মাহবুবা সুলতানা শিউলি

ঈদ মানেই উপছেপড়া আনন্দ, ঈদ মানেই খুশির বন্যা। যখন ছোট ছিলাম ঈদের আনন্দটা সেইরকম ছিলো। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা আমরা গ্রামের বাড়িতে উদযাপন করতাম। আমার আব্বু সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন বিধায় বছরে ছুটি বলতে দুটো ঈদই বরাদ্দ ছিলো তাও দশদিনের জন্য এবং রোজা ঈদে ছুটি নিলে কুরবানী ঈদের ছুটি ক্যান্সেল। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুরবানী ঈদই গ্রামের বাড়িতে করা হয়। আর মজার বিষয় ছিলো রোজা রাখার আনন্দটা ছিলো অনেক বেশি। কে কয়টা রোজা রেখেছি, সেগুলি নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে বাড়িতে কাজিনদের সাথে তাই যত কষ্টই হোক না কেন জানপ্রাণ দিয়ে রোজা রাখতাম। খুব মনে পড়ে তখন অনেক ছোট। বয়স চার কি পাঁচ হবে, স্কুলে ভর্তি হইনি। রোজা রেখে লুকিয়ে ফ্রিজ থেকে বাদাম আর পানি খেয়েছিলাম। সেই সিক্রেটটি তখন কাউকেই বলিনি। আরেকটু বড় হবার পর তখন নয়-দশ বছর হবে, আমাদের সরকারি বাসভবনের পাশের পুকুরে ভাইবোনরা একসাথে গোসল করতাম। রোজার সময় বেশ কয়েকবার পুকুরে ডুব দিয়ে পানি খেয়ে ফেলতাম। আহ্ কতই না অবুঝ ছিলাম! যাঁর দেখার (মহান আল্লাহপাক) তিনি তো দেখছেন! সেই বোধটুকু ছিলো না! বড় হবার পর ভাইবোনদের এসব বলে অনেক হেসেছিলাম নিজের অবুঝ মনের বোকামির কথা গুলো শেয়ার করে। আরেকটা মজার বিষয় ছিলো, নির্দিষ্ট বাজেটের ভিতরে ঈদের শপিং। আব্বু দশ রমজানের পর আমাদের ভাই-বোনদের ডেকে সবার বাজেট দিয়ে দিতেন। আমাদের তিনবোনের একেকজনের বাজেট ছিল পনেরশো। ভাইদের একহাজার। তা দিয়ে আমরা মহা আনন্দে মার্কেট ঘুরে ঘুরে ঈদের জামা, জুতা কিনতাম। আহ্ কতই না আনন্দের ছিলো সেই শপিং এ। ঈদের জন্য কাঙ্ক্ষিত একটাই নতুন জামা ও একজোড়া জুতা। (এখনকার একেকটা বাচ্চাদের জন্য পাঁচ ছয়টা ড্রেস, দুইতিন জোড়া জুতা সেন্ডেল কিনে দেবার পরও বাবা-মায়ের মনে শান্তি নেই। তাই ছোট বাচ্চাগুলোর চাহিদারও শেষ নেই। কোনটা রেখে কোনটা পরবে এই অবস্থা।) যাই হোক শপিং এর আনন্দের পর বহু আকাঙ্ক্ষিত ঈদের জন্য অপেক্ষা। যাকাতের জন্য আব্বু গ্রামের গরীব মানুষদের জন্য লুঙ্গী, শাড়ী, বাচ্চাদের কাপড় এগুলো কিনে আগেই কারো দ্বারা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। ঈদের দু-তিনদিন আগেই আমরা ট্রেনে করে চলে যেতাম। ঘরে পৌঁছার পর যে দৃশ্যটি সবচেয়ে আনন্দের তা হলো, আশের পাশের আব্বুর চাচা-চাচী, চাচাতো ভাইবোন সবাই চলে আসতেন আমাদের দেখতে। কারণ আগেই বলেছি সরকারি ছুটি নিয়ে দশদিনের জন্য বছরে একবারই আসা হতো আর অন্যসময় কোনো জরুরী কোন অনুষ্ঠান, কারো মৃত্যু বা আকষ্মিক কোন প্রয়োজনে কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি যাওয়া হতো। ঘরের বাইরে দাদী অনেকদূরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আব্বু গাড়ি থেকে নেমেই দাদীকে পায়ে ধরে সালাম করার পর মা-ছেলের কান্নাকাটি, আদর মহব্বতের দৃশ্যটি ছিলো অতুলনীয়।(আমার দাদা অনেক আগেই মারা গেছেন, তাই দাদাকে আমি দেখিনি)। তারপর একে একে আব্বু ওনার চাচা-চাচীসহ যত মুরব্বী আছেন সবাইকে সালাম করে, কোলাকুলি করে ঘরে ঢুকেন। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ওনার যত কাজিন ও ছোটরা আছেন, ওনাকে পায়ে ধরে সালাম করতেন কারণ আমার দাদা ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার বড় আর আমার আব্বু ছিলেন সবার বড় ভাই। সেই দৃশ্যগুলো আজও চোখে ভাসে। ঘরে পৌঁছার পর ঘরভর্তি মানুষের মিলনমেলা। তারপর ঈদের আগের রাতগুলোতে আমাদের মত বাচ্চাদের দ্রুত বিছানায় চলে যেতে হতো। কারণ ভোরে ওঠতে হবে। শীত কিংবা গরমকাল যাই হোক না কেন আমরা বাচ্চারা সূর্য ওঠার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আমাদের ডাকতে হতোনা। বড়দের আওয়াজ ও ঈদের আনন্দের উত্তেজনায় এমনিতেই ঘুম ভাঙতো। প্রচন্ড ঠান্ডায়ও অনেক ঈদে আমরা বাচ্চারা দল বেঁধে বাড়ির পাশের ধলাই নদীতে গোসল করেছি। বাড়ির পুকুরে মহিলা, মুরুব্বিরা গোসল করতেন। নদীতে গোসলের কি যে আনন্দ!! শীতকেও শীত মনে হতোনা। প্রচন্ড শীতেও নদীতে ঝাঁপ দিতাম।
সকালের আলোর সাথে সাথে আমরাও নতুন জামাকাপড় পরে আলোকিত হতাম তারপর দাদীকে সালাম করে দুইটাকা সালামীটা পেয়ে কতই না খুশী হতাম। দাদী একে একে সব বাচ্চাদের দুইটাকার নোট দিতেন। তারপর আব্বু আম্মুকে সালাম করতাম। আব্বু বিশ টাকা করে যত বাচ্চারা সালাম করুক না কেন সবাইকেই দিতেন। দিন শেষে আমাদের প্রায় আশি-নব্বই টাকা জমে যেতো। ইশ্ কি যে আনন্দের ছিলো সেই সালামি যখন পেতাম। সমবয়সী কাজিনরা সবাই দলবেঁধে দোকানে চলে যেতাম। টাকা দিয়ে হাবিজাবি কিনে খেতাম। আর দলবেঁধে বাসায় বাসায় বেড়াতাম। সেমাই, চানাবুট ভাজা, পোলাও, মাংস রান্না প্রায় ঘরে ঘরেই জোর করে খাওয়াতো। অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার কারণে প্রায় ঈদেই পেটে গন্ডগোল দেখা দিতো। যাইহোক সবচেয়ে মজার স্মৃতিগুলো হলো আমার আব্বুরা চার বোন দুই ভাই। আমার আব্বুর বাচ্চারা মানে আমরা তিনভাই, তিনবোন। বড় ফুফুর ছয় মেয়ে, দুইছেলে। মেজফুফুর একমেয়ে। সেজ ফুফুর তিনছেলে, একমেয়ে। ছোট ফুফুর চারমেয়ে, একছেলে (পরবর্তীতে একমেয়ে অনেক বড় হবার পর অসুস্থ হয়ে মারা যায়)। আর কাকার তিনছেলের মধ্যে বড়টা, বাকীদুটো আমাদের অনেক ছোট আমরা সবাই মিলে দাদীর নাতি-নাতনির সংখ্যা ছিলো ২৭ জন। ঈদের দিনে সব ফুফুরা বাচ্চারাসহ চলে আসতেন কারণ আমার আব্বু অর্থাৎ তাঁদের বড় ভাইয়ের সাথে কয়েকটা দিন কাটানোর জন্য। সাথে ফুফারাও। ঘরভর্তি মানুষ। কি যে উৎসব থাকে চারপাঁচদিন। কিন্তু আমরা বাচ্চারা, আশেপাশের যত বাচ্চা আছে সবাই মিলে এত দুষ্টুমি করতাম, দাদী অসহ্য হয়ে লাঠি হাতে সবাইকে ভয় দেখিয়ে বলতেন, যাহ্ বাইরে যা সবাই। এখানে কিসের মেজবান! বাইরে খেলা কর গিয়ে। একদিন লাঠি হাতে দৌঁড়াতে গিয়ে ফ্যানে লাঠি লেগে দাদী পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেয়ে মাথা ফুলে অনেক ব্যথা পেয়েছিলেন। তারপরও আমরা বাঁদরের দল কেউ পেয়ারা গাছে, কেউ আমগাছে, কেউ কাঁঠাল গাছে, কেউ জাম গাছে, কেউবা বড়ইগাছে আরো কিছু ফলগাছ ছিলো সব মনে পড়ছেনা, আবার সবচেয়ে দস্যু কাজিনটাতো নারিকেল গাছে একেকজন একেক গাছে চড়তাম, পড়েও যেতাম। আবার ছাদে গিয়ে বাড়ির পাশের যতগুলো সুপারী গাছ আছে, ছাদ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে সুপারী গাছ থেকে একেবারে মাটি পর্যন্ত স্লিপারে যেভাবে স্লিপ খায় সেভাবে স্লিপ খেয়ে খেয়ে নিচে নামতাম। কি যে দস্যুপনা,,, কল্পনাও করা যায় না! আবার দলবেঁধে নদীতে গোসল করতে যেতাম। এমন মজা করে গোসল করতাম। নদীর উঁচুপাড়ে পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে স্লিপারের মতো করে দলবেঁধে সবাই উঁচু থেকে নিচুতে স্লিপ খেয়ে খেয়ে নদীতে ঝাপিয়ে পড়তাম। নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত সাঁতরাতাম। নদীর স্রোত এর কারণে ওপারে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকদূরে চলে যেতাম। অনেক রিস্ক নিয়ে আমরা এভাবে সাঁতার প্রতিযোগিতা খেলতাম। আর এভাবে দুইতিনঘন্টায়ও আমাদের গোসল শেষ হতোনা। বড়দের কেউ বেত নিয়ে আসার পর তারপর আমাদের হুঁশ ফিরতো। বেতেরবারি খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। সবাইকেই পিটাতো। আহ্ এখনও ব্যথা পাচ্ছি কি মাইর!!! হা হা হা। তারপরও যেই লাউ সেই কঁদু। প্রতিদিনই একই ঘটনা। এভাবে আনন্দে আনন্দে চারপাঁচদিন কিভাবে যে কেটে যায় টেরই পেতামনা! বেলায় বেলায় ঘরভর্তি ৫০-৬০ জনের রান্নাবান্না করার পরও আম্মু, চাচী, ফুফুদের মুখে শুধুই হাসি দেখতাম। কোনো ক্লান্তিই যেন কারও আনন্দকে মাটি করতে পারে নি। ভাবলে অবাক লাগে কিভাবে ওনারা এতজন মানুষকে সুন্দরভাবে সামলিয়েছেন তাও টানা প্রায় একসপ্তাহ। এভাবে বছরের পর বছর। সবার সাথে সবার দেখা হবার মনের আনন্দই হয়তো ওনাদের কাজ করার, সবাইকে সন্তুষ্ট করার এত মানসিক মনোবল ও শক্তি জুগিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। ভোর থেকে গভীররাত পর্যন্ত তাঁদের এ আত্মত্যাগ বাংলাদেশের প্রায় সব পরিবারেই দেখা যায় কিন্তু তাঁদের এই হাড্ডিক্ষয় করা পরিশ্রম কি সবাই বুঝে!!! তারপরও মা-চাচীদের মুখে আনন্দের কমতি ছিলোনা। হাসিমুখে সবার সাথে চলতেন। আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল, আমরা যখন খুব ছোট ছিলাম তখন শুধু আমাদের বাড়িতেই ইলেকট্রিসিটি ছিলো। আলাদাভাবে আব্বু কারেন্ট এর লাইন এনেছিলেন বাজার থেকে। তখনও আমাদের বাড়ীর ওখানে পল্লী বিদ্যুৎ না আসায় অন্যদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আসেনি। তাই আমাদের বাড়িতেই শুধু টিভি ছিলো। ঘরভর্তি মানুষ, পাড়া প্রতিবেশী সবাই মিলে একশো -দেড়শোর মত মানুষ টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান, সিনেমা দেখতে আসতেন। ড্রইংরুমে এতজন মানুষ বসানো সম্ভব ছিলোনা। টিভি বারান্দায় বের করা হতো। মুরুব্বীদের সোফায় বসানোর ব্যবস্হা করা হতো আর বাকী বড়ছোট সবার জন্য উঠানে পাটি বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হতো। সেই দৃশ্যগুলো এখন শুধুই মনের মনিকোঠায় শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে, সে দৃশ্য আর কখনোই ফিরে আসবেনা। এখন সবার ঘরে ঘরে টিভি আছে। তারপর আস্তে আস্তে ফুফুরা সবাই ঈদের আনন্দ শেষে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে বড়ােদের সালাম করে, ছোটদের আদর করে শশুড়বাড়ি ফিরে যেতেন। ঘর যেন শূন্য হয়ে যেতো। আম্মুও দু’দিনের জন্য নানাবাড়ি যাবার সুযোগ পেতেন সাথে আমরাও। আব্বু আমাদের সাথে যেতেন। নানুবাড়িতে মুরুব্বীদের সালাম করে, শ্যালকদের সাথে দুষ্টুমী করে রাতে খেয়েদেয়ে দাদীর কাছে ফিরে আসতেন। আমার আব্বু ছিলেন মাপাগল ছেলে। তারপর আব্বুরও দশদিনের ছুটি শেষ হলে আমাদেরও ফেরার সময় হয়। দাদীকে সালাম করে কাঁদতে কাঁদতে বের হতাম। প্রায় আধমাইল পর্যন্ত দাদীসহ আশেপাশের সবাই কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে দিতেন। কি যে অভাবনীয় অদ্ভুত দৃশ্য। কল্পনা করলে এখনও অবাক লাগে, মানুষের আন্তরিকতা ও ভালোবাসাগুলো কতটা গভীর হলে এভাবে প্রতি বিদায় বেলায় প্রতিবছরই কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিতেন। ট্রেনে ওঠার পর দাদীর স্নেহমাখা মায়াবী মুখটি বার বার ভেসে ওঠে আর কাঁদি। বাড়ির গেরস্তির সব দায়িত্ব দাদীর উপর। দাদা মারা যাবার পর একহাতে দাদী আমার সব সামলিয়েছেন। ভাগ্যিস আব্বু সরকারি চাকরি করে সংসারের হাল ধরেছিলেন। আর দাদীর পরিচালনায় অসাধারণ সুন্দর একটি বড় পরিবার ছিলো আমাদের পরিবারটি। তাই দাদীকে আমরা চাইলেও সবসময় আমাদের কাছে এনে রাখতে পারতামনা। বছরে দাদী সময়করে কয়েকবার এসে আমাদের দেখে যেতেন। বড় ছেলে আমার আব্বু ছিলেন দাদীর কলিজা আর আমার আব্বু ছিলেন মাপাগল মাভক্ত ছেলে। দাদী আমাদের বাসায় আসলে দাদীর পায়ে পড়ে থাকতেন আব্বু। দাদী মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ছেলেকে আদর করতেন। শহরে ফেরার পর একসপ্তাহ পর্যন্ত পড়ায় মন বসাতে পারতাম না। সারাক্ষণ বাড়ির কথা মনে পড়তো। এরকম ছিলো আমাদের ছোটবেলার ঈদ৷ কি যে আনন্দের, কি যে দুরন্তপনার!!!!
আজ দাদীও নেই, আব্বুও নেই! মাপাগল ছেলেটা মা মারা যাবার পরের বছরেই একই দিনে একই মাসের একই তারিখে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে মহান আল্লাহপাকের ইশারায় মায়ের কাছে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন। এ রহস্য আজও আমাদের কাছে রহস্যই রয়েগেলো। মা-ছেলের এত মায়া, এত ভালোবাসা, এত টান এ পৃথিবীর বুকে আমি আর দেখিনি। আমরা শুধু দাদী আব্বুকে হারাইনি সাথে সাথে হারিয়েছি আমাদের সেই দূর্লভ আনন্দের শৈশব।
_____________________________________
লেখক : মাহবুবা সুলতানা শিউলি
মেম্বার, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ।
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
ইমেইল : mahbubasheuly82@gmail.com