শিপ্ত বড়ুয়া

যে ক্ষতি কখনো কেউ পুষিয়ে দিতে পারবে না তা আমাদের প্রকৃতির অসম্মান। মানবিকতার দৃষ্টান্ত দেখাতে গিয়ে আমাদের বিসর্জন দিতে হয়েছে ৬ হাজার একর বনভূমি, ধ্বংস হয়েছে আমাদের জীববৈচিত্র, কৃষি ও প্রকুতি। প্রকৃতির চরম ধ্বংস এনে আমরা করেছি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল।

কিছু তথ্য দেখা যাক, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ মূলত ১৯৭০ সাল থেকে, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী থেকে অনুপ্রবেশ হলেও বড় অনুপ্রবেশ ঘটে ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের দিকে। দেখতে দেখতে প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ বছর কাটলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ থামছে না। কক্সবাজারসহ পুরো বাংলাদেশ পড়ে আছে হুমকির মুখে। বাংলাদেশ পাসপোর্ট ও বহিরাগমন অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে বর্তমানে বাংলাদেশ নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। প্রতিমাসে তাদের জ্বালানি কাঠ প্রয়োজন ৬,৮০০ টন যার যোগানদাতা আমাদের বনভূমি।
২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রকিয়া শুরুর বিষয়ে সম্মত হলেও এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এবং সহায়তা সংস্থাগুলোও। তাদের আশঙ্কা, মিয়ানমারে ফিরে গেলে আবারও নিরাপত্তা সংকটে পড়বে রোহিঙ্গারা এবং তাদের আশঙ্কার কাছে জিম্মি হয়ে আছি আমরা। জানি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খুব একটা সহজ কাজ নয় এবং প্রত্যাবার্সন করতে গিয়ে আমাদের বাংলাদেশের সামগ্রিক যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা পূরণ হওয়ার নয়।
আরেকটি ভবিষ্যৎ বড় বিপর্যয় ঘটবে আমাদের উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে। আমাদের উচ্চশিক্ষাকে নিম্নমুখী করে ছাড়বে। কক্সবাজারসহ আশপাশের সকল স্থানের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে এখন রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে উচ্চ বেতনে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করছে, যা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের উচ্চশিক্ষা অর্জনে । স্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোতে খোঁজ নিলেই দেখা যায় কি পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী সংকট বর্তমানে ঘটছে। এইযে এস.এস.সি এবং এইস.এস.সি পাশ করে লেখাপড়ার তোয়াক্কা না করে ছেলে-মেয়েদের টাকা কামানোর নেশা তা আমাদের এই প্রজন্মকে বিরাট ক্ষতির মুখে ফেলবে নিঃসন্দেহে। রোহিঙ্গাদের স্থায়ীত্ব যেমন আমাদের একটি বিরাট জাতির উচ্চশিক্ষার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমনি আরো ভয়ানক ব্যাপার তাদের শুদ্ধ বাংলায় শিক্ষা গ্রহণ। বর্তমানে প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্যভাবে বিভিন্ন এন.জি.ও রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাংলা ভাষায় তাদের শিক্ষিত করে তুলছে যা পরবর্তীতে বাঙালী এবং রোহিঙ্গা সনাক্তকরণে বিপাকে ফেলবে প্রসাশনকে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ৷ বাংলাদেশে এখন কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও, ধীরে ধীরে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে যেতে পারে এসব ব্যাধী৷
আরো দ্রুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবার্সন জরুরী তার অন্যতম কারণ আমাদের অর্থনীতির অবক্ষয় এবং তাদের অভ্যন্ত্যরীণ সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও সংগঠিতকরণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার ৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ১১২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ৷ কিন্তু আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই ৷ জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার ৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই ৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা ৷ বর্তমানে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি এই সাহায্য অব্যহত থাকবে সেটা বলা মুশকিল ৷ যখন পাওয়া যাবে না তখন বাংলাদেশকেই এই টাকা খরচ করতে হবে ৷ হঠাৎ তারা অস্বীকৃতি জানালে আমাদের দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থা তা সামাল দিতে পারবে কিনা তা ভাবভার বিষয় বৈকি। বর্তমানে স্থানীয় কৃষি পণ্যের সিংহভাগ চলে যায় রোহিঙ্গা শিবিরে যা বরাবরের মতো স্থানীয় জনগোষ্টির চাহিদায় বিঘ্ন ঘঠাচ্ছে। স্থানীয়দের আয়-রোজগারেও হচ্ছে বড় বাধা এই রোহিঙ্গা জনগোষ্টি। সামগ্রিক দিক চিন্তা করতে গেলে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবার্সন না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির গোড়ায় গন্ডগোল হয়ে যাবে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভ্যাশন আর্মি বা আরসা, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর এআরএসএ-র বিদ্রোহীরা (তখন হারকাত আল-ইয়কিন নামে পরিচিত) মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের চৌকিতে হামলা করে নয় সদস্যকে হত্যা করে ও ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে দায়িত্ব স্বীকার করে যেখানে প্রধান হিসেবে দেখা যায় আতাউল্লা নামের এক ব্যক্তিকে। বর্তমানেও বাংলাদেশর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে তাদের ব্যপক উপস্থিতি বেড়েছে যার সরাসরি প্রমাণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরিরত ছেলে-মেয়েরা এবং আমাদের স্থানীয় প্রশাসন। রাত নামলেই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে চলে তাদের রাজত্ব। বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরে ২৫টি সশস্ত্র রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠি রাজত্ব চালায় যার বর্ণনা বেশ ভয়াভয়। শেষ তথ্যমতে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, ধর্ষণ, ডাকাতি, মানবপাচারসহ নানা অপরাধের মধ্যে ৩২৮টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৭১১ জন। এরমধ্যে খুনের ঘটনা রয়েছে ৩১টি, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে ১৯টি ও মাদক উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে ১১৮টি। এসব তথ্য দিন দিন আরো ভারি হবে, আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াবে। একবার ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভেবে দেখুন ১১ লাখ মানুষ একসাথে কোন অস্ত্র ছাড়াও কক্সবাজার দিয়ে হেঁটে গেলে আপনাদের কিইবা করার থাকবে!
বাংলাদেশ সরকারের খুব দ্রুত এবং গুরুত্বসহকারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবার্সন নিয়ে আন্তর্জাতিক এবং পারষ্পারিক আলোচনা ও সমঝোতা দরকার। যেকোন মূল্যে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে না পারলে আমাদের দিতে হবে চরম মূল্য। এখনো পর্যন্ত দুদেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যার্বাসন নিয়ে যে আলোচনা তা আমাদের মনে কোনভাবেই আশার সঞ্চার জাগায় না কেননা কয়েক দফা আলোচনার পরেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সুতরাং আমাদের অদূর ভবিষ্যৎ কি তা কে জানে?