ডেস্ক নিউজ:
শুধু হাওয়ায় যে তরবারি চালানো যায় না – এবার মনে হয় তার থেকে কিছু শিক্ষা ভারতের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের হবে। কারণ, ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি’কে ‘গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক’ বলে কারো কারো মনে হলেও, সপ্তদশ সাধারণ নির্বাচনে জনগণের রায় শেষ পর্যন্ত সেই দলের প্রতিই যে আস্থা জ্ঞাপন করল!

এবং আর যাই হোক ‘ইভিএম ম্যানিপুলেট করে’ ভারতের মতো বিশাল দেশে আসমুদ্র হিমাচলের তাবৎ ভোটদাতার সমস্ত রায়কে যে শাসক দলের পক্ষে বদলে ফেলা যায় না – নিতান্ত বুদ্ধিহীন না হলে, সেই দাবিও বোধহয় ভবিষ্যতে আর কেউ করবেন না।

তবে একথা সত্য যে, ভোট দাতাদের অশিক্ষা – অজ্ঞতা অনেক সময়ই দুর্নীতিগ্রস্ত, খুন, ধর্ষণ ও ‘সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত’ অপরাধীকেও নির্বাচিত করে। এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশলের কাছে প্রায়শই হার মানতে হয় জনগণকে।

আর গণতন্ত্রের নামেই বছরের পর বছর ধরে সেই অন্যায়, অপশাসনের জোয়াল আম জনতাকেই কাঁধে বয়ে বেড়াতে হয় । কিন্তু গণতন্ত্রের এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার প্রতি কি আমরা আস্থা হারাতে পারি?

যদিও ভোটের আগে প্রত্যেকবারই দেখি দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় সব নেতা-নেত্রীই — নাহ, সবাই নন কেউ কেউ — যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নামেন। আশ্চর্য হই এই দেখেও যে, যাঁদের হাতে গণতন্ত্র হত্যার রক্ত সবচেয়ে বেশি লাগে, তাঁরাই গণতন্ত্রের সব থেকে বড় রক্ষক হিসেবে নিজেকে দেখতে চান, দেখাতেও চান।

আর সেই দেখানোর চেষ্টায়, যে যত বড় ঢাক গলায় ঝোলাতে পারেন, তার আওয়াজও তত দূরপ্রসারী হতে থাকে।

কিন্তু মুশকিল হল আমজনতা যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না – কোনটা সত্যি । ওই ঢাকের আওয়াজ, নাকি তাঁদের জীবনের নিত্য দলিত ও নিহত হওয়া অধিকারগুলি।

আসলে মনে ধন্দ জাগে এই কারণে যে, একই সঙ্গে একই ব্যক্তি দ্বারা তো গণতন্ত্র রক্ষা ও তার হত্যা সংঘটিত হতে পারে না। তাই একটিকে সত্য মানলে, অপরটিকে ‘মায়া’ বলে মানতেই হয়।

অবশ্য মনে হয় আমজনতা ওই সত্য ও মায়ার তফাৎটা একদিন না একদিন ঠিক ধরে ফেলে । আর সেই সত্যের উপলব্ধি থেকেই তার অসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে একদিন নিজের ভ্রম সংশোধন করে। তারই একদা নির্বাচিত গদি সে উল্টে দেয়, পাল্টেও দেয়।

আর সেই উল্টে দেওয়া, পাল্টে দেওয়ার ধারাবাহিকতাতেই প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচিত দলীয় প্রতিনিধিরা ভারতের লোকসভা ও বিধানসভায় যান। এবং অনেকেই এই সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিকে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ বলতেও ভালবাসেন।

হ্যাঁ, উৎসবই বটে। তবে মনে হয় সেই উৎসবের আনন্দে সবাই শামিল হতে পারেন না। এবং দেশের সর্বত্র তা ঠিক উৎসব হিসেবে পালিতও হয় না।

কারণ অনেক সময়, অনেক জায়গাতেই সে উৎসবের উপচারে থাকে দলীয় নেতা ও প্রার্থীদের পরস্পরের প্রতি কুৎসিত-কদর্য ভাষা-সন্ত্রাসের দাপট। সে উৎসবে থাকে টাকার বিনিময়ে ভোট কেনা-বেচা। থাকে ভয় দেখানো, খুন জখম সহ নানাবিধ অত্যাচারের সাজানো নৈবেদ্যও।

তাই কোন কোন জায়গায় সেই উৎসবের আনন্দের গায়ে লেগে যায় রক্তের ছিটে। আছড়ে পড়ে স্বজন হারানোর কান্না। এবং সেই আশির দশকের শেষ থেকেই রাজ্যে এই ট্র্যাডিশনে কখনো ছেদ পড়তেও দেখিনি ।

আসলে, কী দেশে, কী রাজ্যে, যতবারই পালাবদলে ভিন্ন ভিন্ন দলের আবির্ভাব ঘটুক না কেন, সরকার গঠনের সময় মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে যত লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়া হোক না কেন, যতই সংবিধানের কসম খেয়ে বুক ঠুকে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিজেদের জাহির করার আপ্রাণ চেষ্টা থাক না কেন, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের স্থান কিন্তু ক্রমশই নিম্নগামী।

ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’র বাৎসরিক রিপোর্ট বলছে, গ্লোবাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে ভারতের স্থান ৩২তম থেকে ৪২তমতে নেমে এসেছে। আর তা ঘটেছে মূলত দেশে গোঁড়া ধর্মীয় আদর্শের উত্থান এবং সংখ্যালঘু ও ভিন্নমত পোষণকারীর প্রতি দলগত হিংসা, আক্রমণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায়। (আরও জানতে এখানে ক্লিক করুন )।

স্বাধীন দেশগুলিতে সত্যি কতটা গণতন্ত্র বজায় আছে, পৃথিবীর ১৬৫ দেশে সেই সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে দেখা যায় আগের মতোই নরওয়ে আছে প্রথম স্থানে। যথাক্রমে ২য় ও ৩য় স্থানে আইসল্যান্ড ও সুইডেন। এবং প্রথম ১৯টি দেশে রয়েছে ‘ফুল ডেমোক্রেসি’।

তবে ভারত সহ বহু দেশেই কিন্তু চলছে ‘ফ্লড ডেমোক্রেসি’ – অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র। আর ওই ১৬৫ দেশের মধ্যে ৫৫ দেশের মানুষ, যা বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ, কিন্তু ওই ‘ফ্লড ডেমোক্রেসি’তেই বাস করে।

তাই আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে চীন, রাশিয়া বা মিয়ানমারের মতো ভারতে ‘অথরিটারিয়ান রেজিম’ না হোক, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ (৯২তম), নেপাল (৯৪তম), ভুটান (৯৯তম) ও পাকিস্তান (১১০তম), এর মতো ‘হাইব্রিড রেজিম’ হয়ে উঠবে না তো?

এমনিতে ভারতে ভোট ব্যাঙ্ক পলিটিক্স’র চর্চা বহু যুগ ধরেই চলছে। তাতে জাতপাতকে টেনে আনা হয়। ‘ধর্ম’ও সেখানে উঁকিঝুঁকি মারে। কিন্তু এবারের নির্বাচনী প্রচারে তার তীব্রতা টের পাওয়া গেল।

‘ধর্ম’র উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ভাবে ঘটেছে। তাতে দেশের কতটা মেরুকরণ হল, আমাদের নেতা-নেত্রীদের এবার তা ভাবার সময়। কারণ বাড়িতে আগুন লাগলে সেই আগুনের আঁচ কিন্তু সবারই গায়ে এসে লাগে।

অবশ্য আশঙ্কার পাশাপাশি এখন এই আশা করছি যে, এবার দেশের নেতা-নেত্রীরা মানুষকে যেন আর অত বোকা না ভাবেন। নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থকে, জনগণের স্বার্থ বলে তুলে ধরার ভুল না করেন।

মনে এই আশাও লালন করছি যে, প্রকৃত তথ্য ও প্রমাণ ছাড়া চমক সৃষ্টির চেষ্টা না করে যেন দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন – যাতে ভারতীয় গণতন্ত্রের অধোগতিকে রুদ্ধ করার পথ তাঁরা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পান।