম্প ১৭ এর ৭৭ নং সাব ব্লকে। মিয়ানমারে তিনি হাল-চাষ, গরু-ছাগল পালন ও নিজস্ব জমিতে চাষ করে জীবন নির্বাহ করতেন অনেক সুন্দর করে। সেখান থেকে সবকিছু হারিয়ে যখন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তখন তার সেই ধন-সম্পদের কথা মনে পড়ে বারবার স্থির করেন বিদেশ পাড়ি দিয়ে এখানেও ভালোভাবে সংসার চালাবেন। আর সেই বিদেশ পাড়ি দিতে খপ্পড়ে পড়েন তার খালাতো ভাই হোছেন নামের এক মিয়ানমারের মালেশিয়া প্রবাসী মানব পাচারকারীর। তার সাথে মোবাইলে নিয়মিত যোগাযোগ করেন নুর কবির। হোছেনের সাথে কথামতে, এক পর্যায়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কবির। দালাল হোছেনও বাংলাদেশে তার সিন্ডিকেট এর সাথে নুর কবিরকে পরিচয় করে দেয়। এরিইমধ্যে দালাল হোছেন প্রথম পর্যায়ে টাকা লেনদেন করতে ঠিক করে দেয়, প্রতারিত হওয়া নুর কবিরের আপন ভাই হারেছকে। তাকে অন্যজনের মতো কবিরও ২০ হাজার টাকা দেয়। অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়া গিয়ে পরিশোধ করার কথা ধার্য হয়। সেই হারেছ বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পলাতক রয়েছে। তার ঘরটি রয়েছে তালাবদ্ধ।

ক্যাম্প থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে যেভাবে বের হলেন : ক্যাম্প ১৭ এর ৭৭ নং সাব ব্লকের ঘর থেকে বের হয়ে নুর কবির মোছরা নামে খ্যাত এলাকা থেকে মাহিন্দ্রা গাড়িতে করে ৫০ টাকা ভাড়ায় ফলিয়াপাড়া হয়ে উখিয়া স্টেশনে যান। উখিয়া থেকে ৬০০ টাকায় একটি টমটম (ইজি বাইক) রিজার্ভ করে লিংকরোড যান। সেখান থেকে তিনি মোবাইলে দালালের এক সহযোগির সাথে কথা বলে কক্সবাজারের কলাতলি মোড়ে যান। কলাতলি মোড়ে দেখা হয় ক্যাম্প ১৭ এর আরো ৫ জনের সাথে। কলাতলিতে তাদেরকে একদিন রাখা হয় একটি নি¤œমানের হোটেলে। পরদিন সকাল ১০ টায় কলাতলি থেকে একটি কালো মাইক্রো বাসে করে তাদেরকে চকরিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। চকরিয়া থেকে সিএনজি করে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। বাঁশখালীতে বাংলাদেশী দালাল মোটা-সোটা (নাম অজানা) স্থানীয় ‘মলই’ নামে পরিচিত, তাদেরকে স্বীয় জীম্মায় নেন।

পাচারের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী :

‘টানা ২ দিন উপবাস। পাচারের আগের দিন থেকে উপোস রেখে পরদিন সকালে একটি মাছ ধরার বোটে তোলা হয় আমার মতো আরও অনেককেই। পেছন থেকে আমাদের কুকুরের মতো তাড়া করছিল লাঠি হাতে দুইজন। সন্ধ্যা ৬টা থেকে বোটে তুলে রাত ১০ টায় বোট ছাড়ে। যেতে যেতে ফজরের আগ পর্যন্ত গেলে হঠাৎ বোটে পানি ঢুকছে-দেখতে পাই। তখন আমাদেরকে বোট থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। আমরাও পুরোদমে পানি নিষ্কাশন করি। এক পর্যায়ে দেখি বোট ডুবে যাচ্ছে। তখনো আমাদেরকে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করা হচ্ছিল। তখন আমরা সবাই বমি করতে করতে জ্ঞানহারা হয়ে যাচ্ছিলাম। চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার। অন্ধকারে মারধর। টাকার জন্য অকথ্য নির্যাতন। সহ্য করতে পারছিলাম না। গলগল করে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। মারধর আর গগনবিদারী আর্ত চিৎকারে সেখানে তখন বিভীষিকাময় পরিবেশ। আমাদের সামনে যেন যমদূত সব দাঁড়ানো। আমি নিশ্চিত, আমার মৃত্যু সমাগত। স্ত্রী সন্তানের মুখগুলো চোখের সামনে ভাসছিল। তাদের কথাও মনে পড়ছিল বারবার। আর ফেরা হবে না বাড়িতে। পানিতে লাশ পঁচে-গলে যাবে। ‘‘টাকা, টাকা’’ বলে পাচারকারীরা চিৎকার করছিল, আর হায়েনার মতো আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। শরীরে একটা প্রচ- আঘাত পেয়েই কেমন যেন হুঁশহারা হয়ে পড়ি। আমার কাছে থাকা মোবাইল ও ৬ হাজার টাকা তারা কেড়ে নেয়। তখন কোন রকমে সুযোগ বুঝে বোটে থাকা তেল রাখার জার নিয়ে উত্তাল সাগরের অথৈ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

পানিতে ভাসতে ভাসতে দেখি আরেকটা বড় ফিশিং বোট। সেই বোট এগিয়ে এসে আমাদেরকে উদ্ধার করে। তারপর পাই একটু স্বস্তি। মনে করেছিলাম আর ফিরতে পারবো না। আল্লাহ্ আল্লাহ্ জিকিরে মশগুল ছিলাম। পরে সেই বোটের মাঝি ভাত দেন আমাদের। ৩ দিনের উপোসে একমুঠো ভাত পেয়ে পৃথিবী সমান খুশি লাগছিল। তারপর পুরো একদিন বোট চালিয়ে কুতুবদিয়া হয়ে মহেশখালীতে আসি। মহেশখালীতে সেই মাঝির বাড়িতে রেখে ক্যাম্পে আমাদের বাসায় আতœীয়-স্বজনের সাথে মোবাইল ফোনে এই লৌহমর্ষক ঘটনার খবর জানাই। পরদিন উদ্ধার করা সেই দয়ার্দ্র মাঝি আমাদের ৫ জনকে এক হাজার টাকা দিয়ে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। আমরা মহেশখালী ঘাট হয়ে কক্সবাজার পৌঁছে সোজা ক্যাম্পে চলে আসি। ওইদিন ক্যাম্পের আকাশ আমাদের হৃদয়বিদারী কান্নায় ভারী হয়ে উঠে। আমরা যেন নতুন করে জীবন ফিরে পাই।’

কুতুপালং ক্যাম্প ১৭ এর ৭৭ সাব ব্লকে ক্যাম্পের বাসায় বসে ২৪ বছরের রোহিঙ্গা নুর কবির সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে পাচারকারীদের নৃশংসতার কথা বর্ণনা করছিলেন এইভাবে। বলছিলেন, সমুদ্রযাত্রায় ঘটে যাওয়া সব শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী। তিনি যখন তার সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথাগুলো বর্ণনা করছিলেন, চোখে-মুখে তখন আতঙ্কের ছাপ। একপর্যায়ে হু হু করে কাঁদতে থাকেন নুর কবির। তিনি বলেন, ‘কেউ যেন আর এ পথে বিদেশে যাওয়ার কল্পনাও না করেন।’ তবে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করেন। স্ত্রী ও সন্তানদের মুখ আল্লাহ্ দেখিয়েছেন। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হওয়ায় এই শাস্তি তার পাওনা ছিল বলে তিনি মনে করেন।

কষ্টের কাহিনী ও পরিত্রাণের উপায় :

স্বপ্রণোদিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে অপহৃত হয়ে মালয়েশিয়াগামী বোটের যাত্রী হতে বাধ্য হয়েছেন। এরকম সংখ্যাও চমকে উঠার মতো! বিভিন্নভাবে প্রলোভনে ফেলে অনেককে জোর করে পাচারকারী দালালেরা উঠিয়ে দিয়েছেন মালয়েশিয়াগামী বোটে। এভাবেই নিজেদের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিয়ে অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিয়ে অজানায় হারিয়ে যাচ্ছে শত শত মানুষ। উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর সাগরপথের এসব যাত্রীর বেশির ভাগেরই সলিল সমাধি ঘটে উত্তাল সাগরেই।

মানব পাচারকারী চক্রের এখন প্রধান টার্গেট রোহিঙ্গা ক্যাম্প। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে মালয়েশিয়া গিয়ে উন্নত জীবন গঠনের এক ধরণের ইগো কাজ করে। পাচারকারী চক্র সেই ইগোকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে এগুচ্ছে। আগামি শীত মৌসুমে মানবপাচারের ঢল নামবে বলেও আশংকা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় কুতুপালং ক্যাম্প ১৭ তে মানব পাচার প্রতিরোধ ও ফিরে আসা ভিক্টিমদের সহযোগিতা করতে কাজ করছে মুসলিম এইডের সহযোগি পার্টনার জাতীয় মানব কল্যাণ মিশন।