নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

কক্সবাজারে কর্মরত এনজিও কোস্ট ট্রাস্ট ও জাতিসংঘের শরণার্থী এজেন্সি ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তায় “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত” শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনা আয়োজন করে দৈনিক সমকাল।
১৩ জুন গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনা সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি এবং কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহি পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী।
গোলটেবিলে বক্তব্য রাখেন দেশের বরেণ্য মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আবুল মকসুদ, শিরীন হক, ব্যারিষ্টার মনজুর হাসান, নঈম গওহর ওয়ারা, আসিফ মুনীর, শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম এনডিসি, ইউএনএইচসিআর-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি স্টিভেন করলিস এবং কক্সবাজার চেম্বারের আবু মুরশেদ চৌধুরী। কোস্ট ট্রাস্টের মুজিবুল হক মুনীর বক্তাদের কাছে আলোচনার মূল প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন।
রোহিঙ্গা সংকট ক্রমশ জটিল আকার ধারণ ও প্রত্যাবাসন সুদূর পরাহত হতে থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আলোচকগণ বর্তমান সাড়াপ্রদান পদ্ধতির বিভিন্ন দিক ও বহুবার্ষিক পরিকল্পনার বিষয়টি তুলে ধরেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ এবং অলস বসে না থেকে অর্থবহ ও উৎপাদনমুখী কাজে তাদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তারা দাবি উত্থাপন করেন।
আলোচনায় মোহাম্মদ আবুল কালাম রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা নাকচ করেন।
তিনি বলেন, এই সংকট মোকাবেলায় প্রথম থেকেই যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন, রোহিঙ্গারা অতি সাধারণ, ধার্মিক, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ। তবে তারা মিয়ানমার শাসকদের পদ্ধতিগত নেতিবাচক প্রচারণা ও মানবিক বিপর্যয়ের শিকার। তিনি বলেন, তাদের বিষয়ে কথা বলার সময় আমাদের অবশ্যই পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে এবং তথ্যনির্ভর হতে হবে।
স্টিভেন করলিস তার বক্তব্যে বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাস্তুচ্যুতির মূল কারণ ও এই সংকটের সার্বিক সমাধান রয়েছে মিয়ানমারে। তিনি সংকটের শুরুতে বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার মহত্ত্বের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন, শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থানের জন্য এই সাড়াপ্রদানে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যে সহমর্মিমতা দেখিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত খুলে দেয়ার মাধ্যমে যে উদারতা প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের বজায় রাখতে হবে। এই সম্প্রীতি বজায় রাখা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব, তিনি বলেন।
নারীপক্ষের শীরিন হক বলেন, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ভবিষ্যত অত্যন্ত সংকটপূর্ণ, তাদেরকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করতে হবে যাতে তারা পাচারকারী ও জঙ্গিবাদীদের খপ্পরে না পড়ে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যারিষ্টার মনজুর হাসান রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহনে তাদের অংশগ্রহনের সুযোগ দেবার দাবি জানান।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই শিশু ও যুবা, তাদের জন্য শিক্ষা ও উৎপাদনশীল কারিগরী প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
কক্সবাজার চেম্বারের আবু মুরশেদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে একটি উৎপাদনশীল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে স্থানীয় বাজারে অবদান রাখার সুযোগ দিতে হবে। এতে তারা কক্সবাজারের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে একটি শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস ও বৈশাখি টেলিভিশনের সাংবাদিক এবং রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক জুলফিকার আলী মানিক বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং এই সংকট মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে।
শরণার্থী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ভাষানচর বা এই জাতীয় প্রকল্প দিয়ে এই বৃহত্তর সংকটের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। একটি সামগ্রিক সাড়াপ্রদানের জন্য সরকারকে বহুবার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
ডিজাস্টার ফোরামের নঈম গওহর ওয়ারা বলেন, দেশের সুশীল সমাজকে ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসি বা বিকল্প কূটনৈতিক তৎপরতায় সম্পৃক্ত করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে শ্রমিক অভিবাসন ও পুনর্বাসন ইত্যাদি সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো দেশে প্রত্যাবাসন করা যায়।
কক্সবাজারের জাগো নারী সংস্থার শিউলি শর্মা বলেন, রোহিঙ্গা নারীরা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে অনেকটাই মরিয়া, ফলে তাদের পাচারকারীদের হাতে পড়ার অনেক ঝুঁকি রয়েছে।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, এই বিষয়ে জাতি হিসেবে আমাদের ঐকমত্যে আসা দরকার এবং আমাদের দেশকে একটি মানবিক দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকা দরকার।