আলমগীর মানিক,রাঙামাটি :

কাপ্তাই হ্রদ ও পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে ঈদের ছুটিতে দেশী-বিদেশী অনেক পর্যটক এখন রাঙামাটিতে। অনেকেই তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে এসেছে এই পর্যটন শহরে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে অপরূপ এ পাহাড়ী অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য রয়েছে মনোলোভা আকর্ষণীয় উপাদান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেশী-বিদেশী পর্যটকদের মন আকৃষ্ট করছে। ভালো মানের হোটেলে সিট না পেয়ে অনেকে বিভিন্ন নিন্মমানের হোটেলে রাত কাটাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার পর্যটক বর্তমানে রাঙামাটিতে প্রবেশ করছে বলে নিরাপত্তা চেকপোষ্টগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানাগেছে।

এদিকে, পর্যটকদের আগমন উপলক্ষে হোটলে, মোটেল গুলোকেও সাজানো হয়েছে নব সাজে। পাহাড়ি এই জেলায় আগত পর্যটকদের কাছে পর্যটন কমপ্লেক্সের দিকেই আকর্ষণ বেশী। ঈদের ছুটিতে বেড়াতে আসা লোকজনের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের ঝুলন্ত সেতু ও রাঙামাটি পুলিশ বাহিনী পরিচালিত পলওয়েল পার্ক। স্পিড বোট ও দেশীয় নৌ-যান নিয়ে পর্যটকরা কাপ্তাই হ্রদে ভ্রমন করে সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পাশাপাশি আনন্দ ভাগ করে নিলেও পর্যটকরা অপার সম্ভাবনাময় রাঙামাটির বর্তমান পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে খুশি নয়। আগত একাধিক পর্যটক জানালেন, রাঙামাটিতে আরো অনেক অনেক কিছু করার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও বান্দরবান-খাগড়াছড়ির তুলনায় রাঙামাটির পর্যটন সেক্টর সেভাবে উন্নয়ন হয়নি।

রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের ম্যানেজার সৃজন বিকাশ বড়–য়া জানিয়েছেন, ঈদের পর থেকে রাঙামাটিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক বেড়াতে এসেছেন। তাদের কর্পোরেশনের সবগুলো রুমই বর্তমানে বুকিং থাকায় আগত পর্যটকরা অন্যত্র রুম নিয়ে থাকতে হচ্ছে। এদিকে রাঙামাটিতে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাঙামাটির জেলা পুলিশের পাশাপাশি টুরি‌্যষ্ট পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঝুলন্ত ব্রীজের ঘাটে একটি হেল্প ডেক্স খোলা হয়েছে জানিয়ে টুরি‌্যষ্ট পুলিশের এসআই জহিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, পর্যটকবৃন্দ কোনো প্রকার ঝামেলায় পড়লে বা সহযোগিতার প্রয়োজন হলে উক্ত হেল্প ডেক্সের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক সহযোগিতা নিতে পারবেন।

এদিকে এবছর রাঙামাটিতে ঈদ ও সরকারি টানা ছুটিতে হোটেল-মোটেলগুলোতে ৭০ শতাংশ বুকিং হয়েছে। হোটেল-মোটেল ও পর্যটন ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটি শহরে হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির ৪৩টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে দেড় হাজারের বেশি পর্যটক থাকতে পারবেন। ঈদ ও সরকারি টানা ছুটিতে এ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কক্ষ আগাম বুকিং করা হয়। তবে গত বছর ঈদের ছুটিতে ৮০ শতাংশ কক্ষ বুক হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সে দুটি পর্যটন মোটেল ও তিনটি কটেজ রয়েছে। এসব মোটেল ও কটেজে ৮৮টি কক্ষ রয়েছে।

এদিকে সুবলং ঝর্ণায় যাওয়ার পথেই হ্রদের লাগোয়া দ্বীপে অবস্থিত জুম রেস্তোরার পরিচালক সুনয়ন ত্রিপুরা দীপু জানিয়েছেন, ঈদের পরদিন থেকে পর্যটকরা আসতে শুরু করেছে। এতে করে তাদের আয়ও বেড়েছে কিছুটা। কিন্তু হ্রদের পানি কম থাকায় পর্যটকরা ভালোভাবে নৌ ভ্রমন করতে পারছেনা। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলে পানি বাড়বে তখনই বোটগুলো চলতে পারবে এবং তাদের ব্যবসাও ভালো চলবে।

রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের নৌযান ঘাট সূত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের জন্য দেড় হাজারের বেশি নৌ-যান রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের নৌ-যান ঘাটে দুই শতাধিক নৌযান রয়েছে। এ ছাড়া শহরের রিজার্ভ বাজার, রাজবাড়ি ঘাট, শিল্পকলা ঘাট, সমতা ঘাট ও ফিশারি ঘাট থেকেও পর্যটকদের জন্য নৌযান ভাড়া দেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি কাপ্তাই লেকে পানি কমে যাওয়ায় নৌ-চলাচল বেশ সীমিত হয়ে যায়। এতে পর্যটকের সংখ্যাও কমে যাবে বলে পর্যটন ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। তবে ছুটিকালীন সময়ে ভালোভাবে বৃষ্টি হলে লেকের পানি বেড়ে গেলে পর্যটকদের ভ্রমণের সুবিধা বাড়বে বলে ধারনা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্স, পলওয়েল পর্যটন কেন্দ্র, বেসরকারী পর্যটন কেন্দ্র চাং পাং, পেদা টিং টিং, সুবলং এর প্রাকৃতিক ঝর্ণা দেখতে ভীড় করছে পর্যটকরা। রাঙামাটিতে আসা পর্যটকরা বেশি ভিড় জমাচ্ছেন দুই পাহাড়ের মাঝখানের আকর্ষণীয় ঝুলন্ত সেতুতে। তার পরেই পর্যটকদের আগ্রহ বেশি মনোমুগ্ধকর ঝর্ণা, জেলা পুলিশের তত্বাবধানে পরিচালিত পলওয়েল পার্ক, জেলা প্রশাসকের বাংলো, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি সৌধ, বালুখালী কৃষি খামার, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফুলী পেপার মিল ও কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের দিকে। এসব পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতেও এখন সেখানে আগত পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে।

ইতিমধ্যেই কাপ্তাই লেকে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে বিভিন্ন পর্যটন স্পট তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে পেদা টিং টিং, গাং সাবারাং, মেজাং, সুবলং ঝরনা, সুবলং বাজার, মারমেট, চাং পাংসহ অসংখ্য স্পট তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকেরা লেকে ভ্রমণ শেষে এসব স্পটে খেতে পারেন বা বিশ্রাম নিতে পারেন। এ ছাড়া রাঙামাটি কাপ্তাই সড়কে পাশে বড়গাঙ, বেড়ান্নে ও ইজোর নামে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট করা হয়। সম্প্রতি শহরের লেকের পাড়ে রিজার্ভ মুখ এলাকায় পুলিশের পলওয়েল নামে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট করা হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন স্থানীয় ও জেলার বাইরে থেকে পর্যটকেরা ভিড় করেন। অন্যদিকে রাজবাড়ি ও রাঙামাটি রাজবন বিহার দেখতে শতশত পর্যটক ভিড় করেন।

এদিকে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি স্পটে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কয়েক স্তরে ভাগ করে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ।

২০১৭ সালে রাঙামাটিতে ভয়াবহ পাহাড়ধসের পর পর্যটকের সংখ্যা কমে যায়। তবে গত বছরে ঈদ ও দুর্গাপূজা ছুটিতে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যায়। পর্যটকদের আকর্ষণ কাপ্তাই লেকে পানি সংকট সৃষ্টি হওয়ায় লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকা চলাচল সীমিত হয়। এ কারণে টানা ছুটিতে রাঙামাটিতে পর্যটকের আগমন নিয়ে নানা আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

পর্যটক কমপ্লেক্স নৌঘাটে নৌযান সমিতির সভাপতি মো. রমজান আলী বলেন, ‘আমরা খুবই চিন্তায় রয়েছি। নৌযান চলাচলের তেমন পানি নেই। পানি না থাকলে লেকের ভ্রমণেও তেমন আকর্ষণ থাকে না। তবে আশা করছি দু’য়েকদিনের মধ্যে বৃষ্টি হলে লেকের পানি বেড়ে যাবে। তখন পর্যটনের জন্যও সুবিধা হবে।

রাঙামাটি হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মো. মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের ঈদের টানা ছুটিতে হোটেল-মোটেলগুলোতে আগাম বুকিং বেশি হয়নি। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০ শতাংশ বুকিং হয়েছে। আমরা আশা করছি দু’য়েক দিন থেকে কমপক্ষে ৭০-৮০ শতাংশ কক্ষ বুকিং হবে। যেহেতু ঈদের ছুটির পর সরকারি ছুটি রয়েছে, তাই পর্যটক আরও আসবে।’

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের সীমান্তবর্তী আয়তনে সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটি। চারিদিকে সবুজের সমারোহ আর পাহাড় ঘেড়া এ জেলায় রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদ। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে অনুপম আধাঁরের রাঙামাটি জেলা তার বৈচিত্রময়তার কারণে আকর্ষণীয় স্থান হিসাবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের মনে স্থান করে নিয়েছে। উঞ্চ হাওয়ায় কাপ্তাই হ্রদ ও পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে দেশী-বিদেশী অনেক পর্যটক তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসছে পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতে।